Why in Architecture?

‘কেন আর্কিটেকচার পড়তে এসেছো?’

আমি ডিপার্টমেন্টে ঢুকার পর প্রথম দিন থেকেই প্রশ্নটির মুখোমুখি হয়ে আসছি। ফার্স্ট ইয়ারে থাকার সময় আমরা যে উত্তর দিতাম সেটা অনেকটা এরকম, ‘ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল আর্কিটেক্ট হবো’ বা ‘আমি আঁকাআঁকি করতে খুব পছন্দ করি তাই…’ অথবা ‘ইচ্ছা ছিলো সৃজনশীল পেশায় কাজ করবো এজন্য……’। আরেকটা উত্তর ছিলো যেটা সবার সামনে বলা যেত না সেটা হলো, ‘চান্স পেয়েছি তাই পড়তে এসেছি।’

স্যাররা এইসব উত্তর শুনে হাসতেন।

আমি বুঝতাম এসব উত্তর আসলে ঠিক নয়। ওনারা অন্য কিছু জানতে চাচ্ছেন। তাহলে সঠিক উত্তরটা কি? কেন আমি আর্কিটেকচার পড়ছি- এটাই কি প্রশ্নটা? নাকি এত সাব্জেক্ট বাদ দিয়ে আর্কিটেকচার পড়ার পিছনে কারণ কি? আর্কিটেকচার পড়ে আমি কি করবো? কি সেই উদ্দেশ্য- এটাই কি স্যাররা জানতে চাচ্ছেন?

অনেকদিন এর উত্তর খুঁজলাম। ঘরবাড়ি ডিজাইন করার জন্য আর্কিটেকচার পড়ছি। আর্কিটেক্ট হয়ে সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি ডিজাইন করবো। মোটামুটি এই রকম উত্তর একটা ঠিক করলাম প্রথম সেমিস্টারে।

দ্বিতীয় সেমিস্টারে উঠে মনে হলো উত্তরটায় ঘাপলা আছে।সারা পৃথিবীর প্রায় সব সাবজেক্টে যেখানে চার বছরে স্নাতক ডিগ্রি দেয়া হয় সেখানে আমরা শুধু বাড়িঘর ডিজাইন করা শিখি পাঁচ বছর ধরে। কি নেই আমাদের শেখার তালিকায়, ফিজিক্স, সোশিওলজি, আর্ট, মিউজিক, প্ল্যানিং, মেকানিক্স, ইকনোমিক্স, ফটোগ্রাফী, সাইকোলজি, স্কাল্পচার, লজিক এন্ড ফিলোসফি, ইলেক্ট্রিকাল ইকুইপমেন্ট, সেমিনার, একাউন্টিং, ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু নন ডিপার্টমেন্টাল সাব্জেক্টগুলো যদি এরকম হয় তাহলে দুইটা সম্ভসবনা হতে পারে।

এক, এসব জিনিস বেহুদা পড়ায়, কারণ এসব না পড়েও অনেক নন আর্কিটেক্ট বিল্ডিং ডিজাইন করতে পারে।

দুই, এসব জিনিস পড়ায় শুধু বিল্ডিং ডিজাইন করার জন্য না, আরও অন্যকিছু করার জন্য।

এক নম্বর সম্ভাবনা নিজের ঠিক বিশ্বাস হয় নাই। যদি দুই নম্বর সম্ভাবনা মেনে নেই, তাহলে প্রশ্ন আসে এই ‘অন্যকিছু’টা কি?

দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে উঠে ‘ফাংশন’ নামক একটা জিনিসের সাথে পরিচয় হলো। তখন বুঝতে পারলাম আর্কিটেক্টের কাজ বাসা বাড়ি সুন্দর করে ডিজাইন করা না, আর্কিটেক্টের কাজ স্থান (space)কে দৃষ্টিনন্দনভাবে (aesthetically) ব্যবহার উপযোগী(functional) করে তোলা। স্থাপত্য অর্থটা অনেক জটিল মনে হয় নিজের কাছে। কারণ তখন থেকেই বুঝতে পারলাম কাজটা আসলে কতটা কঠিন।

দ্বিতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারে উঠার আগেই কিছু ভাসা ভাসা জিনিস জানতে পারলাম। একটা বাড়ি আসলে শুধু বাড়ি নয়। এটার সাথে জড়িত আসলে অনেক কিছু। আগেকার দিনে বাড়িগুলো হতো এক রকমের। পুরানো বাড়িগুলোতে দেখা যায় এক রুমের মধ্য দিয়ে অন্য রুমে যেতে হয়। রুমগুলো ছোট হলেও বারান্দা থাকে বিশাল। আবার প্রত্যেক তলার ছাদের উচ্চতা ছিলো অনেক বেশি। বাড়িগুলো তৈরি হতো চুন-সুরকি দিয়ে।

আর এখনকার ফ্ল্যাট বা বাড়িতে দেখা যায় প্রাইভেসির জন্য প্রত্যেক রুমে আলাদা প্রবেশ পথ। আবার ডিজাইন এমনভাবে করা হয় যেন এক রুম থেকে আরেক রুমের ভিতরটা দেখার সুযোগ না থাকে। প্রাইভেসির জন্য মা- বাবার রুম, ছেলের রুম, মেয়ের রুম, গেস্ট রুম, লিভিং রুম, ডাইনিং রুম ইত্যাদি বেশ পৃথক থাকে। এর ফল স্বরূপ এখনকার পারিবারিক বন্ধন পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। যেমন বাবা অফিস থেকে এসে নিজের রুমে চলে যায়। ছেলে ছেলের রুমে, মেয়ে মেয়ের রুমে যার যার মত ব্যস্ত থাকে। তাই নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। বাড়ছে মোবাইলে কথা বলা আর ফেসবুকিং এর নেশা।

আজকাল রুম একটু বড় করার জন্য বারান্দা নাই করে দেওয়া হচ্ছে। মানুষের সুস্থতার জন্য এতটুকু খোলা জায়গার প্রয়োজনীয়তা যে কি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটু আউটডোর স্পেসের অভাবে  বন্দি হয়ে যাচ্ছে নগরবাসী যার প্রভাব পড়ছে তাদের স্বাস্থ্যে এবং মানসিকতায়। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা হাসপাতাল আর ডায়াগনসিস সেন্টার দেখলেই বোঝা যায় নগরবাসীর লাইফ স্টাইলে বড়সড় ধরনের ঘাপলা আছে। আর সংকীর্ণ্‌, ঘুপচি, দম বন্ধ করা বাসায় থেকে যে কোন মানুষ সৎচিন্তাশীল এবং বিশাল হৃদয়ের অধিকারী হবে না এ কথা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না।

বাসাবাড়িতে ছাদের উচ্চতা কমে যাওয়ার জন্য গরম বাতাস ঘুলঘুলি দিয়ে বের করে দেওয়ার যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ছিল তা বাদ হয়ে যাচ্ছে। এখন তাই পাখার বাতাসেও কাজ হচ্ছে না। দরকার হচ্ছে এসির। বাড়ছে বিদ্যুত বিল, বাড়ছে লোডশেডিং। জাতীয় পর্যায়ে বিদ্যুত আমদানির কথাও ভাবা হচ্ছে এখন।

চুন সুরকির বদলে কনক্রিট ব্যবহার বেড়ে গেছে। কনক্রিট নন ডিসপোজেবল ম্যাটেরিয়াল। তাই দিন দিন মাটির উপর শক্ত শক্ত আবর্জনা বাড়ছে যেটা কোন দিনও মাটির সাথে মিশবে না।

এতগুলো কথা বললাম এই কথা বোঝাতে যে ছোট্ট একট বাড়ি ডিজাইন করা মানে যে শুধু বাড়ি ডিজাইন করা তা নয় এর সাথে মানুষের জীবনধারা, স্বাস্থ্য, দেশের ভবিষ্যত, দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ সরাসরিভাবে জড়িত। যার অর্থ দাঁড়ায় একটা দেশের স্থপতিরা মিলে দেশের মানুষের জীবনধারা, স্বাস্থ্য, দেশের ভবিষ্যত, দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ বদলে দিতে পারেন- সেটা ভালো দিকেও হতে পারে, খারাপ দিকেও হতে পারে। তাহলেই বোঝা যায় একটা দেশের জাতীয় পরিসরে একজন স্থপতির ভুমিকা কত বি-শা-ল।

এখন আমি সেই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পেয়েছি। এখন যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন আর্কিটেকচার পড়তে এসেছো?(য)’, আমি মাথা উঁচু করে বলবো, “দেশকে বদলে দিতে চাই, এজন্য আর্কিটেকচার পড়তে এসেছি।’’