The Mighty INDIA CALLING: যত কান্ড কোলকাতাতে (পর্ব ৩)

ঘুমের ঘোরেই টের পেলাম মজুমদার, মৌলি, রুবাইদা রেডি হচ্ছে বের হওয়ার জন্য। ওরা বের হওয়ার সময় আমাকে ডেকে দিলো। আমি কোনমতে টলতে টলতে উঠে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। তারপর বিছানায় উঠে আবার ঘুম।

সাড়ে নয়টার দিকে দরজায় নক পড়লো, কোনমতে ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে?’ টের পেলাম নিশাত আর তমা। ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দিলাম। ওরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘কি রে? বের হবি না? তোর রুমের লোকজন সব কই?’ আমি চোখ ডলতে ডলতে বললাম যে ওরা চলে গেছে, আমি ঘুমাচ্ছিলাম। ওরা বলল, ‘তুই কি একা থাকবি নাকি? পনের মিনিটের মধ্যে রেডি হ। আমরা বের হবো।’

ওরা চলে গেলে আমি চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘুম তাড়িয়ে ঝটপট রেডি হয়ে গেলাম। ঠিকঠিক পনের বিশ মিনিট পর আমরা বের হয়ে পড়লাম। ঢুকলাম আরাফাত হোটেলে। আমি, নিশাত, তমা, রিন্তু, পৃথ্বী পাঁচজনে মিলে অর্ডার দিলাম নান রুটি আর ডাল দিয়ে খাসী মাংস। হোটেলটা মুসলিম। সুতরাং আমরা তৃপ্তি করে খেলাম। আমার বিল আসলো ৩০ রুপি।

রফ
কোলকাতার পথেঘাটে (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

এখান থেকে বের হয়ে ট্রাম লাইন ধরে এগিয়ে একটা চায়ের দোকানে থেমে ওরা মাটির ভাঁড়ে করে চা খেলো। চা খেতে খেতে আমরা দোকানের মানুষগুলোর সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে আমাদের বেশ কদর করলো। ওনারা আমাদের সাজেশন দিলো হেঁটে হেঁটে কলকাতা শহর ঘোরার জন্য। হাঁটার জন্য নাকি কলকাতা খুব চমৎকার। ট্যাক্সি বা রিক্সা ভাড়া করতে গেলেই নাকি গলা কেটে দিবে। ইউনিফর্ম ছাড়া কোন মানুষের কাছে কোন কিছু জিজ্ঞেস না করতে বললো। আরও বললো, ভিক্টোরিয়া, ভারত মিউজিয়াম এগুলো নাকি খুবই কাছে।

উনাদের কাছ থেকে উপদেশ পেয়ে আমরা হাঁটা ধরলাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে পার্ক স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে লাগলাম। কি চমৎকার নিরিবিলি রাস্তা, পুরানো দেয়াল, পুরানো আমলের বাড়ি, নতুন ডিজাইনের বাড়ি, চওড়া ফুটপাথ। হাঁটতে হাঁটতে আমরা মেইন রোডে উঠে পড়লাম। সেখানে বড় একটা ফ্লাই ওভার। আমরা তার নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। রাস্তার ঐ পাশে দেখা যাচ্ছে ডগ শো টাইপের কিছু একটা হচ্ছে। ঠিক হলো প্রথমে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, তারপর দরকার হলে ডগ শো। আবার রাস্তা ক্রস করে আগের পাশে এসে হাঁটা ধরলাম। ফুটপাতে কি চমৎকার সব জিনিসপত্র! লেবুর শরবত অর্থাৎ নিম্বু পানি, টি শার্ট, বাচ্চাদের জামা, জুয়েলারি, ক্যালেন্ডার, পোস্টার, পুরানো কয়েন, শো পিস আরও কত কি! নিশাত আর তমা দুজনে দুটো পিতলের বালা কিনলো। একটা ৬০ অন্যটা ৪০ রুপি দিয়ে। সেইটা পড়েই ওরা হাঁটতে লাগলো। আমরা জাদুঘরে পৌছে গেলাম। রিন্তু গেলো টিকেট কাটতে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে বললো লোকটা আমাদের আইডি দেখাতে বলেছে অথবা বিদেশি টিকেট কাটতে বলেছে। হিজাব পড়া রিন্তুকে সে কলকাতার মানুষ বলে বিশ্বাস করে নাই। সাধারণ টিকেট ২০ রুপি আর বিদেশি টিকেট ২০০-৩০০ রুপির মত। এত টাকা দিয়ে বিদেশি টিকেট কাটার কোন মানেই হয় না। ইন্ডিয়ার প্রথম টিকেট কাটতে গিয়েই ধরা খেয়ে আমরা বেশ হতাশ হলাম।

মিউজিয়ামে ঢুকতে না পারি তো কি হয়েছে? ডগ শো তো আছে। আবার রাস্তা পার হয়ে ডগ শোতে গেলাম। এবার পৃথ্বী ১০ রুপির টিকেট কেটে দিলো। ভেতরে ঢুকলাম। খোলা আকাশের নিচে নানা রকমের কুকুর নিয়ে বড়লোক মানুষজন এসেছে। হাউন্ড, অ্যালসেশীয়ান, ল্যাব্রাডর, বুল ডগ, পিকনিজ কি নেই এখানে। ইয়া বিশাল দৈত্যের সমান কুকুর থেকে শুরু করে ছোট্ট নিরিহ কুইকুই করছে এমন কুকুরও আছে। একটা কুকুর দেখলাম একদম মেরু অঞ্চলের নেকড়ে বাঘের মতন। মালিকরা তাদের কুকুরগুলোকে সাজগোজ করাচ্ছে। দাঁত মাজিয়ে দিচ্ছে, ক্রিম লাগাচ্ছে, স্প্রে দিচ্ছে- কুকুরগুলো আরাম করে সে সব উপভোগ করছে। কুকুর ছাড়াও আছে কুকুরের জন্য দোকান। কুকুরের খাবার, কসমেটিক্স, খেলনা, ঘরবাড়ি, বিছানাপত্র, ওষুধপাতি – এই সব জিনিস্পাতি নিয়ে একেকটা স্টল বসেছে। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কুকুরের সাথে পোজ মেরে ছবি তুললাম। তারপর টায়ার্ড হয়ে বিশ্রাম নিতে বসলাম।

আমি এক ফাঁকে বাথরুমটা দেখে আসতে চাইলাম। সবাই বললো আগে তুই যা তারপর আমরা যাবো। খুঁজে খুঁজে লেডিস বাথরুমটা বের করলাম। শামিয়ানার ভেতর কাপড়ের পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। বাথরুম দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। খোলা আকাশের নিচে একটা কাপড়ের পার্টিশানের দুই পাশে মাটির উপর স্রেফ আলগা দুইটা হাই কমোড বসানো। কমোডের জিনিসগুলো যাবার কোন যায়গা নাই। কিন্তু সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হলো না। এর মাঝেই বড়লোক মানুষজন সব বাথরুম ব্যবহার করছে। পানির কোন ব্যবস্থা নাই, একটা দরজা পর্যন্ত নাই, দুর্গন্ধে আমার বমি আসার উপক্রম হলো। আমি দৌড়ে বের হয়ে আসলাম। ওদের সবাইকে সাবধান করে দিলাম, ভুলেও যেন বাথরুমের দিকে না যায়। শুনে ওরাও ভয় পেলো, সব জায়গায় এরকম বাথরুম থাকলে তো সমস্যা। আমরা এখান থেকে বের হওয়ার জন্য উঠলাম। গেটে এক অসম্ভব কিউট বাচ্চা মেয়েকে তার মায়ের কোলে লেপ্টে থাকতে দেখলাম। আমরা সবাই সেই বাচ্চা, তার পিচ্চি ভাই আর মায়ের সাথে ছবি তুললাম। বের হয়ে দারোয়ানের সাথে কথা বলে আমরা সামনে যেন কি একটা আছে শুনে হাঁটতে লাগলাম।

কিছুদূর আগানোর পরেই আমরা রাস্তার মাঝে একটা বিশাল পার্ক টাইপের জায়গায় গাছ দিয়ে বানানো ময়ুর দেখলাম। ভেতরে ঢুকতে হলে অনেক দূর হাঁটতে হবে দেখে আর ভিতরে ঢুকলাম না। বাইরে দিয়েই দেখেই আবার হাঁটতে লাগলাম। কোলকাতার এই জায়গাটা অনেকটা আমাদের বনানী এলাকার মতন। রাস্তার একপাশে উঁচু উঁচু সব কমার্শিয়াল বিল্ডিং, তবে দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে অনেক গ্যাপ। রাস্তার অন্য পাশে পার্ক, গার্ডেন, ময়দান টাইপের জায়গা। তার সাথে চওড়া ফুটপাথ, চওড়া বুলেভার্ড টাইপের জায়গা। আবার ফুটপাথের সাথে পার্কের ভিজুয়াল কানেকশন খুবই ভালো। এক পাশে পার্ক, চওড়া ফুটপাথ, একটু পর পর বিশ্রাম নেবার জায়গা আর মেট্রো ধরার জন্য আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবার সিঁড়ি, ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলছে রংচঙ্গে বাস- আমরা হাঁটাটা খুবই উপভোগ করছিলাম। সুন্দর আরবান প্ল্যানিং নগরবাসীর মনে কি রকম প্রভাব ফেলে তা হাতে কলমে বুঝতে পারছিলাম।

একসময় আমরা ইলিয়ট পার্ক নামের একটা পার্ক পেলাম। সেখানে ঢুকে ঘুরলাম, ফিরলাম। চমৎকার জায়গা। কোন আজেবাজে লোক নাই আর মেইন্ট্যানেন্স খুবই ভালো। আমরা অনেক ছবি তুললাম। বের হয়ে এসে জানতে পারলাম এটা টাটা কোম্পানি সরকারকে উপহার দিয়েছে। কি উপহার! কিছুদূর গিয়ে আমরা বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম পেলাম। কিন্তু শোর সময় আমাদের সাথে না মিলার কারনে আমরা বাইরে থেকেই ছবি তুললাম। এইটাও নাকি বিড়লা কোম্পানি সরকারকে উপহার দিয়েছে! প্ল্যানেটোরিয়ামের গেট থেকে বের হয়ে একটু এগিয়েই দেখলাম নানা রকম ফল কেটে বিক্রি করছে একজন। পেপে, তরমুজ, শশা, পেয়ারা, আপেল ছোট ছোট কিউব করে কাটা, উপরে বিট লবন টাইপ কিছু একটা ছিটিয়ে ওয়ান টাইম ইউজ কাগজের প্লেটে সাজিয়ে রেখেছে। আমি আর নিশাত ২০ রুপি দিয়ে একটা প্লেট কিনে ভাগ করে খেলাম। বেশ ভালো লাগলো।

খানিক দূর আগাতেই গুগল ম্যাপ দেখে চিৎকার করে উঠলাম আমি, গড়ের মাঠ! গড়ের মাঠ!! সামনে তাকিয়ে দেখলাম- এই তা হলে সেই গড়ের মাঠ? শুধু মাঠ বললে ভুল হবে, এ তো এক ময়দান। বি-শা-ল বড় খালি জায়গা। তাতে কত মানুষ! কেউ খেলছে, কয়েকটা দল ফুটবল প্র্যাক্টিস করছে, এখানে ওখানে ছাগল চড়ে বেড়াচ্ছে, অনেক মানুষ হাত পা ছড়িয়ে গল্প করছে, তাদের ঘিরে পানিপুরিওয়ালা, ফলওয়ালাসহ আরও বহু রকমের স্ট্রিট ফুড নিয়ে লোকজন বসে আছে।আমি চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম, মনে হলো টেনিদা আর প্যালারামকে বোধহয় একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে!

অবশেষে এসে পৌছালাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ফুটপাথ থেকেই দেখা যায় বিশাল রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ধবধবে সাদা মহলটা। বাইরে থেকে দেখেই বোঝা গেলো এটা গ্রীক স্থাপত্য। এবার আমরা আবার পৃথ্বীকে পাঠালাম টিকেট কাটতে। সহজেই ১০ রুপির টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। অনেক দূরে হেঁটে আমরা দালানের ভিতর ঢুকলাম। সারা জীবন যে গ্রীক স্থাপত্য পড়ে এসেছি তার বিভিন্ন উপাদান যেমন- কলাম, রোজ উইন্ডো, ডোম, পেন্ডেন্টিভ ইত্যাদি চোখের সামনে দেখে বেশ উত্তেজিত বোধ করলাম। ভেতরে বিশাল বিশাল সব চমৎকার স্ট্যাচু, পেইন্টিং, দলিল, অস্ত্র ইত্যাদি আছে। আর আরেকটা হলে ভারতের ইতিহাস, তাদের বীরদের কথা, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অনুযায়ী তাদের ঘরবাড়ির সেট ইত্যাদি জিনিস বানানো আছে। এই অংশটা আমার কাছে বেশ রঙ চঙ্গে মনে হলো।

এখান থেকে বের হয়ে আমাদের সাথে প্রথম ‘সুলভ শৌচালয়’ এর সাথে পরিচয় হলো। এটা আর কিছুই না, এটা হলো পরিষ্কার বাথরুম তবে টাকা দিয়ে ব্যবহার করতে হয়। যখন আমরা ভিক্টোরিয়া থেকে বের হয়ে আসি তখন খেয়াল করি, এর অনেক অংশই এখনো আন্ডার কন্সট্রাকশনে আছে। পেটে তখন আমাদের খিদের আগুন জ্বলছে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে স্ট্রিট ফুডে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমি নিলাম ২০ রুপি দিয়ে ডিম রোল নামের একটা জিনিস। অন্যরা নিলো ভেলপুরি, চাট, চানাচুর, পেটিস, নুডুলস, নিম্বু পানি- এই সব। কোনটারই দাম ২৫ রুপির বেশি না। আমরা তৃপ্তি করে পেট ভরে খেলাম।

dgr
জিভে পানি আসা পাপড়ি চাট (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

এরপর আমরা মোড়ের ট্রাফিককে জিজ্ঞেস করতে গেলাম বেলুর মঠ কিভাবে যাওয়া যায়। কিন্তু তারা আমাদের আশায় পানি ঢেলে দিয়ে বলল যে এখন বাজে চারটা আর বেলুর মঠ পৌছাতে পৌছাতে পাঁচটা বেজে যাবে। আর পাঁচটার সময়ই বেলুর মঠ বন্ধ হয়ে যায়। কি আর করা, আমরা কুইক ডিসিশন নিলাম যে কফি হাউজে যাবো। ওনারা সাজেশন দিলো এখান থেকে মেট্রো করে চলে যেতে। আমরা মহা আনন্দে আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো স্টেশনে গেলাম। কি সুন্দর ফাঁকা আর পরিষ্কার! আমরা দেওয়ালে টানানো লিস্টে কলেজ স্ট্রিটের নাম খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু পেলাম না। একজন ইউনিফর্ম পড়া মহিলা এগিয়ে এসে আমাদের বলল এম জি রোডের টিকেট কাটতে। আমরা কাউন্টারে লাইন ধরে ৫ রুপির টিকেট কাটলাম। টিকেট কোথায়, এ তো প্লাস্টিকের কয়েন! প্ল্যাটফর্মে ঢুকার আগে মেশিনে স্ক্যান করে সেই কয়েন দেখিয়ে ঢুকতে হয়। আমরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে দেখলাম ফাঁকা, শুনশান প্ল্যাটফর্ম। মুহুর্তের মাঝেই মেট্রো আসলো। তবে মেট্রোটা ফাঁকা নয়- প্রচুর ভীড়। মুহুর্তের জন্য দরজা খুললো, আমরা কিছু বোঝার আগেই সবাই ঠ্যালা ধাক্কা দিয়ে কোন মতে ভিতরে ঢুকে গেলাম। কোন মতে উপরে ঝুলতে থাকা হাতল ধরলাম, আর সাথে সাথেই দরজা বন্ধ করে ভয়ানক ত্বরণে মেট্রোটা এগিয়ে যেতে লাগলো। আমরা সবাই পিছন দিকে একদম হেলে পড়লাম। প্রচন্ড ভীড় , গায়ে গা ঘেঁষে আমরা দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু সুবিধা করতে পারলাম না। একটু পর পর একেকটা স্টেশন আসে আর আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি একজন আরেকজনের উপর। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, কত স্বপ্ন ছিলো, আমরা সবাই পাশাপাশি মেট্রোতে বসে একসাথে সেলফি তুলবো, তারপর সবাইকে দেখাবো যে আমরা কত এক্সাইটিং একটা কাজ করেছি- কিন্তু তা আর হলো কোথায়? এখন এখান থেকে নামতে পারলে বাঁচি। কান খাড়া করে রেখে এক সময় আমরা টের পেলাম যে আমাদের এম জি রোড স্টেশন চলে এসেছে। সেই আগের মতন কয়েক সেকেন্ডের জন্য মেট্রো থামতেই আমরা ধাক্কাধাক্কি করে হুড়মুড় করে নেমে পড়ি। মেট্রো থেকে নেমেই আমরা একজন অন্যজনের দিকে তাকাই, সবার চোখেই একই দৃষ্টি ‘এটা কি হইলো? একেই কি বলে মেট্রো? কিছু বুঝার আগেই তো শেষ হয়ে গেলো’ ।

যাই হোক আমরা সেই প্লাস্টিকের কয়েনটা জমা দিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হয়ে আসি। ফাঁকা এম জি রোডের কোন দিকে কফি হাউজ তা বুঝতে পারি না। আবার ট্রাফিকের কাছে যাই। রাস্তা দেখিয়ে উনি আমাদের হাঁটতে বলে। আমরাও হাঁটতে থাকি। বেশ কিছুদূর হেঁটে খুঁজে পাই বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ আর তার উল্টা পাশে কফি হাউজ।

কফি হাউসের ভেতরে যখন ঢুকি তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৫টা ছুঁই ছুঁই। অত্যন্ত সাধারণ চেহারার দালান। নিচ তলায় বোধহয় গোডাউন। দোতলায় কোন এক ব্যক্তির শোক সভা চলছিলো। আমরা তিনতলায় গিয়ে বসলাম। এই সেই বিখ্যাত কফি হাউজ! পাইক পেয়াদাদের মতন ফিটফাট পোশাক পড়ে বেয়ারারা ঘুরছে, আশেপাশে সব তরুন-যুবক বয়সী লোকেরা আড্ডা দিচ্ছে, আর নিচতলায় শোক সভায় আগত মানুষ -সব মিলিয়ে এক অদ্ভূত কম্বিনেশন তৈরি হলো। আমরা কোল্ড কফি, আর কি সব পাকোড়া অর্ডার দিলাম। একটু পর যত্ন করে ধোয়া কাঁচের গ্লাসে করে পানি দিয়ে গেলো। আমরা উসখুস করতে লাগলাম কখন খাবার আসবে, তার জন্য। এর মধ্যে অবনী, আদিবা, সৌরভ, জেরিন, আফরা আসলো। আমরা এক টেবিলে বসে গল্প করতে লাগলাম। খানিক পরে রিজভী, তুষার, শুভ, জুবায়ের, রাজিবসহ আরও অনেকেই যোগ দিলো। আমরা সবাই মিলে জোর গলায় হাসাহাসি করতে লাগলাম। অনেক্ষন পর খাবার আসলো। যদিও পাকোড়াটা মজার ছিলো না, তারপরও কফি হাউজ বলে কথা!  বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, হৈচৈ সব মিলিয়ে আমরা দারুন সময় পার করলাম।

সাড়ে সাতটার দিকে আমরা সবাই বের হয়ে বাসে উঠলাম। ৬ রুপিতে একটা লোকাল বাস আমাদের হাওড়া ব্রিজ পার করে নামিয়ে দিলো।  আমরা কাছ থেকে ঝলমলে হাওড়া ব্রিজ দেখলাম। ভারি চমৎকার লাইটিং, ক্ষনে ক্ষনে রঙ বদলায়। ব্রিজের স্ট্রাকচারটাও অত্যন্ত দারুন। ডাবল ট্রাস দেওয়া, নিচে কোন সাপোর্ট নাই, পুরাই ঝুলন্ত এক ব্রিজ। আমরা ব্রিজের উপরে উঠলাম। নিচে হুগলী নদী। ঠান্ডা বাতাসে জমে যাওয়ার উপক্রম হলেও আমাদের বেশ ভালোই লাগছিলো। আমরা ব্রিজ থেকে নেমে নিচে ফুলের পাইকারি বাজারে গেলাম। পচা গন্ধে নাক চাপা দিয়ে হাঁটতে হলো। শেষমেশ একটা নদীর তীর পাওয়া গেলো যেখান থেকে সুন্দর ব্রিজের ভিউ আসে। আমরা দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। তারপর আবার বাসে উঠলাম।

আলোকিত হাওড়া ব্রিজ (কৃতজ্ঞতায় সামিয়া অবনী)

কোলকাতার বাসগুলো বেশ সুন্দর। কাঠের বডি, বেশ চওড়া, ভেতরে দাঁড়ানোর অনেক জায়গা, জানালাগুলো স্লাইড করে বাসের দেওয়ালের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলা যায়। সিটগুলোতেও বসে আরাম। তবে হাত দিয়ে ধরার রড অনেক উপরে, হাত সবসময় টানটান করে রাখতে হয়। আরেকটা ব্যাপার হলো সবগুলো বাসেই ‘জয় মা তারা’ লিখা থাকে। বাইরে আবার বাসগুলো বেশ রংচঙ্গে। আর বাস ভাড়াও অ-নে-ক কম। আমি যখন বাসের ফ্যান হয়েই যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই সুহাইলার সাথে বাসে দাঁড়ানো নিয়ে এক মহিলার সাথে দারুন ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। যখন দেখে মনে হচ্ছিলো ব্যাপারটা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যাবে তখনই শুভ আমাদের সবাইকে নিয়ে ধর্মতলার স্টপেজে নেমে গেল। আমরা সুহাইলাকে ঠান্ডা করে আবার ধর্মতলা টু পার্ক স্ট্রিট আরেকটা বাসে উঠলাম। এবার আমরা সুন্দর মতন পার্ক স্ট্রিটে নেমে যাই।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা রাস্তা হারিয়ে এইগলি, ওইগলি ঘুরতে থাকি। মেইন রোডে সব বড় বড় রেস্টুরেন্ট- সাবওয়ে, ম্যাক ডোনাল্ডস, চাইনিজ তুং ফং, পাঞ্জাবী হোটেল – এইসব দেখতে পাই। এর মধ্যে এক গলিতে শামিয়ানা টানিয়ে কোন এক চিশতী বাবার উদ্দেশ্যে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখি। সেখানে একটা বাচ্চার গলায় ‘মুঝে মাজবুর হ্যায় জয় চিশতী’ গানটা আমার কানে এখনো বাজে। তারপর যাই হোক রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা সোজা দাওয়াত হোটেলে ঢুকি। এটা মুসলমান হোটেল। আমি ১১০ রুপি দিয়ে নান আর চিকেন টিক্কা অর্ডার দেই। দামটা একটু বেশি হলেও খাবার বেশ মজা। খাওয়া শেষে পানির বড় বোতল কিনে হোটেলে ফেরত আসি। আমি অন্যদের সাথে কথা বলে জানলাম, আমরা ছাড়া আর কেউ ভিক্টোরিয়া দেখে নাই, বেলুর মঠ বন্ধ ছিলো, ফুড ফেস্টিভ্যাল বোরিং ছিলো। শুনে বেশ খুশি হলাম। যাক দিনটা সাকসেস্ফুল হয়েছে।

খানিক পরে চিং লাফাতে লাফাতে আসলো। লাফ মানে লাফ, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই লাফ। ব্যাপার কি? এত খুশি কেন চিং? আমরা জিজ্ঞেস করছিলাম, কিন্তু খুশির ঠ্যালায় ওর মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। পরে আমরা বুঝতে পারলাম, চিং, উর্মি আর অদিতি দিপিকা পাড়োকানকে সামনা সামনি দেখেছে। দিপিকা নতুন ছবির শুটিং করার জন্য কলকাতায় এসেছে। দিপিকা হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় ওরা ধাক্কাধাক্কি করে একেবারে সামনে থেকে দেখে এসেছে। দিপিকার সাথে আরও ছিলো ইমতিয়াজ আলি আর সুনিধী চৌহান। কালো টপ-স্কার্ট, লাল সোয়েটার, লাল জুতা আর ছোট চুলে দিপিকাকে নাকি বেশ সুন্দরী লাগছিলো। পরে বুঝেছি, সিনেমাটা ছিলো ‘তামাশা’।

যাই হোক চিং চলে গেলে আমরা যার যার লাগেজ গুছিয়ে  রাখি, পরদিন ট্রেন জার্নি। ঠিক হয় যে, সকালে বের হওয়ার আগেই সব লাগেজ নিচতলায় ছেলেদের রুমে জমা দিয়ে বের হতে হবে। আমরা গোছগাছ করতে করতে উর্মির অট্টহাসি শুনতে পাই। আমাদের নিচেই ওদের রুম। জানালা দিয়ে ওদের হাহা হিহি শব্দ ভেসে আসতেই থাকে। আমরাও অনেক গল্প করে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।

2 Replies to “The Mighty INDIA CALLING: যত কান্ড কোলকাতাতে (পর্ব ৩)”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *