The Mighty INDIA CALLING: ফতেহপুর সিক্রিতে ‘মোঘলাই’ সম্রাজ্য এবং দিন শেষে গন্তব্য জয়পুর (পর্ব ১৭)

সকালে ঘুম ভাংগার সাথে সাথে মনে হলো ‘আমি কোথায়?’। কম্বলের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম আমার পাশে তমা শুয়ে আছে। দুইজনের মাঝখানে এত গ্যাপ আছে যে চাইলে আরও একজন অনায়াসে এই খালি জায়গাটায় ঘুমাতে পারবে। ট্যুরে আসার পর থেকেই মোটামুটি চারজনকে চাপাচাপি করে শুতে হয়েছে। এখানে তাই এত ফাঁকা জায়গা পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো এই আশংকায় যে আসলে আমি কোথায়। যাই হোক সবার শেষে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মেজে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ব্যাগ আগেই গুছানো ছিলো বলেই দেরি করতে হলো না। সোজা সবাই বের হয়ে পড়লাম। তিনতলার সিড়ি দিয়ে লাগেজ নামাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। হোটেলের এক জন লোক দৌড়ে এসে আমার লাগেজ নামিয়ে দিলো।

নিচে নেমে আমরা টিপস দিয়ে আবার ব্যাগ পত্র সব বাসের পিছনে জমা করলাম। হোটেলের নিচেই গোয়েল দাঁড়িয়ে ছিলো। সবাই গোয়েলের আশেপাশেই টং ঘর টাইপের দোকান থেকে ধোঁয়া ওঠা গরম চা আর বিস্কুট টাইপের জিনিসপত্র দিয়ে নাশতা খেতে লাগলো। আমি একটু এগিয়ে এক দোকান থেকে ব্রিটানিয়া কেক কিনে সেটা দিয়ে নাশতা করলাম। গোয়েলে ফিরে এসে দেখি এক ধরনের অদ্ভূত জিওমেট্রির খেলনা বিক্রি হচ্ছে। চিকন তার দিয়ে বানানো জিনিস্টাকে নাড়াচাড়া করে বিভিন্ন শেপ বানিয়ে ফেলা যায়। কয়েক জন ২০ রুপি দিয়ে সেই অদ্ভূত খেলনা কিনলো। আমরা বাসে উঠে বসলাম। ফতেহপুর সিক্রির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে দিতে প্রায় ১০টা বেজে গেলো।

পথে আমাদের ড্রাইভার কমিটির লোকজনকে ডেকে বললো যে উনার পরিচিত একজন গাইড আছে। ওনাকে ঠিক করলে উনি আমাদের সব কিছু ঘুরে দেখাতে পারবে। কমিটির লোকজন আমাদের মতামত নিয়ে রাজি হয়। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দুই জন লোক উঠলো। তাদের একজন লিডার টাইপের অন্যজন তার চ্যালা টাইপের লোক। লিডার টাইপের যে লোক তাকে দেখে আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। ইয়া মোটা, চশমা পরা ধুরন্দর চেহারার এক জন মানুষ। উনি বাসে উঠেই কমিটির লোকজনের সাথে টিকেট, বাস ভাড়া, গাইডের ভাড়া এই সব নিয়ে কমপ্লিট প্যাকেজ করতে লাগলো। আমরা তখন বুঝলাম যে আমরা দালালের খপ্পরে পড়েছি। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। এদের রিফিউজ করে দিলে সামনে গিয়ে আমাদের ঝামেলা হতে পারে। তাই আর কি করা, আমাদের ছেলেরা নেট দেখে দেখে উনার সাথে দর নিয়ে কষাকষি করতে লাগলো। সবশেষে পার হেড ৮০ টাকার কন্টাক্টে সব কিছু দফা হলো। এরপর উনি আমাদের সামনে এসে বিশাল এক লেকচার দিলেন। অনেক হাবিজাবি কথার মধ্যে জানালেন, এখানে জাহিদ হাসান আর মৌকে তিনি ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। ফতেহপুর সিক্রিতে মুঘলই আজম, পরদেশ, মেরি ব্রাদার কি দুলহান, যোধা আকবরসহ আরও অনেক সিনেমার শুটিং হয়েছে। এখানে সেলিম চিশতীর মাজারে গিয়ে অর্থ কড়ি/থালা ভর্তি জিনিস দান করলে মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। এইসব শিরকী কথা শুনতে শুনতে আমাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। সব শেষে উনি বললেন, ‘আগার ফতেহপুর নেহি হো তো জাহাঙ্গির নেহি হোতা, আগার জাহাঙ্গির নেহি হো তো শাহজাহান নেহি হোতা, আগার শাহজাহান নেহি হো তো তাজ নেহি হোতা’। আমরা ফতেহপুরের এই ‘বিশাল মাহাত্ম’ বুঝেই বাস থেকে নেমে গেলাম। আড়চোখে একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগলাম- কার পাল্লায় পড়লাম কে জানে?

আমরা বাস থেকে নেমে গেট দিয়ে ঢুকে এক জায়গায় গেলাম। সেখান থেকে আরেকটা বাসে করে ফতেহপুরের গেটে নামলাম। গাইড আমাদের যা বললো তা হলো অনেকটা এরকম, আকবরের কোন উত্তরাধীকার ছিলো না বলে তিনি দরবেশ সেলিম চিশতের কাছে দোয়া নিতে আসেন। সেলিম চিশতের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন এবং এই ফতেহপুরে আকবরের পুত্র সেলিম বা জাহাঙ্গিরের জন্ম হয়। এরপর সেলিম চিশতকে দেওয়া কথা অনুযায়ী আকবর এখানেই রাজধানী স্থাপন করেন। তখন ১২ বছর ধরে সম্পূর্ণ রেড স্যান্ডস্টোনে তৈরি করা হয় এই ফতেহপুর সিক্রি। কিন্তু এরপর এখানে আকবর মাত্র কয়েক বছর থেকেই চলে যান লাহোরে। আমরা সবার আগে দেখলাম দিউয়ানে আম। সবুজ মাঠের এক পাশে আকবরের বসার জায়গা, আর প্রজারা সবাই বসতো খোলা মাঠে। এরপর ভিতরে ঢুকে দেখলাম দিউয়ানে খাস- সেই এক কলাম ওয়ালা মহল। ৩৬টা ব্রাকেটওয়ালা এই মোটা কলামটা পুরোটা জুড়েই পাথর খোদাই করে কারুকাজ করা। জৈন ধর্মের অনুপ্রেরনায় সেই কারুকাজ দেখে আমার চোয়াল ঝুলে পড়লো। কলামের ঠিক উপরে আকবরের বসার জায়গা। আর তারপাশের ব্রিজগুলোতে আকবরের মন্ত্রীরা বসতো।

দিউয়ানে খাসে সবাই লাইন ধরে ঢুকছে
দিউয়ানে খাসে সবাই লাইন ধরে ঢুকছে

আঁখ মিচাউলি বা কোষাগার দেখলাম। এটা আগে নাকি আকবরের রানীদের সাথে লুকোচুরি খেলার ঘর ছিলো। পরে এটা কোষাগার হয়ে যায়। এটা জৈন মন্দিরের অনুপ্রেরনায় বানানো মোটামুটি ছোট্ট ভবন যার দেওয়ালে ছোট ছোট খোপ খোপ করা। এগুলোতে নাকি ধন রত্ন থাকতো। মনে হলো একটু খুঁজে দেখি যদি দুই একটা হীরা মোতি পেয়েই যাই! তারপর দেখলাম পাঁচ মহল। পাঁচ তলার এই স্ট্রাকচারটা হয় মেয়েদের জন্য বানানো হয়েছিলো। নিচ তলায় সম্ভবত বাচ্চারা লেখাপড়া করতো। এর পাশেই আছে পানির ওপর অনুপ তালাও। এখানেই তানসেন গান গাইতো আর তার চারপাশে রয়াল লোকজনরা বসে উপভোগ করতেন। তারপর ছোট্ট একটা পাথরের বাথটাব দেখলাম। এটা নাকি কোন এক রানীর, সম্ভবত যোধার। এরপর ছোট্ট একটা ঘর যার নাম হুজরা এ অনুপ তালাও। এখানে হয়তো আকবরের কোন এক রানী থাকতো।

আকবরের নবরত্ন তানসেনের অনুপ তালাও, পানির ওপরের এই মঞ্চেই তানসেন গান গাইতো আর চারপাশে বসে রাজ পরিবারের লোকেরা তা উপভোগ করতো
আকবরের নবরত্ন তানসেনের অনুপ তালাও, পানির ওপরের এই মঞ্চেই তানসেন গান গাইতো আর চারপাশে বসে রাজ পরিবারের লোকেরা তা উপভোগ করতো

তারপর দেখলাম দিউয়ান খানা, পাচিসি কোর্ট- যেখানে খেলাধূলা হতো। খাব গাও, আবদার খানা, যোধা বাঈয়ের রান্নাঘর, বিরবলস হাউস এই সব দেখতে দেখতে টের পেলাম সবাই বাসে ওঠার জন্য ডাকাডাকি করছে। সবাই মনে হলো চলে গেছে। আমি একা একা ঘুরতে ঘুরতে যোধা বাঈয়ের প্যালেসে গিয়ে ইশতিয়াককে পেলাম। এই সেই প্যালেস যেখানে সামার প্যালেস আর উইন্টার প্যালেস দুইটা আলাদা সিজনে থাকার জন্য আলাদা মহল আছে। আর আছে যোধার জন্য ছোট্ট একটা মন্দির। কোনমতে এই প্যালেস দেখে আমি আর ইশতিয়াক দৌড় দিলাম। ততক্ষনে সবাই বাসে উঠে গেছে। আমি আর ইশতিয়াক উঠতেই বাস ছেড়ে দিলো। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো এখানে বাসের কোন দরকারই নেই। দালাল টাইপের লোকগুলা ইচ্ছা করেই আমাদের জন্য এরকম বাসের ব্যবস্থা করেছে।

তারপর এখান থেকে আমরা বাসে উঠে রওয়ানা দিলাম জামে মসজিদের দিকে। একটা কমপ্লেক্সের ভিতর চারদিকে মসজিদ আর মাঝখানে খোলা জায়গায় মুঘল রাজ বংশের সদস্যদের কবর। এর মধ্যে সাদা রঙের মার্বেলের জালি দেওয়া একটা ঘরের ভিতর সেলিম চিশতির কবর। এখানে ঢোকার আগে সেই লিডার টাইপের লোকটা আমাদের বলতে লাগলো, সেলিম চিশতের মাজারে গিয়ে আগর বাতি জ্বালাতে, টাকা পয়সা দান করতে আর থালা ভর্তি জিনিসপত্র দিয়ে আসতে। আমি ওনাকে গিয়ে বললাম মসজিদে মেয়েদের নামাজ পড়ার জায়গাটা কোথায় সেটা দেখিয়ে দিতে। লোকটা বেশ হতাশ হয়ে বললো মাজারে আগরবাতি জ্বালাবেন না? আমি না উত্তর দিতেই উনি বললো মেয়েদের জন্য আলাদা জায়গা নাই, যেখানে ইচ্ছা নামাজ পড়তে পারি। আমি তাড়াতাড়ি করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে ফেললাম। পরে দেখলাম আমাদের লোকজন অনেকেই মাজারের ভিতরে ঢুকেছে, সবাই একবার চক্কর দিয়ে বের হয়ে আসলো। সীমান্তকে দেখলাম থালা নিয়ে ভিতরে ঢুকতে। আমরা অনেকেই বাইরে বসে ছিলাম। আশেপাশে আজগুবি লোকজন ঘুরতে লাগলো আর এমনভাবে ভিক্ষা চাইতে লাগলো যেন তাদেরকে টাকা পয়সা দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ছোট ছোট বাচ্চারা ঘুরতে লাগলো আশেপাশে আর বলতে লাগলো, ‘এক শায়েরি বাতাউ?’। অনুমতি দিলে খুব সুন্দর করে ছন্দ মিলিয়ে শায়েরি বলতে লাগলো। আমরা সব শেষে বুলন্দ দরোয়াজায় গিয়ে বসলাম।

রাজকীয় বুলন্দ দারওয়াজা
রাজকীয় বুলন্দ দারওয়াজা (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

দি ম্যাজেস্টিক বুলন্দ দরোয়াজা। ভূমি থেকে ৫৫ মিটার উপরে অবস্থিত এই গেট হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত গেটওয়ে। আমরা অনেক্ষন সেখানে বসে ছিলাম। তারপর এক লোককে দেখলাম ফল কেটে বিক্রি করতে। আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম ফল খাওয়ার জন্য। ওনার পেপেটা কড়া মিষ্টি ছিলো। আমরা সবাই মিলে সব গুলো পেপে খেয়ে শেষ করে দিলাম। বাকি সব ফলও প্রায় শেষ করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। এরপর এক জায়গায় এসে আমি তমা, আফরা, রিজভী, ইশতিয়াক আর জেরিন মিলে বাউন্ডারি ওয়ালের কাছাকাছি একটা কেমন যেন পাহারাদারের দাড়ানোর মতন জায়গায় বসে অনেক্ষন গল্প করলাম। সেখান থেকে দেখলাম আকবরের প্রিয় হাতির স্মরণে বানানো টাওয়ার যাকে বলা হয় হিরা মিনার। মনে মনে ভাবলাম, আকবরের হাতি হয়ে জন্মালেও আজকে আমার স্মরনে টাওয়ার বানানো হতো। আবার সবাই ডাকাডাকি করতেই আমরা নেমে পড়লাম। গোয়েল থেমে আছে সেই হিরা মিনারের নিচে। সবাই বাসে উঠে পড়লাম। সেই দালালগুলোকে সহ আমাদের বাস চলতে শুরু করলো। আমরা সবাই ৮০ রুপি করে বের করে দিলাম। গোয়েলকে নিয়ে তারা থামালো এক ঝাঁ চকচকে হোটেলে। সব সাদা চামড়া টুরিস্টরা ছাতা দেওয়া টেবিলের বসে লাঞ্চ খাচ্ছে। হোটেল দেখেই আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। এত দামি হোটেলে আমরা খেতে পারবো না সেটা বাইরে থেকেই দেখে বোঝা গেলো।

আমাদের দালাল গ্রুপ সেখানেই আমাদের থেকে বিদায় নিলো। আমরা যাত্রা শুরু করলাম জয়পুরের উদ্দেশ্যে। দুপুর পার হয়ে বিকাল হয়ে যেতে লাগলো। কোথাও খাওয়ার জন্য থামা দরকার। ড্রাইভার রাস্তার পাশে এক ধাবায় থামালো। পুরাই টিপিকাল ধাবা। কয়েকটা খাটিয়া আছে বসার জন্য। আর একটা টিনের ঘর, সেখানে সারি সারি চকচকে ডেকচি সাজানো। আমরা গিয়ে ডেকচিতে উঁকি মেরে দেখলাম সেগুলো প্রায় সব গুলোই পরিষ্কার খালি ডেকচি রেখে দেওয়া হয়েছে সৌন্দর্যের জন্য। খাবারের মেনু দেখে আমাদের সুবিধার মনে হলো না। আমরা আবার বাসে উঠে রওয়ানা দিলাম। এরপর খানিক পরে আরেকটা ধাবায় গিয়ে থামলাম। সেটারও প্রায় একই অবস্থা। আমাদেরকে জুবায়ের বললো যে এই এলাকায় এর চেয়ে ভালো খাবার পাওয়া যাবে না। তাই এখানে যা আছে সেটাই কষ্ট করে খেয়ে নেওয়া ভালো। ওরা কথা বলে সবার জন্য ৫০ রুপিতে ডাল, সবজি আর দুইটা করে রুটি অর্ডার দিলো। আমরা কড়া রোদের মধ্যে খাটিয়ায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অনেকে আবার বাথরুমের খোঁজ করতে গেলো। বাথরুমের সন্ধান পেয়ে আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। চারটা বাঁশ পুঁতে তাতে সিমেন্টের বস্তা দিয়ে ঘিরে বাথরুম বানানো হয়েছে। আমরা সব দেখে টেখে চরম ভয় পেয়ে গেলাম। জুবায়ের আমাদেরকে আরও বলতে লাগলো ‘এখন থেকে শুরু হবে ওয়াইল্ড সেভেন ডেজ’। যাই হোক যখন আমরা রোদে পুড়ে খাক হয়ে গেলাম তখন আমাদের খাওয়া আসলো। রুটিগুলা একদম পোড়া, বিস্বাদ মটর দেওয়া সবজি আর পানসে ডাল। মুখে দিয়েই টের পেলাম অনেক ঝাল। আমি একটু চিনি চেয়ে নিলাম। অনেক কষ্টে একটা রুটি চিনি দিয়ে খেলাম। আর কিছু খেতেই পারলাম না। অনেকে আবার লাচ্ছি অর্ডার দিলো। আমার আর কোন কিছু খাওয়ার প্রতি রুচি ছিলো না। আমি কোনমতে হাত ধুয়ে গোয়েলে উঠে বসলাম। তারপর সবাই একে একে বাসে উঠার পর দেখা গেলো উনারা বলছে আমরা নাকি চার গ্লাস লাচ্ছির দাম দেই নাই। অনেক্ষন ধরে গবেষনা করেও বিল দেয় নাই এরকম কাউকে পাওয়া গেলো না। অগত্যা সীমান্ত ১২০ রুপি গচ্চা দিলো।

efd
সত্যিকার ধাবাতে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় আরমিন রহমান মৌলি)

বাস চলতে শুরু করলো। দুপাশে সব গ্রামের দৃশ্য। সবুজ খেত। কোন ঘরবাড়ি নাই। এক সময় সন্ধ্যা নেমে আসলো। অন্ধকার হয়ে গেলো চারদিক। সবাই চুপচাপ হয়ে গেলে এক পর্যায়ে আমি পাশের রোতে বসে থাকা ইশতিয়াকের সাথে বাংলাদেশ আর ইন্ডিয়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম। আমাদের কথায় দুই দেশের  ট্রান্সপোর্ট, আর্কিটেকচার, খাওয়া দাওয়া এই সব উঠে আসতে লাগলো। খাওয়া দাওয়া প্রসঙ্গ আসতেই মিষ্টির কথা উঠলো। টাঙ্গাইলের ছেলে ইশতিয়াক আমাদের দেশের মিষ্টি আর ইন্ডিয়ার মিষ্টির চুলচেরা বিশ্লেষন আমাকে বুঝাতে লাগলো। আমাদের দেশের মিষ্টির সাথে ওদের দেশের মিষ্টির পার্থক্য আমি ইশতিয়াকের কথায় পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। মিষ্টি পর্ব শেষ করে আমরা অন্য খাওয়া দাওয়ার কথা তুলতেই পিছন থেকে কে একজন ধমক লাগালো, ‘উফ, তোরা থামবি? কতক্ষন ধরে এই দুইটা খাওয়া দাওয়ার কথা বলতেসে। খবরদার আর যদি বলসিস এই খাবার দাবার নিয়ে কথাবার্তা……’। দেখলাম অনেকেই এতে সমর্থন জানালো। বুঝলাম একে তো দুপুরে বিশ্রি খাবার খেয়ে সবার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে, তার উপর অনেকদিন ধরে গরম ভাতের সাথে আলু ভর্তা, ডালের মত টেস্টি খাবার গুলাকে আমরা সবাই মিস করছি। তাই আমাদের খাবার দাবার নিয়ে আলোচনা কেউ সহ্য করতে পারছে না। কি আর করা, আমাদের ইন্টারেস্টিং আলোচনা সেখানেই শেষ হয়ে গেলো।

এর মধ্যে এক পেট্রোল পাম্পে আমাদের বাস থামল। আমরা সবাই নেমে বাথরুমে গেলাম। মোটামুটি পরিষ্কার বাথরুম কিন্তু বদনা নাই। আমি বাস থেকে খালি বোতল নিয়ে আসলাম। তারপর সবাই সেই বোতল নিয়ে বাথরুমে গেলো। তারপর পাশেই এক দোকান থেকে সবাই চা অর্ডার দিয়ে আগুনের কুন্ডুলির চারপাশে চেয়ার নিয়ে বসলাম। ওদিকে পেট্রল পাম্পের লোকজন অভিযোগ জানালো যে আমরা কোন পেট্রোল নেই নাই অথচ তাদের বাথরুম ব্যবহার করেছি, এটা তো ঠিক না। এমন অভিযোগ শুনে আমরা কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। পরে সবাই ১০ রুপি করে দিয়ে আসি উনাদের হাতে। তারপর আবার বাসে উঠি, এবং যথারীতি গোয়েল চলতে থাকে।

প্রায় রাত ৮টার দিকে আমরা জয়পুরে প্রবেশ করি। রাস্তার দুপাশে ঝকমকে উঁচু দালান আর ঝাঁ চকচকে শপিং মলের সারি দেখে আমাদের মুখ হাঁ হয়ে যায়। এত দামী জায়গা জয়পুর শহর- আমার জানা ছিলো না। আমরা রাস্তার দুপাশে বড় বড় চোখ করে দেখতে থাকি। শপিং মল ছাড়াও আরও একটা জিনিস আমাদের চোখে পড়লো আর সেটা হলো বিয়ে।  কমসে কম হলেও ১২-১৫টা বিয়ের আসর আমাদের চোখে পড়লো। খোলা মাঠ প্যান্ডেল টানিয়ে, অনেক বিশাল জায়গা জুড়ে লাইটিং করে বিয়ে গুলো হচ্ছিলো। দেখে আমাদের বুঝতে কষ্ট হলো না যে এ সবই ধনকুবেরদের অনুষ্ঠান। আমাদের অনেকেই তো ঠিক করে ফেললো যে রাতে কোন একটা বিয়ে বাড়িতে ঢুকে খেয়ে আসবে।

আমাদের জন্য কমিটির লোকজন হোটেল ঠিক করলো ‘রঘুরাজ প্যালেস’। খুব সুন্দর হোটেল। আমরা রুম পেলাম দোতলায়। চমৎকার রুম, ঝকঝকে বাথরুম। রুম পছন্দ হওয়ায় আমরা আবার গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করলাম আর সাথে তাল মিলিয়ে নাচতে লাগলাম। প্রায় সাথে সাথেই নিলয় দরজা নক করে বলে দিলো বেশি গান বাজনা না করতে, কারণ আশেপাশে নানা রকমের মানুষজন আছে। সো চুপচাপ থাকাই ভালো। ওর কথা শুনে আমরা থেমে গেলাম। এর মধ্যে মিমকে আমাদের রুমে পাঠানো হলো থাকার জন্য। আমরা রুম সার্ভিসে খাবার অর্ডার দিলাম ম্যাগী মাঞ্চুরিয়ান। তারপর নিচে নেমে ডাইনিঙে খেতে বসলাম শুধু পানি আর মশলা দিয়ে সিদ্ধ করা এক বাটি নুডুলস। খেয়ে দেয়ে আবার আমরা রুমে ফেরত আসলাম। ডাবল বেডে পাঁচজন মানুষকে শুতে বেশ কসরত করতে হলো। তারপরও শোয়ার প্রায় সাথেসাথেই সবাই গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *