কুচকুচে কালো ফোর্ডের গাড়িটা দেখে উত্তেজনায় আমার হৃদকম্পন বেড়ে গেলো। আমরা সত্যিই সত্যিই ফোর্ডের গাড়ি ভাড়া করতে যাচ্ছি নাকি! সত্যিই তাই, দোকানের লোকটা যখন গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছিলো- তখনও আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এইদেশে লং জার্নিতে গেলে বেশিরভাগ মানুষ নিজের গাড়ি না নিয়ে ভাড়া গাড়ি নিয়ে যায়। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় যাওয়ার জন্য মাকসিম ভাইও তাই এসেছে গাড়ি ভাড়া করতে। কিন্তু সেগুলো যে ঝাঁ চকচকে ফোর্ডের গাড়ি হবে সেটা আমার কল্পনাতেও ছিলো না।
লেবার ডে উপলক্ষে লং উইকেন্ড থাকায় সবাই মিলে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ট্যুরের প্ল্যান করছিলো। কিন্তু কোন খানে বুকিং না পাওয়ায় প্ল্যানটা ভেস্তে যায়। বরঞ্চ তারপরের সপ্তাহেই ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া যাওয়া হবে ঠিক হয়। আমরা মাত্র এক মাস হয় নর্থ ক্যারোলাইনা এসেছি। ব্যাপার স্যাপার ঠিকমত বুঝিসুঝি না, তাই সবাই যা বলে আমরাও তাতে রাজি হয়ে যাই। অবশ্য তেমন কোন প্রিপারেশন ছিলো না। আমরা শুধু আমাজনে দুই জোড়া ওয়াটার শু অর্ডার দিলাম র্যাফটিঙ্গের জন্য। মোটামুটি ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে আগের দিনই তৈরি হয়ে থাকলাম।
প্ল্যানমত শুক্রবার সাড়ে তিনটার জুম্মার জামাত শেষে রওয়ানা দিলাম আমরা রলে মসজিদ থেকে মাকসিম ভাইদের সাথে। মসজিদ থেকে বের হয়েই আমরা গাড়ি ভাড়া করতে যাই। এবং ঝকঝকে একটা ফোর্ডের গাড়ি ভাড়া করে ফেলি। তমা আপু একবার ট্রায়াল নিয়ে সব কিছু ঠিকঠাক বুঝে নিলো। তারপর আমাদের সমস্ত মালপত্র মাকসিম ভাইয়ের গাড়ি থেকে ভাড়া করা গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে রওয়ানা দিলাম প্রায় বিকাল পাঁচটার সময়।
বিশাল চওড়া হাইওয়ে দিয়ে শাই শাই করে ছুটতে লাগলো আমাদের গাড়ি। আমেরিকার হাইওয়েতে অনেক মজার মজার গাড়ি দেখা যায়। ছোটবেলা থেকেই তিন গোয়েন্দাতে একটা জিনিস পড়তাম ‘ট্রেলার’। এখানে আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে অহরহ ছুটে যাচ্ছে বিশাল বিশাল সব ট্রেলার। আরেকটা মজার জিনিস হচ্ছে অটো ট্রান্সপোর্ট ট্রেলার। ছয়টা থেকে আটটা গাড়ি নিয়ে লম্বা লম্বা সব ট্রান্সপোর্ট ট্রেলার যাচ্ছে। দেখতে খুব মজা! বিশাল চওড়া রাস্তায় দাগ দিয়ে লেন ভাগ করা, তাই ওভার টেকিং নিয়ে কোন কামড়াকামড়ি নাই। যার যার লেনে সে সে ছুটছে। এইসব দেশে গাড়ি চালানো খুব সহজ কাজ বলেই মনে হলো!
এই দেশে রাস্তার দুইপাশে কোন জনমনিষ্যি নাই। প্রথম প্রথম রাস্তার দুই পাশ শুধু ঘাস আর বড়বড় গাছ ছিলো। ধীরে ধীরে টপোগ্রাফি বদলাতে লাগলো। দুই পাশ জুড়ে শুরু হতে লাগলো পাহাড়। শুরু হলো পাহাড়ি রাস্তা। আমরা ধীরে ধীরে উঁচুতে উঠতে লাগলাম। একপর্যায়ে দুই পাশে বিশাল বিশাল পাথুরে পাহাড় ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে পাথুরে হোক আর মাটিই হোক- সব পাহাড়ই সবুজ জঙ্গলে ঢাকা। শেষ বিকালের কমলা রোদে ঝলমলে দেখাচ্ছিলো দুইপাশের দৃশ্যকে। ইতোমধ্যে একটা পাহাড়ের পেটের ভিতর টানেলে ঢুকে পড়লো আমাদের রাস্তাটা। টানেলটার নাম ইস্ট রিভার মাউন্টেন টানেল। বি-শা-ল একটা টানেল। এই পাহাড়ের এক প্রান্তে ভার্জিনিয়া অন্যপ্রান্তে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া। পাহাড় না কেটে পাহাড়টা ফুটো করে রাস্তা বানানো হয়েছে। টানেল পাড়ি দিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত্তবড় পাহাড়টা ফুটো করা- কি অবাক কান্ড!
ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় ঢোকার পর থেকেই পাহাড়ের সাইজ আরও বড় হতে লাগলো। জন ডেনভারের দেশ ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে পড়লো। সূর্যটা আকাশে কমলা রঙ গুলিয়ে দিয়ে কোথায় যেন টুপ করে হারিয়ে গেলো। আর সাথে সাথেই পাহাড়ের দেশে নেমে এলো ঘুটঘুটা অন্ধকার। দুপাশে কিছু দেখা না গেলেও আমরা টের পাচ্ছিলাম যে ঘন জঙ্গল সমেত পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আমরা ছুটে চলছি। ওদিকে গুগল ম্যাপের ডিরেকশন অনুযায়ী আমরা বড় রাস্তা ছেড়ে ছোট রাস্তায় উঠলাম। এইবার রাস্তাটা দেখে আমার একটু শান্তি লাগলো। রাস্তাগুলো চিকন, ঠিক আমাদের দেশের রাস্তার মতন। দুই পাশে এখন পাহাড়ের বদলে একটু আধটু ঘরবাড়ি দেখা যেতে লাগলো। তবে এত দূরে দূরে একেকটা বাড়ি, যে দেখে আমারই ভয় হতে লাগলো। প্রায় একর খানেক জমি নিয়ে একেকটা ঘর। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ হলদেটে আলোর ছটা জানান দিচ্ছে এক আধটা ঘরের অস্তিত্বের কথা। আমার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিয়ে গেলো, এইসব বাড়ির বাসিন্দারা বাজার করে কোথায়?
নানা রকম বাঁকপূর্ণ রাস্তা পার হয়ে রাত নয়টার দিকে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছালাম। গাড়ি থেকে নেমে একটা বিরাট কনফিউশনে পরে গেলাম সবাই। ঠিকানা অনুযায়ী যেখানে এসে থামলাম আমরা, সেখানে সারি ধরে দোতলা তিনতলা কটেজ। কোনটা আমাদের এয়ার বিএনবিতে ঠিক করা কটেজ, এই রাতের বেলায় বাইরে থেকে বোঝার উপায় নাই। সব গুলো দেখতে প্রায় একই রকম। আমি, রাতুল আর তমা আপু হেঁটে হেঁটে গবেষণা করতে লাগলাম। প্রথম দুইটা কটেজ দেখে হেঁটে পার হয়ে গেলাম। কোনটায় কোন মানুষ নাই। সব গুলো কটেজ ফাঁকা। তিন নম্বরটায় গিয়ে আমাদের মনে হলো এইটাই বোধহয় আমাদের কটেজ। আমরা সিড়ি ধরে তিনতলায় উঠে গেলাম। আশে পাশে আতিপাতি করে খোঁজা হলো কোন বাড়ির নম্বর আছে কিনা, কিন্তু কিছুই পাওয়া গেলো না। তারপর যা আছে কপালে ভেবে মেইলে পাঠানো নম্বর দেখে তমা আপু দরজার কম্বিনেশন লক মিলাতে শুরু করলো। আমার মনে হলো এখনই বার্গ্লার অ্যালার্ম বেজে উঠবে আর প্যাঁ প্যাঁ করে শেরিফের গাড়ি এসে হাজির হবে। তারপর ট্রেসপাসিঙের দায়ে আমাদের সবাইকে কোমরে দড়ি বেঁধে হাজতে নিয়ে যাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না, বরঞ্চ খুট করে কম্বিনেশন লকটা খুলে গেলো। আমরা সবাই খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। যাক, পাওয়া গেলো! তিনতলাটা খুলে আমরা দোতলার দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। এবার এই দরজার কম্বিনেশন মিলাতে শুরু করলাম, কিন্তু এইটা কিছুতেই খুললো না। আমরা নানাভাবে চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। আমাদের বুক দেওয়া ছিলো দোতলা আর তিনতলা। এর মধ্যে দোতলাটা বড় আর তিনতলাটা ছোট। একটা তলা না খুলতে পারলে তো বিপদে পড়ে যাবো। ওদিকে দোতলা আর তিনতলার কম্বিনেশনের সিকোয়েন্স অনুযায়ী একতলার লকটা খোলার চেষ্টা করতেই সেটাও খুট করে খুলে গেলো। আমরা মাথা নেড়ে বিকল্প বুদ্ধি করলাম, যদি দোতলা খুলতে না পারি, তাহলে একতলাতেই আস্তানা গেড়ে বসতে হবে!
ওদিকে আমরা গাড়ি থেকে ব্যাগপত্র নামিয়ে তিনতলায় চলে গেলাম। খুব সুন্দর কাঠের কেবিন। ডাইনিং, লিভিং, কিচেনেট, বাথরুম আর বেডরুম। আমি ঢুকে সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এখানে আমরাই সবার আগে এসেছি। অন্যরা এখনও রাস্তায়। আমি আর তমা আপু ডিনারের জন্য বেগুন ভাজবো বলে ঠিক ছিলো। আমিও প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হলো আচ্ছা বেগুন যে ভাজবো- চুলা কোথায়? ভালো মত তাকিয়ে দেখলাম। কিচেনেটের টেবিল টপে কফি মেশিন, টোস্টার, ইলেক্ট্রিক ওভেন সবই আছে- কিন্তু চুলা নাই। তমা আপুকে ডেকে জানালাম ব্যাপারটা। আপু ঠাশ ঠাশ করে সবগুলো ক্যাবিনেটের দরজা খুলে ফেললো, আমি অবাক হয়ে দেখলাম ভিতরে সারি সারি কাঁচের প্লেট, মগ, বাটি, গামলা সাজানো। আপু খুঁজে খুঁজে একটা ইলেক্ট্রিক ফ্রাই প্যান বের করলো (জিনিসটা খুব অদ্ভূত, ফ্রাই প্যানের সাথে তার লাগানো- কারেন্টে দিলে গরম হয়ে যায়), কিন্তু এই এক ফ্রাই প্যানে আর কয়টাই বা বেগুন ভাজা যাবে? আপু বিরক্ত হয়ে বললো যে এক্ষুণি একটা বাজে রিভিউ দিতে হবে এয়ার বিএনবিটার নামে!
ওদিকে নাহিদ ভাইয়ের গাড়ি এসে পৌঁছালো। সবাই এগিয়ে গেলো ওনাদের নিয়ে আসতে। ইতোমধ্যে অনেক কসরত করে দোতলার দরজা খোলা সম্ভব হলো। আমাদের সকল ঝামেলার অবসান ঘটিয়ে দিয়ে দোতলায় পাওয়া গেলো মস্ত বড় কিচেন। আমি আর তমা আপু ফ্রেশ হয়েই দৌড়ে চলে গেলাম দোতলায়। মোটা মোটা সব বেগুন ধুয়ে, কেটে, মশলা মাখিয়ে তিন তিনটা ফ্রাই প্যানে হুলুস্থুল করে ভাজতে লাগলাম আমরা। ওদিকে আমাদের বেগুনের গন্ধে পুরো দোতলা ভরে গেলো। সবাই সমানে কাশতে লাগলো। আমরা বেগুন ভাজতে ভাজতেই বাকি লোকজনরা আসতে লাগলো ধীরে ধীরে। একেক জন একেকটা আইটেম রান্না করে নিয়ে এসেছিলো। সবাই এসে পড়লে আমরা খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, মিট বল আর কোক দিয়ে দৌঁড় ঝাপ করে ডিনার সারলাম। রাতের খাবার শেষ হতেই সবাই ঘুমাবার আয়োজন ঠিক করতে লাগলো। ঠিক হলো তিনতলার দুইটা টুইন বেডে থাকবো আমি, তাসনিম আপু, কুসুম আপু আর লুবনা আপু।
এই রুমের মধ্যে একমাত্র আমারই ছিলো পরেরদিন র্যাফটিং। তাই রাত ১২টা সাড়ে ১২টা বাজতে না বাজতেই আমি ঘুমানোর ইন্তেজাম করতে লাগলাম। দাঁতটাত মেজে মোবাইলে এলার্ম দিয়ে তুলতুলে নরম বিছানায়, তুলতুলে নরম বালিশে মাথা ডুবিয়ে নরম কম্বলটা গায়ে টেনে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু কেন যেন ঠিকঠাকমত ঘুম আসলো না। বরঞ্চ মাঝরাতে সবাইকে জাগিয়ে বিকট স্বরে আমার ফোনে এলার্ম বাজতে লাগলো। কোন রকম উঠে ফোনটা বন্ধ করে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
যাই হোক, ঘুম থেকে সকালেই উঠে গেলাম। তৈরি হয়ে নিচে নেমে নাশতা করতে গেলাম। সারা রান্নাঘর আর ডাইনিং টেবিল ভর্তি খাবার দাবার ছড়ানো। আমি খুঁজে খুঁজে পরোটা বের করলাম। কে যেন ডিম ভেজে দিলো। ঝটপট খেয়ে আমরা বেড় হয়ে গেলাম। আমরা আর মাকসিম ভাইরা একসাথে রওয়ানা দিলাম। সকাল বেলা হালকা হালকা করে ভালোই ঠাণ্ডা পড়েছে। আমরা সবাই কম বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লাম, এই রকম ঠাণ্ডায় পানিতে নামবো কিভাবে সেই কথা চিন্তা করে।
আমরা ফেয়েটভিল নামের জায়গায় পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে ছুটতে ছুটতে গাড়িতে তেল ভরে প্রায় চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমাদের বুকিং দিয়ে রাখা র্যাফটিং কোম্পানির বেসে। গাড়ির ডিকিতে আমাদের সব মালপত্র রেখে আমরা বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঠাণ্ডা বাতাসে আমার হালকা কাঁপুনি ধরে যাচ্ছিলো। ধীরে ধীরে আমরা সাতজন ছাড়াও আরও কিছু বিদেশি এসে হাজির হলো। আমরা নানা রকম জল্পনা কল্পনা করতে করতেই একসময় র্যাফটিং কোম্পানির অফিসে গাড়ির চাবি জমা দিয়ে ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’ এই মর্মে স্বাক্ষর করে মনে প্রাণে প্রস্তুত হয়ে নিলাম! আমাদের সাথে দুইজন ইন্সট্রাক্টর দেয়া হলো। একজন মহিলা ইন্সট্রাক্টর এসে আমাদের হাতে কমলা রঙের লাইফ জ্যাকেট, কমলা বৈঠা আর নীল রঙের হেলমেট দিয়ে গেলো। আমাদের যাদের পরতে অসুবিধা হচ্ছিলো তাদেরকে আবার ওনারা সাহায্য করে দিচ্ছিল। আমাদের সবার গায়ে লাইফ জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট, পায়ে ওয়াটার শু আর হাতে বৈঠা, দেখতে বেশ চমৎকার লাগছিলো! খুব একটা অভিযাত্রী অভিযাত্রী ভাব নিয়ে আমরা একজন আরেকজনকে দেখতে লাগলাম।
আমাদের সবাইকে একটা বাসে ওঠানো হলো। বাসটা দেখে আমার প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। পুরানো রঙ জলা বিবর্ণ একটা ঝরঝরে বাস। এই দেশে এসে সব ঝাঁ চকচকে জিনিস দেখতে দেখতে একঘেয়ে লাগছিলো। এই প্রথম এরকম একটা বাস পেয়ে আমার শান্তি লাগলো। আমরা সবাই বৈঠা হাতে নিয়ে একে একে বাসে উঠতে লাগলাম। আমাদের সাথে নয়জনের আরেকটা দল ছিলো। সবাই উঠে বসতেই বাস ছেড়ে দিলো। সেই মহিলা ইন্সট্রাক্টর সামনে এসে আমাদের সাথে পরিচিতি শুরু করলো। তারপর পরিচয় করিয়ে দিল বাস ড্রাইভার ক্যান্ট্রেল র্যাফটিং এর মালিকের সাথে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কোম্পানির মালিক নিজে বাস চালিয়ে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে! কি আশ্চর্য ! ইন্সট্রাক্টর কোন রকম নিশ্বাস না ফেলে একটানা কথা বলে যেতেই লাগলো। কিছু সাজেশন, কিছু ঠাট্টা, কিছু সতর্কতা- টানা এইসব কথাবার্তা বলতে বলতেই আমরা এসে পড়লাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গা কুনার্ডে। বৈঠা হাতে বাস থেকে নেমে আমরা একটু দাঁড়ালাম। সাথে সাথে কমবয়সী সোনালি চুলের একটা মেয়ে ক্যামেরা হাতে আমাদের ছবি তুলে দিতে লাগলো। আমরাও পোজ মেরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে লাগলাম। তারপর সবাই মিলে বাসের পিছনে ট্রেলারে থাকা দুইটা ভেলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের দুই দলের জন্য দুইটা ভেলা। ঠিক হলো আমাদের ইন্সট্রাক্টর হবে জেরি নামের একজন, আর ওই মহিলা হবে অন্য দলটির ইন্সট্রাক্টর। আমরা প্রথমেই জেরি কে বললাম আমরা সাতজনের কেউই সাঁতার পারিনা। জেরি আমাদের মধ্য থেকে দুইজন নেতা ঠিক করতে বললো। আমরা মাক্সিম ভাই আর নাহিদ ভাইকে আমাদের নেতা বানিয়ে দিলাম। তারপর সবাই ধরে ধরে ভেলাটাকে নিয়ে নিচে ‘নিউ রিভার’ নামক নদীতে নামালাম। তারপর সবাই টকাটক করে উঠে পড়লাম। সবার সামনে মাকসিম ভাই আর নাহিদ ভাই। তার পিছনে শাহরিয়ার আর তমা আপু, তার পিছনে আমি আর রাতুল, আমার পিছনে দিশা। আর সবশেষে আমাদের ইন্সট্রাক্টর জেরি। নদীর পানিতে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম।
প্রথমে জেরি কিছুক্ষণ আমাদের শিখিয়ে দিলো কিভাবে জেরির নির্দেশ অনুসরন করতে হবে। আমরাও নির্দেশমতন বৈঠা বেয়ে ওয়ার্ম আপ করে নিলাম। মোটামুটি ব্যাপারটা বুঝে যাওয়ার পর আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। দুইপাশে উঁচু পাহাড়ের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে নদীটা। টলটলে স্বচ্ছ পানি। তবে আনন্দের বিষয় হচ্ছে পানিটা ঠাণ্ডা না। স্বাভাবিক তাপমাত্রা। আমাদের শীতশীতভাব যেন কোথায় উবে গেলো। কয়েক মিনিট সামনে যাওয়ার পর আসলো প্রথম র্যাপিড। ছোট বড় বিভিন্ন আকারের পাথরের মধ্য দিয়ে আমাদের ভেলাটাকে নিয়ে যেতে হবে। আমরা টানটান হয়ে জেরির নির্দেশমত বৈঠা বাইতে লাগলাম। সফলভাবে আমরা প্রথম র্যাপিডটা পার হয়ে গেলাম। সবাই খুশিতে চিৎকার করে উঠলাম। আমাদের খুব মজা লাগছিলো। সুন্দর নদীটার দুইপাশে নানারকম দেখার জিনিস। দুই পাশের পাহাড়ে কখনো ঘন সবুজ জংগল, কখনো কয়লা খনির ভাঙ্গা চোরা স্থাপনা, কখনো বিশাল বিশাল পাথর আবার কখনো বা বিখ্যাত গর্জ সেতু – এইসব দেখতে দেখতে আমারা ছোট বড় বিভিন্ন র্যাপিড পার হচ্ছিলাম। এভাবে আমরা ভেলাটাকে বাইতে বাইতে একে একে ১২টা র্যাপিড পার হলাম। আমাদের অভিযান যখন শেষ হলো তখন দুপুর হয়ে গেছে। আবার পানি থেকে ভেলাটাকে টেনে ধরে ট্রেলারে ওঠানো হোল। আবার সব বৈঠা নিয়ে আমরা বাসে উঠে বসলাম। বাস ছেড়ে দিতেই টের পেলাম শীত। আমাদের সারা শরীর ভেজা। বাসে জানালা দিয়ে হুহু করে ঢুকতে লাগলো ঠাণ্ডা বাতাস। ভাগ্যিস লাইফ জ্যাকেটটা ছিলো বলে জমে যাই নাই।
আমরা বাসে থাকতে থাকতেই সেই মহিলা ইন্সট্রাক্টর আমাদের নানা রকম জিনিসের বর্ণনা দিচ্ছিল। আমরা জানলাম যে, এখন অনেকেই ভ্যাকেশন হাউজ বানানোর জন্য ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় জমি কিনে। আমরাও চাইলে এখানে জমি কিনতে পারি। তারপর আমাদের বাস যখন গর্জ সেতুর উপর দিয়ে পার হচ্ছিলো তখন জানলাম ‘ব্রিজ ডে’র কথা। প্রত্যেক অক্টোবর তৃতীয় শনিবার পালিত হয় ‘ব্রিজ ডে’। এই দিন এই সেতুর উপর গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সারা দিন ধরে বড় উৎসবের মতন হয়। দলে দলে ডাইভাররা ব্রিজের উপর থেকে নদীতে ঝাঁপ দেয়। তারপর দেখলাম ‘টুডোরস বিস্কুট ওয়ার্ল্ড’ নামের ‘বিখ্যাত’ দোকান যেটা আসলে বার্গারের দোকান। শহরের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আমর ফটোগ্রাফি দোকানও দেখলাম যেখানে আমাদের র্যাফটিং করা ছবিগুলো কিনতে পাওয়া যাবে। প্রায় পনের থেকে বিশ মিনিট ধরে টানা কথা বলার পরও মহিলা এক মুহুর্তের জন্য ক্লান্ত হলো না। আমি মহিলার স্টযামিনা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এর কি খায় কে জানে?
আমরা বাস থেকে নেমে দৌড়ে চেঞ্জ রুমে গেলাম। ভেজা জামা কাপড় বদলে বেড় হয়ে আসতে আসতেই দেখি হাইল্যান্ডার থেকে অন্য সবাই গাড়ি নিয়ে আমাদের এখানে চলে এসেছে। আমাদেরকে ক্যান্ট্রেল র্যাফটিংএর মালিক সন্ধ্যায় পার্টির দাওয়াত দিলো। গানবাজনা হবে, খাওয়া দাওয়া হবে- সব মিলিয়ে নাকি খুব মজা! কিন্তু আমরা সাতপাঁচ ভেবে তেমন কোন লাভ দেখলাম না। তাই নিজের আলোচনা করে যার যার গাড়িতে উঠে আমরা রওয়ানা দিলাম। প্রথমে গেলাম নিউ রিভারের তীরে যেখানে আমাদের র্যাফটিং শেষ হয়েছিলো সেই জায়গায়। সবাই ছোট বড় পাথরের উপর স্বচ্ছ পানিতে পা ডুবিয়ে বসে ছিলাম। দেখলাম আমাদের মতনই আরও অনেক ভেলা যাচ্ছে র্যাফটিং করতে করতে। অনেকে শুধুমাত্র একটা রিঙয়ের মধ্যে শুয়ে শুয়ে ভেসে যাচ্ছে। অনেকে আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সার্ফবোর্ডের মতন নৌকায় করে যাচ্ছিলো। খুব ভালো লাগছিলো আমাদের। অনেকক্ষণ এখানে বসে থেকে তারপর আমরা আবার গাড়িতে উঠে গেলাম ভিজিটর সেন্টারের দিকে। পথে আমি আর তমা আপু সেই ফটোগ্রাফি দোকানে নেমে আমাদের ছবিগুলো দেখে আসলাম আর তাদের গলা কাটা রেটের কথা জেনে আসলাম। একটু পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম ভিজিটর সেন্টারে। সেখানে হেঁটে হেঁটে ছোট একটা মিউজিয়াম দেখলাম যেটা ছিলো ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার কয়লা খনির ইতিহাসের উপর। সেখান থেকে ছোট্ট করে বারান্দা দিয়ে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে নিউ রিভার দেখা যাচ্ছে। তারপর ভিজিটর সেন্টার থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম ভিউইং ডেকের দিকে। পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমরা একটা সুন্দর ডেকে গিয়ে পৌঁছালাম যেখান থেকে গর্জ সেতুটা চমৎকারভাবে দেখা যায়। ছবিটবি তুলে আমরা সিঁড়ি বেয়ে আবার উপরে উঠে গেলাম। তারপর রওয়ানা দিলাম দুপুরের খাবারের উদ্দেশ্যে।
আমরা একটা সাবওয়েতে নেমে গেলাম। সবাই পেট ভরে স্যান্ডউইচ খেয়ে নিলাম। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে গেলাম একটা পার্কে। শেষ বিকালের কমলা রোদে ঝলমল করছিলো পার্কটা। এখান থেকেও নিউ রিভার নদী দেখা যায়। আমার এক পর্যায়ে মনে হলো এই পুরো ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া আসলে বেঁচে আছে এই একমাত্র নিউ রিভার নদী আর গর্জ সেতুর উপর নির্ভর করে। পার্কে খুব বেশি সময় নষ্ট না করে আমরা চলে গেলাম স্যান্ডস্টোন ফলস দেখতে। স্যান্ডস্টোন ফলসে যাওয়ার রাস্তাটা বেশ বুনো এবং পাহাড়ি। এক পর্যায়ে আমরা ভয় পেয়ে যাচ্ছিলাম যে এই পথের শেষে আদৌ কিছু আছে কিনা! কিন্তু সবশেষে ফলসটা দেখতে পেয়ে আমাদের সব দুঃখ দূর হয়ে গেলো। আসলেই খুব সুন্দর। বিশাল এলাকা জুড়ে পানির ধারা পাথর ডিঙ্গিয়ে মাত্র কয়েক ফুট করে করে নিচে নামছে। জায়গাটা অত্যন্ত রিফ্রেশিং। আমাদের খুব ভালো লাগছিলো। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকার উপায় ছিলো না। কারণ সুর্য ডুবে যাচ্ছে। আরেকটু পড় ঝুপ করে অন্ধকার নেমে পড়বে।
সূর্য ডোবার ঠিক আগ মুহুর্তে আমরা রওয়ানা দিলাম। স্যান্ডস্টোন ফলসের গা ঘেঁষে পাহাড়ি রাস্তা ধরে সামনে যেতে বেশ ভালোই লাগছিলো। একপাশে হঠাৎ অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলাম। সারি সারি কারাভ্যান। আগে কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়লে জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বস্তি দেখতাম। এই কারাভ্যানের সারি দেখে আমার সেই বস্তির কথা মনে পড়ে গেলো। জটলা পাকানো কারাভ্যানগুলো যেন জিপসিদের আস্তানা, যেমনটা আমাদের দেশে বেদেদের দল আস্তানা গাড়ে কোন এক নদীর ধারে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। এইদেশেও এরকম উদ্বাস্তু মানুষের দেখা পাবো ভাবি নাই। অন্ধকার নেমে যেতেই আমার দু চোখের পাতা ভারী হয়ে যেতে লাগলো। মাকসিম ভাই কিভাবে ড্রাইভ করছেন চোখের ঘুম তাড়িয়ে, আমি ভাবতেও পারলাম না। এরমধ্যে আরেক উপদ্রব শুরু হলো। হরিণ উপদ্রব! বলা নেই কওয়া নেই, ঝড়ের বেগে হরিণ দৌড়ে যাচ্ছে অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তার এই পার থেকে ওই পারে। সবাই ঢুলুঢুলু চোখ ডলে সতর্ক হলো হরিণের জন্য।
অবশেষে আমরা এসে পৌছালাম আমাদের হাইল্যান্ডারে। ক্লান্ত শরীরে নামতে নামতেই আমরা লেগে পড়লাম বার বি কিউ করতে। দুই দুইটা বার বি কিউ চুলায় চাপিয়ে দেওয়া হলো ম্যারিনেড করা মুরগি। আর চুলায় ভাজা হতে থাকলো ফ্রোজেন পরোটা। সবশেষে পেট ভরে খেয়ে দেয়ে আমরা আঙ্গুল চাটতে লাগলাম তৃপ্তি করে। তারপর কেক কাটা হলো তমা আপুর জন্মদিন উপলক্ষে। তারপর নানা রকম হাসির গল্প চলতে লাগলো অনেক রাত পর্যন্ত।
পরদিন সকালে উঠে দেখি আমরা আগের দিনের কয়জন ছাড়া বাকিরা সবাই চলে গেছে র্যাফটিং করতে। আমি কোনরকম কিছু খেয়ে নিলাম। ওদিকে তমা আপু আর রিমা আপু কোমর বেধে নেমেছে রান্নাঘর পরিষ্কার করতে। আমি বাইরে গিয়ে দেশে ফোন করে খানিক্ষণ কথা বললাম। তারপর তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিয়ে হাইল্যান্ডারকে বাই বাই বলে বের হয়ে পড়লাম সবাই। আমরা গাড়িতে ওঠার সময় দেখলাম থুথুরে বুড়ো মহিলা দামি শানদানি গাড়ি নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। আমরা মনে করলাম সে বুঝি এই কটেজের মালিক। পড়ে জানতে পারলাম সে হচ্ছে ক্লিনার, আমরা বের হয়ে গেলেই সে ঘর বাড়ি গোছগাছ করতে যাবে!
ঝলমলে সুন্দর দিনের আলোয় আমরা গেলাম একটা পার্ক দেখতে। তবে সেখানকার ফলসটা শুকিয়ে গেছে। তারপর কাছাকাছি আরেকটা ফলস দেখতে গিয়ে দেখি সেই একই ব্যাপার। পানির ধারা শুকিয়ে গেছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে কাছাকাছি কোথাও ঘোড়াদের কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনেক লোক পোষা ঘোড়া নিয়ে হাজির। ইয়া বড় বড় উঁচু একেকটা ঘোড়া। কয়েকটা ট্রেলারের মতন আস্তাবলও দেখলাম। কি সুন্দর চলমান আস্তাবল! এক মহিলা আর তার মেয়ে দুইজনে মিলে দুইটা ঘোড়ার লোম আঁচড়ে দিচ্ছে। ঘোড়া গুলো আরাম করে উপভোগ করছে ব্যাপারটা। আমি কয়েকটা ঘোড়াকে আদর করলাম। কি সুন্দর ঝলমলে কেশর!
ঘোড়াদের বিদায় দিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। পথিমধ্যে আর তেমন কোন সমস্যা হলো না (শুধু মাঝখানে এক স্টপেজে আমার প্রিয় ঘড়িটা ভুল করে রেখে আসা ছাড়া। কিভাবে সেই ঘড়ি ফেরত পেলাম সে এক বিশাল কাহিনী। এ গল্প আরেকদিন করা যাবে… )। শহরে ফিরে আবার ফোর্ডের গাড়িটা ফেরত দিয়ে মাকসিম ভাইয়ের গাড়িতে করে বাসায় এসে পৌঁছালাম। সারাদিন গাড়িতে বসে হাবিজাবি চিবাতে চিবাতে খিদেটাই নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরে ঢুকে কি খাবো কি খাবো ভাবতে ভাবতেই দেখি তামান্না চিকেন বিরিয়ানি করে রেখেছে।
যাই হোক রিজিকের মালিক আল্লাহ তায়ালা। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া বেড়িয়ে এসে বাসায় বসে নিশ্চিন্তে খেতে লাগলাম গরম গরম ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানি!