The Mighty INDIA CALLING: গান্ধী মেমোরিয়াল, ল’ গার্ডেন, মুভি দেখা এবং কমিটির গ্র্যান্ড ডিনার (পর্ব ২৪)

বেসমেন্টে রুমে থাকার একটা সমস্যা হলো দিন রাতের পার্থক্য বুঝতে না পারা। কি সকাল, কি দিন, কি রাত- সবসময় একই রকম অন্ধকার থাকে রুমটা। অন্ধকার রুমে যখন ঘুম ভাংলো তখন দেখলাম সাড়ে নয়টা বাজে। তাড়াহুড়া করে উঠে আমরা ফ্রেশ হয়েই রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। তারপর টের পেলাম শুধু আমরা না, কেউই এখনো পর্যন্ত রেডি হয় নাই। তারমানে সবারই রওয়ানা দিতে বেশ দেরি হবে। এই হোটেলে না খেয়ে ভাবলাম আসেপাশে ঘোরাঘুরি করে খাওয়াদাওয়া করি।

আমি আর রুবাইদা বের হয়ে ডান দিকে হাঁটতে লাগলাম। হোটেলের একটু পাশেই একটা মুসলমান হোটেল পেলাম যেখানে হালাল মাংস পাওয়া যাচ্ছিলো। আমরা সেখানে বসে পড়লাম। আমি অর্ডার দিলাম ৩ রুপি করে দুইটা নান রুটি আর ৩০ রুপির খাসির কোরমা। কোরমা বললেই আমাদের চোখে যেমন সাদা রঙের ঘন দুধের ঝোলের তরকারি ভেসে ওঠে, এই কোরমা সেই রকম নয়। এটা তেল দেওয়া লাল টকটকে রঙের মসলাদার ঝোলওয়ালা খাসির মাংসের তরকারি। আমি ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই রুবাইদা বললো নতুন ধরনের এই ‘কোরমা’টা উচ্চবাচ্য না করে খেয়ে ফেলতে। আমি খেয়ে দেখলাম খেতে বেশ মজা তবে একটু ঝাল। আমরা তৃপ্তি করে খেলাম। আহমেদাবাদে খাওয়া খরচ আসলেই কম। খাওয়া দাওয়া করতে করতেই আমরা আলোচনা করছিলাম কেমন করে কোথায় যাব। খাওয়া দাওয়া শেষ করে হাঁটতে লাগলাম আমাদের হোটেলের দিকে। আমার বেশ ঝাল লাগছিলো আর পানি খাওয়া হয় নাই বলে একটা স্লাইস কিনে খেলাম আমি। এর মধ্যে মিম আর অন্তরা এসে পড়লো। আমরা চারজনে ঠিক করলাম যাবো ‘গান্ধীর সবরমোতি আশ্রম’। আগের দিনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভাবলাম অনেক তো অটো হলো- এইবার বাসে করে যাই।

আহমেদাবাদে আসার পর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম এখানকার রাস্তাগুলো একটু অদ্ভূত। রাস্তাগুলো ডিভাইডার দিয়ে চারভাগে বিভক্ত। খালি দুইপাশের লেন দুইটা দিয়ে গাড়ি ঘোড়া চলে। মাঝের লেন দুইটা দিয়ে কি হয় খেয়াল করি নাই। বাসের টিকেট কাটতে গিয়ে টের পেলাম মাঝের দুইটা লেন শুধুই বাসের জন্য। আর এই বাসের নামই ‘বি আর টি এস’। আমরা টিকেট কাউন্টারে গিয়ে বললাম গান্ধীর সবরমোতি আশ্রম যেতে চাই। ওরা আমাদের ২৮ টাকা করে ‘আর টি ও রোড’ এর টিকেট কেটে দিলো। আমরা টিকেট নিয়ে ওয়েটিং এ বসে রইলাম। বেশ দৃষ্টি নন্দন ছিলো যাত্রী ছাউনিটা। আমরা বসে বসে দেখতে লাগলাম হুউউশ করে একেকটা বাস এসে থামছে, কয়েক সেকেন্ড পরই আবার হুউউশ করে বের হয়ে যাচ্ছে। আমরা তক্কে তক্কে থাকলাম আমাদের নির্দিষ্ট নম্বরের বাসের জন্য। এক সময় আমাদের কাংখিত বাস আসলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দরজাটা খুললো, আর অন্য অনেক মানুষের সাথে আমরা চার জন হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম। ওঠার প্রায় সাথে সাথেই ঠাস ঠাস করে দরজাটা অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেলো। আর প্রচন্ড বেগে আমাদের বাস চলতে শুরু করলো। ভীড়ের জন্য আমরা বসার কোন জায়গাই দেখতে পাচ্ছিলাম না। কোন কিছু হাত দিয়ে ধরার আগেই বাস ছেড়ে দেওয়ায় আমরা তাল সামলাতে না পেরে একজন অন্যজনের উপর হেলে পড়লাম। এর মধ্যে মিম উপরে ঝুলতে থাকা একটা খালি হাতল কোনমতে ধরে ফেললো। আমি কোন কিছু ধরতে না পেরে শেষমেষ মিমকেই দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। এই ভীড়ের মধ্যেই মিমের হাতে চপচপে তেল দেওয়া এক লোকের চুল ঘষা খাচ্ছিলো। মিম বেশ বিরক্ত হলো কিন্তু কিছু বলার উপায় নাই।

আলোর গতিতে আমাদের বাস চলতে লাগলো। যেহেতু এটা শুধু বাসেরই লেন তাই সামনে অন্য কোন গাড়ি বা ওভারটেকিং এইসব ব্যাপার নাই। প্রচন্ড গতিতে চলতে থাকা বাসটা কেবল স্টপেজ আর মোড় আসলেই হার্ড ব্রেক কষে, আর সারা বাসে শুধু আমরা চার জনই তাল সামলাতে না পেরে ঢলে কাত হয়ে যাই। বাস একেক স্টপেজে থামে আর অল্প কিছু মানুষ নামে, বেশিরভাগই ওঠে। এমনিতেই ভেতরে কোন জায়গা নাই, কিন্তু এটা নিয়ে কারও কোন চিন্তা আছে বলে মনে হলো না। হেল্পার ছাড়াই বাসে দিব্যি লোকজন ঠেলাঠেলি করে ঊঠতে লাগলো। ভীড়ের মধ্যে অন্তরাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। রুবাইদাকে দেখতে পেলাম সবচেয়ে অসুবিধায় আছে। কোন খালি জায়গা না পেয়ে ও বাসের দরজার সামনের খালি জায়গাটুকুতে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবার বাস স্টপেজে থামে আর অটোমেটিক ফোল্ডিং দরজাটা খোলার সময় প্রথমেই রুবাইদা ঠাস ঠাস করে বাড়ি খায়। তারপর দলে দলে মানুষজন ওকে ধাক্কা মেরে বাসের ভিতরে ঢুকে। তারপর আবার দরজা বন্ধ হলে ও সামনের সেই ফাঁকা জায়গাটাতে দাঁড়ায়। ওর অবস্থা দেখে মায়াই লাগলো।

ইন্ডিয়ার একেক রাজ্য একেক উপায়ে তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশোন সমস্যা সমাধান করে রেখেছে। এর মধ্যে আহমেদাবাদের বি আর টি এস বাস সার্ভিসটা খুবই ইউনিক মনে হলো। বাসের ভেতরের দৃশ্য দেখলে যে কারও এটাকে মেট্রো মনে করে ভুল হতে পারে। মেট্রোর মতনই বসার সিট খুবই কম। দাঁড়ানোর জায়গাই বেশি। আর একটু পর পর যান্ত্রিক কন্ঠে অ্যানাউন্সমেন্ট বাজছে ‘ ধেয়ান দিজিয়ে, আগলা স্টেশন অমুক অমুক-’ ঠিক যেন মেট্রোর মত। ভিড়ের মধ্যে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ একটা স্টপেজ আসলো আর বাসের অর্ধেক লোক নেমে গেলো। আমরা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাস এতই ফাঁকা হয়ে গেলো যে আমরা বসার সিটও পেয়ে গেলাম! অবশ্য বেশিক্ষণ বসতে না বসতেই আমাদের স্টপেজ আর টি ও রোড চলে আসলো। আমরা তাড়াতাড়ি করে নেমে পড়লাম। আমাদের নামিয়ে দিয়েই বাস হুউউশ করে চলে গেলো।

গুগল ম্যাপে দেখলাম যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে আশ্রমটা খুব দূরে নয়, হেঁটেই যাওয়া যায়। কিন্তু এই বাস জার্নি শেষে কারও গায়ে আর কোন শক্তি নেই। তাই আমরা ২০ রুপি দিয়ে একটা অটো ভাড়া করলাম আশ্রম পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। অটো আমাদের আশ্রমের গেটেই নামিয়ে দিলো। আমরা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। খুব সুন্দর শান্তি শান্তি পরিবেশ। চার পাশে সবুজ গাছপালা, ঝলমলে রোদ আর হাজারো পাখির কিচিরমিচির। ঢুকতেই সবার মন ভালো হয়ে গেলো।

প্রথমে গেলাম গান্ধী স্মারক সংগ্রহালয়ে। এটা একটা ছবির মিউজিয়াম। মহাত্মা গান্ধীর পুরো জীবন ও আদর্শ ধারাবাহিকভাবে সাদাকালো ছবির মাধ্যমে উঠে এসেছে। চার্লস কোরেয়ার ডিজাইন করা ইট আর কনক্রিটের তৈরি এই মিউজয়ামের প্রদর্শনীর কিছু অংশ সেমি আউটডোর অর্থাৎ খোলা বারান্দার মত জায়গা, কিছু অংশ ইন্ডোর অর্থাৎ রুমের ভেতর। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম সব কিছু। মাঝে মাঝে দেখা হতে থাকে সীমান্ত, ইশতিয়াক, হিমি, নিশাত, তমা রিন্তু, সুহাইলা, নিলয়দের সাথে। পুরো প্রদর্শনী ঘোরা শেষে আমরা ঢুকি সুভেনিয়র এবং বুক শপে। সেখানে অনেকেই অনেক কিছু কিনলো। বাচ্চাদের জন্য গান্ধীর কমিক্স থেকে শুরু করে গবেষণা পত্র পর্যন্ত সব কিছুই পাওয়া যাচ্ছিলো। সুন্দর সুন্দর কলম, চাবির রিং, পেন ড্রাইভ, পোস্ট কার্ড, ঘড়ি অনেক কিছুই ছিলো। আমি ৫০ রুপি দিয়ে বাংলায় অনুদিত গান্ধীর আত্মজীবনী কিনলাম। সব শেষে মিউজয়াম থেকে বের হয়ে গেলাম।

দচ
‘My Life Is My Message’ – M.K Gandhi (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম দিশা)

এরপর গেলাম গান্ধীর বাড়ি দেখতে। সবরমোতি নদীর পাশে খুব সাধারন একটা কুটির। আমরা স্যান্ডেল খুলে ভিতরে ঢুকলাম। এত শান্তি লুকিয়ে আছে এই ছোট্ট কুটিরে বাইরে থেকে দেখে বুঝতে পারি নাই। প্রত্যেকটা জানালার সবুজ প্রাকৃতিক ক্যানভাস আর প্রাণ জুড়ানো মিষ্টি বাতাস মনের মাঝে ধীরতা, স্থিরতা আর প্রশান্তির উদ্রেক করে। দেখলাম গান্ধীর চরকা, অতি সাধারণ বসার আসন, গান্ধীর ব্যবহার্য সাধারণ জিনিসপত্র, ঘুমানোর জন্য সুতায় বোনা খাটিয়া। এক ঘর থেকে বারান্দা দিয়ে আরেক ঘরে যেতে লাগলাম আমরা। কি সাধারণ এই ঘর গুলোতে অসাধারণ সব মানুষজন এসেছিলেন…….. কতই না সামান্য সাধারণ ছিলো তাদের জীবন……………. অথচ কতই না বড় মাপের হৃদয় ছিলো তাদের………। আমরা এখান থেকে বের হয়ে খানিক্ষন বসলাম সবরমোতী নদীর তীরে। প্রচন্ড কড়া রোদে অবশ্য আমরা বেশিক্ষণ ওখানে দাঁড়াতে পারলাম না। অল্প কিছুক্ষনের জন্যই দেখলাম টলটলে পানির সবরমোতি নদীকে। আমাদের বুড়িগঙ্গার মত এই নদীর দুই পারেও শহর। কিন্তু তারপরও কত সুন্দর অবস্থা এই নদীটার! আর আমাদের বুড়িগঙ্গা- থাক সে কথা আর নাই বা বলি।

আমরা দর্শনার্থীদের জন্য তৈরি বাথরুমে গেলাম। এখানকার বাথরুমটাও ভারি সুন্দর। অনেক চওড়া, প্রশস্থ আর আলোবাতাস পূর্ণ। আমরা খুব খুশি মনে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। একবার নয়- বেশ কয়েকবার! ফুরফুরে মনে এখান থেকে বের হয়ে আসলাম আমরা। এরপর অটো ঠিক করলাম আমরা- যাবো ‘ল গার্ডেন’।

অটোওয়ালা আমাদের নামিয়ে দিলো শহরের মধ্যে এক জায়গায়। সামনে হাত তুলে দেখিয়ে দিলো ‘ল গার্ডেন’। ল গার্ডেন একটা ছোট্ট পার্ক। এর বাইরের ফুটপাথের দুইপাশ জুড়ে সারি সারি দোকানপাট। আমরা ঠিক করলাম আগে খেয়ে নেই, তারপর ঘোরাঘুরি করা হবে। রুবাইদা গেলো স্ট্রিট ফুডের দিকে আর মিম ও অন্তরার সাথে আমিও ঢুকলাম ডমিনাস পিৎজাতে। কিন্তু ভেজ পিৎজা শেয়ার করার পার্টনার নাই বলে আমি বের হয়ে আসলাম ওখান থেকে। বের হয়ে রুবাইদাকে খুঁজতে লাগলাম। দেখি ও কাগজের বাটিতে করে মিহিদানা বা বুন্দিয়ার মত কি এক অদ্ভূত জিনিস খাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করতেই ও বললো, এই জিনিসের নাম ওকে খিচুড়ি বলেছে। কিন্তু এটা হচ্ছে মশলা দিয়ে রান্না করা সাগুদানা। জিনিসটা খেতে মোটেও ভালো না। রুবাইদাকে দেখলাম বিরস বদনে ‘খিচুড়ি’ চিবিয়ে যাচ্ছে। রুবাইদার খাওয়া শেষে আমরা দুইজনে হেঁটে হেঁটে যেতে লাগলাম সেই ফুটপাথের দোকানপাটগুলোর দিকে।

সারি সারি দোকানপাট। সেগুলোতে ভর্তি গুজরাটি কাজ করা জামা কাপড়, জুয়েলারি, জয়পুরি স্যান্ডেল, ওয়ান পিস- এইসব জিনিস। গুজরাটি লেহেঙ্গা চোলিগুলোতে বড় বড় কাঁচের টুকরা বসানো, অনেক রঙের কাপড় জোড়া দিয়ে বানানো- চোখ ধাঁধাঁনো ঝকমকে। আমার চোখে কল্পনায় জয়পুরকে আমি এরকমই ভেবেছিলাম। এই রকম দেখলাম এসে গুজরাটে। আমরা এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটতে লাগলাম। আমার দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। একেবারে ল গার্ডেনের শেষে রাস্তার উল্টা পাশে একটা বড় শপিং মলের নিচে অনেকগুলো ফাস্টফুডের দোকান দেখে আমি থেমে গেলাম। সবগুলো দোকান দেখে শেষ পর্যন্ত একটা দোকানে ঢুকে ৬০ রুপি দিয়ে ভেজ বার্গার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর কোক খেয়ে নিলাম। খেয়েদেয়ে আমরা আবার হাঁটতে লাগলাম। আশেপাশে অসংখ্য দোকান কিন্তু সব দোকানেই প্রায় একই জিনিস। আমরা এই গলি ছাড়িয়ে অন্য গলিতে ঢুকে পড়লাম। কিছুদূর হেঁটেই সন্ধান পেলাম ‘তক্ষশীলা’র। ‘তক্ষশীলা’ একটা চমৎকার বইয়ের দোকান। ভেতরে ঢুকেই আমাদের মন ভালো হলে গেলো। দারুন সুন্দর সুন্দর বই। ঝকঝকে সব বইয়ের মধ্যে এনিড ব্লাইটনের অনেক অনেক বই, ন্যন্সি ড্রিউয়ের ফুল কালেকশন আর হ্যাঁ- যেটার কথা কোনদিনই ভুলবো না সেটা হচ্ছে তিন বাক্স টিনটিনের অরিজিনাল ফুল সেট যার দাম ৮০০০ রুপি। নীল বাক্স থেকে একটা টিনটিন বের করে হাতে নিয়ে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পৃষ্ঠাগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম- পুরা মাখনের মত, ঝকঝকে ছবিগুলা আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করতে লাগলো- কিন্তু কিছুই করার নাই! সবগুলা টিনটিন সেই বাচ্চাকাল থেকেই আমার বাসায় আছে, এই সেট কেনার কোন অর্থই হয় না। কিন্তু তারপরও আমার মন আঁকুপাকু করতে লাগলো। শেষমেশ সবার তাড়া খেয়ে আমি বইগুলো ছেড়ে উঠে আসলাম। আমাদের মধ্যে কেবল অন্তরাই ওর ভাইয়ের জন্য ‘টিন ডিটেক্টিভস’ এর মোটা মোটা কমিক্স কিনলো।

আমরা বের হয়েই একে ওকে ফোন দিতে লাগলাম। কারণ আমাদের মুভি দেখার জায়গা এখনও ঠিক হয় নাই। কোন এক ড্রাইভ ইন সিনেমাতে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু সেটা ফাইনাল না। পরে আমরা ফোন দিয়ে জানলাম আমাদের যেতে হবে আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানে- আশ্রম রোডের শিব সিনেমা হলে। আমরা তক্ষশীলার সামনে থেকে ২০ রুপি দিয়ে অটো ঠিক করলাম। সেই অটো করে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের সিনেমা হলের সামনে। ঠিক উল্টা পাশে আরেকটা সিনেমা হল থাকায় একটু কনফিউশন হচ্ছিলো যে কোনটা আমাদের সিনেমা হল, তারপর গিয়ে ঠিকঠাকটাতে গিয়ে হাজির হলাম। সিনেমা শুরু হতেও অনেক্ষন বাকি। আমরা লবিতে দাঁড়িয়ে কয়েকটা সেলফি তুললাম। এর মধ্যেই দেখলাম মাইশা দুই হাত ভরে শপিং করেছে ‘ক্রস ওয়ার্ড’ থেকে। সবই স্টেশনারি। আমরা বেশ উত্তেজিত হয়ে দেখতে লাগলাম ওর জিনিসপাতি। এরই মধ্যে শোর সময় হয়ে গেলে আমরা ঢুকে পড়লাম। সিট বেশ আরামদায়ক আমাদের স্টার সিনেপ্লেক্সের মত। প্রথমে শামিতাভ, তারপর রয়ের ট্রেইলার চললো। তারপর শুরু হলো ‘বেবি’। নাম শুনে ভেবেছিলাম লেইম মুভি হবে বোধহয়। কিন্তু আমার আশংকা ভুল হলো। দারুণ থ্রিলার একটা মুভি- খুবই সুন্দর।

dc
সিনেমা হলে ঢুকার আগে লাউঞ্জে কতিপয় দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় মোজাম্মেল হক জাফর)

মুভি শেষ হতে হতেই কমিটি আমাদের তাড়া দিতে লাগলো। ডিনারের জন্য বুকিং দেওয়া যেই জায়গা, সেখান থেকে ফোন আসছে। দশটার মধ্যে নাকি তাদের অর্ডার নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আমরা সবাই ছুটতে লাগলাম। সারি সারি অটোরিক্সায় টপাটপ উঠে পড়তে লাগলাম আমরা। সবার গন্তব্য প্যারামাউন্ট হোটেল- তিন দরওয়াজা। প্যারামাউন্ট হোটেলে পৌঁছে ৫০ রুপি ভাড়া দিয়ে নেমে পড়লাম। তাড়াহুড়া করে ভিতরে ঢুকে দেখি কোথাও কোন বসার জায়গা নেই, সব কানায় কানায় পূর্ণ। আমরা এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলাম, কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না। তবে ওরা আশ্বাস দিলো যে কিছুক্ষনের মধ্যেই কয়েকটা টেবিল খালি হয়ে যাবে। সত্যি টেবিল খালি হওয়ার সাথে সাথে আমি, রুবাইদা, অন্তরা, মিম, সারা আর সুহাইলা একসাথে বসে পড়লাম। বাকিরাও ফাঁক ফোকর পেয়ে বসে যেতে লাগলো। আমাদের টেবিলে আমরা মিলেমিশে অর্ডার দিলাম- তিনটা প্রন পোলাও, ভেজ আমেরিকান চপ্সুয়ে, মাসালা চিকেন আর সাথে পেপসি। মুসল্মান হোটেল তাই চিকেন অর্ডার দিতে কোনই বাধা রইলো না। আমরা মজা করে খেলাম। রুবাইদা পেপসি অর্ডার দিতে চায় নাই, আমরা এক প্রকার জোর করে ওর পেপসিটা খেয়ে ফেললাম। হাহা হিহি গল্পগুজবের সাথে আমাদের খাওয়া দাওয়া চলতে লাগলো। এক সময় পুরো রেস্টুরেন্ট খালি হয়ে গেলো। শুধু রইলাম আমরা। তবুও যেন আমাদের গল্প শেষ হয় না।

কমিটি সবার বিল দিয়ে দিলো। আমরা যখন ভরপেট খেয়ে ওখান থেকে বের হয়ে আসি তখন বাজে রাত সাড়ে এগারটা। তিন দরওয়াজা পার হয়ে আমরা একটার পর একটা অটো নিতে থাকি। লাইন ধরে সব অটো চলতে থাকে ‘ত্রুপ্তি হোটেল’ এর উদ্দেশ্যে। আর আমরা অটোতে গাদাগাদি করে বসে খোশ গল্প করতে থাকি। হোটেলে পৌঁছানোর পর আমরা শুনি গোয়েল থেকে আমাদের লাগেজ নামানো হবে। সবাই হোটেলের সামনে ভীড় করে দাঁড়াই। এক সময় গোয়েল আসে, আমরা আমাদের লাগেজ টেনে টেনে রুমে নিতে থাকি। লাগেজ খুলে সব জিনিসপাতি গোছগাছ করতে থাকি। আমি আর মজুমদার মনের সুখে ‘আসো না’ গাইছিলাম। হঠাৎ দরজায় নক পড়ায় আমরা চুপ হয়ে যাই। দরজা খুলতেই শুভ উঁকি দিয়ে বললো, ‘মজা লস?’ আমাদের মুখে ওর গাওয়া গান শুনতে পেয়েই ও এসে হাজির হয়েছে।

শুভকে আমরা জানাই ডিনার খেয়ে আমরা ব্যাপক খুশি। আর মজুমদার বলে যে প্রতিদিন ১০০ রুপি ১০০ রুপি করে অ্যালাউয়েন্স দেওয়ার চাইতে আমাদের ব্যাপারগুলা ভালো হচ্ছে। এর আগে মানালির পার্টি, ডেজার্ট নাইট, আজকের মুভি আর ডিনার- এই গুলোই বেশি মজার। শুভ তখন বললো, ‘গোয়াতে গিয়ে এমন সারপ্রাইজ দিবো যে চোখে পানি চলে আসবে’। শুভ চলে গেলে আমরা লাগেজ গুছিয়ে শুয়ে পড়ি। আগামীকাল অনেক ‘শিক্ষনীয়’ জায়গায় যেতে হবে যার নাম CEPT।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *