The Mighty INDIA CALLING: পুনরায় দিল্লীতে এবং একটি মন্দির ও দরগা দর্শন (পর্ব ১৪)

দিনে যখন ঘুম ভাংলো, তখন ঘাড় আর কোমরে টনটনে ব্যাথা। ঘাড় মালিশ করতে করতে ছোট্ট সিটের মধ্যে নিজের পা টা মেলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তেমন কোন লাভ হচ্ছিলো না। আর বাসও টানা চলছিলো। থামাথামির যেন কোন বালাই নেই। বাসে গ্যাট মেরে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায়ও ছিলো না। কি আর করা, আমরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতে লাগলাম।

প্রায় দুপুর ১২টার দিকে আমরা দিল্লী পৌঁছালাম। সেই আগের ইউ কে হোটেলে উঠি। কিন্তু এইবার আমরা বরাদ্দ পাই সব পচা পচা রুম। প্রথমে আমরা একটা রুমে যাই, সেটার বাথরুম থেকে বোঁটকা এক রকম গন্ধ বের হচ্ছিলো। তাড়াতাড়ি সেইটা বদলে আমরা আরেকটা রুমে উঠি। এই রুমটা অনেক ছোট। রুমে আমাদের লাগেজ গুলো রাখার পর আর তেমন জায়গাই ছিলো না। আর বাথরুমটা খুবই পচা। সেটাতে টিমটিম করে একটা হলুদ লাইট জ্বলছিলো যেটা ভিতরের পরিবেশকে আরও জঘন্য করে দিচ্ছিলো। আমরা রুম পেয়ে খুব মন খারাপ করলাম। কিন্তু কি আর করা, হোটেল মালিক যে এরকম ধড়িবাজ সেটা কি আর আগে জানতাম? ওরা সবাই ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে। আমি মৌলির হিটারটা দিয়ে পানি গরম করে নেই। গোসল করতে গিয়ে আমার গা ঘিনঘিন করছিলো। কোনমতে তাড়াতাড়ি করে বাথরুম থেকে বের হই।

আগের সারাদিনে আমি শুধু একটা স্যান্ডুইচ আর এক প্যাকেট চিপস খেয়ে ছিলাম। আর সকালেও কিছু খাওয়া হয় নাই। আমরা তাই তাড়াতাড়ি করে বের হই খাওয়ার জন্য। হোটেলের কাছেই একটা দোকানে চিকেন বিরিয়ানি পাওয়া যাচ্ছিলো। লোকটা হালাল বলাতে ৪০ রুপি দিয়ে এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানি অর্ডার দেই। পিয়াজের টুকরা দিয়ে সাজিয়ে এক প্লেট বিরিয়ানি এসে হাজির হয় সামনে। আমি গোগ্রাসে খাই। খাওয়া দাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আমরা বের হয়ে আসি। আমরা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই অক্ষরধাম টেম্পল। কিভাবে যাবো জানতে চাইলে একেকজন একেক রকম কথা বলে। দিল্লীর লোকজনকে কোন কথা জিজ্ঞেস করে লাভ নাই বুঝে আমরা ট্রাফিককে জিজ্ঞেস করি যে কেমন করে অক্ষরধাম টেম্পলে যাওয়া যেতে পারে।

আমরা ৬০ রুপি দিয়ে আগের মত অটো ভাড়া করে রাজিব চকে যাই। সেখান থেকে আগের বার যে মেট্রো স্টেশনে গিয়েছিলাম সেখানে যাই। টোকেন কাটি অক্ষরধামের। মেট্রো আসতেই ঠিক ঠিক চড়ে বসি। সব মেট্রো পাতাল দিয়ে যায়, কিন্তু এই মেট্রো হঠাৎ করে পাতাল ফুঁড়ে আকাশে উঠে গেলো। ঝলমলে দিনের আলোয় নিচে দেখা গেলো দিল্লী শহর। একটু পর পর অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছিলো একেকটা স্টপেজের। আমরা কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কোন স্টপেজের কথা বলে। একটু পর পর খেয়াল করছিলাম আমাদের স্টপেজ আসে কিনা। আমাদের অবস্থা দেখে একজন জিজ্ঞেস করে আমরা কোথায় যাবো। অক্ষরধাম যাবো শুনে উনি বলে আপনাদের তো মেট্রো মাঝে বদলাতে হবে। শুনে আমরা ভয় পেয়ে যাই, কারণ এমন কথা আমাদের স্টেশন থেকে কেউ বলে দেয় নাই। উনি আমাদের বোঝাতে থাকেন যে, যমুনা ব্যাংক স্টপেজে আমাদের নেমে যেতে হবে, তারপর আরেকটা মেট্রোতে করে সোজা যাওয়া যাবে অক্ষরধাম। উনার কথায় আশেপাশের অনেকেই সায় দেয়। আমরা বলি যে আমাদের একটাই টোকেন। উনারা বলে এই এক টোকেনেই যাওয়া যাবে, নতুন করে ভাড়া দিতে হবে না। দিল্লীর মানুষের কথায় বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছলাম না। এছাড়া মেট্রোর ম্যাপ চেক করে দেখলাম ওনাদের কথার সাথে মিলে যাচ্ছে বিষয়গুলো, যা আছে কপালে ‘ফী আমানিল্লাহ’ বলে নেমে পড়লাম যমুনা ব্যাংক স্টপেজে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখি অন্য পাশে আর কোন মেট্রো নাই। মনে মনে আল্লাহ, আল্লাহ করতে লাগলাম। এমন সময় হুউউশ করে একটা মেট্রো আসলো। আমরা সেটাতে উঠে পড়লাম। সেটা সত্যিই আমাদের অক্ষরধাম নামিয়ে দিলো। মেট্রো থেকে নেমে দেখি সারা, রাত্রি, বাসিরুন, সুমাইয়া ওদেরকে। সারা বলতে লাগলো, ‘সাহস খুব বেড়ে গেছে রে, মেট্রোতে উঠে আবার মেট্রো চেঞ্জ করে অক্ষরধাম পৌঁছে গেলাম, সাহস খুব বেশী বেড়ে      গেছে রে-’

মেট্রো স্টেশন থেকে বের হয়ে আমরা খোলা আকাশের নিচে এসে পড়লাম। এই জায়গার নাম অক্ষরধাম। এখন মন্দিরটা  কই আছে খুঁজে বের করতে হবে। আমরা কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করলাম। সবাই রাস্তা দেখিয়ে দিলো। মোটেও দূর না। হাঁটা পথ। আমরা রাস্তা পার হয়ে পৌঁছে গেলাম অক্ষরধাম মন্দিরে। গেটে ঢুকার সময় সেই লেভেলের কড়াকড়ি। আমরা সবাই লাইন ধরে এক এক লেয়ারের সিকিউরিটি পার হয়ে হয়ে যেতে লাগলাম। এক জায়গায় আমাদের সবার ব্যাগ জমা নিয়ে নিলো। ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, সোয়েটার- সব কিছু জমা দিয়ে প্রায় খালি হাতে আমরা শেষ নিরাপত্তা স্তরে প্রবেশ করলাম। এবার আমাদের সবার চেকিং চললো। আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বারবার প্যান্টের পকেট থাবড়ে থাবড়ে চেক করতে লাগলো। এক পর্যায়ে সারা বেশ চেতেমেতে সিকিউরিটি মহিলাকে ঝাড়ি মেরে দিলো। অবশেষে সব নিরাপত্তা স্তর পার হয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম।

ভিতরে আলিশান ব্যাপার স্যাপার। চার পাঁচটা অত্যন্ত কারুকাজ করা গেট পার হতে হতেই আমাদের চোয়াল ঝুলে পড়লো। দুটা ময়ুর গেটের মাঝখানে অল্প পানির পুলের মধ্যে বিশাল দুইটা নকশা কাটা পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। তাতে অনেক পয়সা জমে আছে। জানতে পারলাম, এটা হলো স্বামী নারায়নের পায়ের ছাপের রেপ্লিকা। বিশাল রাস্তার শেষ মাথায় অনেক উঁচুতে অনেক কারুকাজ করা নয় গম্বুজের লাল পাথরের মন্দিরটা দেখা যায়। আমরা সে দিকে হাঁটতে লাগলাম। আরও কিছুদূর হেঁটে জুতা জোড়া জমা দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম মন্দিরে ঢোকার জন্য। এতো এতো অলংকরন দেখতে দেখতে মাথা ঘুরে যায়। যা বুঝলাম মন্দিরটা নতুন কিন্তু বানানো হয়েছে পুরানো টেকনোলজি কাজে লাগিয়ে। পুরাই পাথরের মন্দির, কোন আরসিসি নাই। আর পাথরের দেয়াল কুঁদেই লাখ খানেক ছোট বড় দেব দেবীর মুর্তি, ফুল পাতা, পশু পাখি এইসব বানানো হয়েছে।

মেইন মন্দিরে ঢুকে আমার মনে হলো এইটা যতটা না মন্দির, তার চেয়ে বেশি জাদুঘর বা এক্সিবিশন সেন্টার। গর্ভগৃহের মাঝখানে স্বামী নারায়নের বিশাল চোখ ঝলসানো সোনালি মুর্তি। আর বড় মুর্তিটার চারপাশে সাইজে ছোট আরও কয়েক জনের একই রকম সোনালি মুর্তি। দেখে মনে হলো সোনার তৈরি। আর গর্ভগৃহটা সোনালি রুপালি রঙের এতো বেশি কারুকাজমন্ডিত ছিলো যেটা দেখে আমার ইউরোপের বারোকো স্টাইলের কথা মনে পড়ে গেলো। স্বামী নারায়নের বড় মুর্তি ছাড়াও রাধা কৃষ্ণা, লক্ষী-নারায়ন, রাম-সীতা, শিব-পার্বতীরও মুর্তি ছিলো। সবগুলো মুর্তিই লাইটিঙ্গের কারণে ঝকঝক করছিলো। আমরা চারপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। দেয়ালে ছবির মাধ্যমে অনেক ইতিহাস বর্ননা করা আছে। এক পাশে স্বামী নারায়নের ব্যবহার্য জিনিস যেমন জামা, মালা, পায়ের ছাপ এইসব সাজানো আছে। সব কিছু দেখে আমরা মেইন মন্দির থেকে বের হয়ে আসলাম। হেঁটে হেঁটে জুতা ফেরত নিয়ে আমরা অন্য দিকে গেলাম।

কতগুলো শো আছে যেগুলো টিকেট কেটে দেখতে হয়। শো দেখতে গেলে আমাদের দেরি হয়ে যাবে বলে আমরা শো দেখতে গেলাম না। আমরা সহজ আনন্দ নামের স্টেপ ওয়েল দেখলাম যেখানে সন্ধ্যার পর নয়নাভিরাম লেজার শো হয়। তারপর দেখলাম অভিষেক মন্দির। জানলাম, এখানে স্বামী নারায়নের কৈশর কালের মুর্তির উপর মন্ত্রপূত পানি ঢাললে মনের আশা পূরন হয়। আমি যখন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই যচ্ছিলাম তখন রুবাইদা আমার কাঁধ খামচে ধরলো। আমি কাঁচের জানালা দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখি ভিতরে সবাই বসে চোখ বন্ধ করে মন্ত্রের তালে তালে ডানে বামে ঝুঁকছে। এই অবস্থায় আমি ভিতরে ঢুকে পড়লে সেটা খুব বিব্রতকর অবস্থা হতো সবার জন্যই।  আল্লাহ বাচিঁয়ে দিয়েছেন আমাকে। তারপর আমরা দেখি লোটাস গার্ডেন। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা কতগুলো চমৎকার ফুড কোর্ট, সুভেনিয়র সুপার শপ পার হয়ে যখন বের হবার রাস্তা খুঁজতে লাগলাম, ততক্ষনে সূর্য প্রায় ডুবে যায় যায় অবস্থা। এরই মধ্যে এখানকার বাথরুমে আমার সানগ্লাসটা হারিয়ে ফেলায় মন বেশ খারাপ ছিলো। আর অন্ধকার নামার সাথে সাথেই শীত জাঁকিয়ে পড়তে লাগলো। আমার সব এক্সট্রা সোয়েটার ঢোকার সময় জমা দিয়ে ফেলেছিলাম। তাই তাড়াহুড়া করে বের হবার চেষ্টা করতে থাকি। পরে মনে পড়ে আমাদের টোকেন সারার কাছে। গেটের কাছাকাছি পৌঁছে সবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে এক সময় সারাকে খুঁজে পাই। তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ ফেরত নিয়ে সোয়েটার, মাফলার আর হাত মোজা পরে ফেলি।

এবার সবার সাথে আলোচনা করতে থাকি কোথায় যাওয়া যেতে পারে নেক্সট- এই সব নিয়ে। সিদ্ধান্ত হলো নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় যাওয়া হবে। আমরা বের হয়ে ট্যাক্সি ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকি, কিন্তু ট্যাক্সির বদলে মাইক্রোবাস এসে হাজির হয়। আমরা দরাদরি করে যা আছে কপালে বলে উঠে পড়ি মাইক্রোতে। আমি আর সারা গাদা গাদি করে পিছনে বসি। সারা আবার মাথা নেড়ে আমাকে বলতে থাকে, ‘সাহস খুব বেড়ে গেছে রে, মাইক্রোতে করে কয়েকজন মেয়ে মিলে অপরিচিত শহরে রাতের বেলা দরগায় যাচ্ছি, সাহস খুব বেশী বেড়ে গেছে রে-’।  আমিও ভেবে দেখলাম, ঢাকা শহরেও আমার এরকম রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাইক্রো ভাড়া করে অপরিচিত জায়গায় যাওয়ার সাহস হবে না। আর এখন……

দরগার কাছাকাছি একটা জায়গায় এনে আমাদের নামিয়ে দিলো মাইক্রো বাস। পার হেড ভাড়া পড়লো ৪০ রুপি। আমরা নেমে চিপা গলি দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। দুপাশে খাবার দোকান। কাবাব ভাজা হচ্ছে, মাংস ঝলসানো হচ্ছে, বিশাল বিশাল কড়াইয়ে শত শত লালমোহন মিষ্টি ডুবিয়ে জ্বাল দেওয়ায় হচ্ছে- এই শীতের মধ্যে এই রকম ধোঁয়া ওঠা খাবারের দোকান পার হতে গিয়ে আমাদের সবারই খিদে লেগে গেলো। আমরা ঠিক করলাম ফেরার সময় পেট ভরে খেয়ে নিবো। রাস্তার ধারে নানা রকমের পসরা সাজিয়ে বসেছে লোকজন। এলুমিনিয়ামের বাটি থেকে শুরু করে আতরের শিশি কি নাই সেখানে! সব কিছুই দামে সস্তা। কে জানি একটা ছোট্ট এলুমিনিয়ামের বদনা কিনলো। এই সব দেখতে দেখতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। আস্তে আস্তে একেবারে বাজারের মত জায়গায় ঢুকে গেলাম। লোক জনের হাঁকডাক বাড়তে লাগলো। দুইপাশের দোকান গুলোতে থালা ভর্তি ফুল, মোমবাতি, গোলাপ জল, আগরবাতি, লাল সুতা, জরি দেওয়া কাপড় এইসব সাজিয়ে রেখেছে। আর আমাদের চিৎকার করে বলতে লাগলো স্যান্ডেল খুলে জমা দিয়ে ভিতরে যেতে। যারা আগে কখনো দরগায় যায় নাই তারা লোকজনের এই রকম আচরন দেখে নার্ভাস হয়ে গেলো। আমরা কয়েকজন মিলে ঐসব লোকদের ধমক ধামক উপেক্ষা করে হাঁটতে লাগলাম। যতই সামনে যেতে লাগলাম ততই লোকজন আমাদের ধরেবেঁধে ওই সব থালা কিনতে বাধ্য করার চেষ্টা করতে লাগলো। আমরা সবশেষে একেবারে বাজারের শেষ মাথায় এসে জুতা খুললাম। ওইখানে এক দোকানে জুতা জমা দিয়ে ঢুকলাম দরগার উঠানে।

একটা ছবি থেকে তোলা নিজামুদ্দিন দরগার এরিয়াল ভিউ
একটা ছবি থেকে তোলা নিজামুদ্দিন দরগার এরিয়াল ভিউ

এই দরগার খোলা জায়গা গুলো টুকরা টুকরা। আর সারা উঠান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কবর। মনে হলো উনারা যে যেই জায়গায় মারা গিয়েছিলেন ঠিক সেই জায়গাতেই উনাদের কবর দেওয়া হয়েছে। আমরা সাবধানে কবর পাশ কাটিয়ে হেঁটে হেঁটে নিজামুদ্দিনের দরগার সামনে আসলাম। খুব সুন্দর সাদা রঙয়ের পাথরের উপর সোনালি কারুকাজ করা দরগা। ছেলেরা ভিতরে সেই থালা নিয়ে ঢুকছে। আর বাইরে চারপাশে ভীড় করে বসে মহিলারা মোনাজাত করছে, কুরআন শরীফ পড়ছে, কাউকে মনে হলো সেজদা দিতেও দেখলাম। চারিদিকে লাল সুতার সমাহার। দরগার সামনে ছোট উঠানটা জুড়ে কাওয়ালি গানের আসর বসেছে। একজন গায়ক হারমোনিয়াম বাজিয়ে জোর গলায় গান করছে আর তার সাথে অনেকেই ঝুনঝুনি, খঞ্জনি এইসব বাজিয়ে সুর দিচ্ছে। পুরা উঠান জুড়ে লোকজন ভীড় করে গান শুনছে। কেউ কেউ আবেগে মাথা নাড়ছে, হাতে তালি দিচ্ছে। আমার মনে হলো আমাদের দেশে মাজার যেমন শান্ত, নিরিবিলি জায়গা, ইন্ডিয়াতে মাজার বেশ উৎসবমুখর জায়গা। এত বড় একজন আউলিয়ার মাজারের পাশেই উচ্চস্বরে গান বাজনা হচ্ছে ব্যাপারটা দেখে আমার খুব কষ্ট লাগলো। চারিদিকে পুরাই বিদাতি পরিবেশ। এর মাঝে একটু নফল নামাজ পড়া যাবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তবে খুঁজে পেলাম মেয়েদের নামাজের জায়গা। বলতে গেলে সেটা পুরাই খালি। যাই হোক আমি কোন মতে দু রাকাত নফল নামাজ পড়েই বের হয়ে আসলাম। দেখি কাওয়ালির আসর ভেঙ্গে গিয়েছে। সবাইকে নকুলদানা শিন্নি হিসেবে দেওয়া হয়েছে। আমিও সেই শিন্নির ভাগ পেলাম। লোকজনের হৈচৈ চিৎকার শুনে মনে হলো যেন কোন মেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি।

আবার রাত নয়টার সময় শুরু হবে কাওয়ালি। তার আগেই ঘুরেফিরে আমরা বের হয়ে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। রাতের বেলায় খুব বেশি ঘোরাঘুরি করতে ইচ্ছা করলো না।  এমনিতেও পরিবেশটা শান্ত নয়, তাই আমরা বের হয়ে এলাম। সেই চিপা বাজারের রাস্তা দিয়ে আবার হেঁটে হেঁটে বাইরে চলে আসলাম। এক লোক দেখলাম ছোট ছোট শিক কাবাব বিক্রি করছে। আমরা ২০ রুপি দিয়ে ৪টা শিক কাবাব কিনে খেলাম। খুব বেশি মজা লাগলো না। পরে ঘোরাঘুরি করে এক হোটেলের দোতলায় উঠে বসলাম। সেই হোটেলে আমরা ছাড়া আর কোন মেয়ে নাই। সারা এলাকাতেই অবশ্য আমরা ছাড়া তেমন কোন  মেয়েই ছিলো না। আমরা আরাম করে বসে নানা রকম আইটেম অর্ডার দিলাম।  গল্পগুজব করতে করতে আমরা হোটেলটাকে গমগমে বানিয়ে ফেললাম। নিচে যেসব লোক বসা ছিলো, ওনারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো যে কারা এত হৈচৈ করছে। এক সময় আমাদের অর্ডার আসলো। আমার ৩৯ রুপির ডাল গোস্ত আর নান মজা ছিলো। এছাড়া মগজ, নেহেরি, ফ্রায়েড চিকেন, সিল্মা রুটি সবই টেস্ট করে দেখলাম। সবগুলোই মজা। খেয়ে দেয়ে অনেকে আবার চা অর্ডার দিলো। সব শেষে বিল মিটিয়ে আমরা বের হয়ে আসলাম। দেখি বড় বড় লাল মোহন যাকে ওরা বলে ‘গুলাব্জামুন’ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। আমরা ছোট বাটিতে করে সিরায় ডুবানো লাল মোহন খেলাম। অনেকে হালুয়াও টেস্ট করলো। পেট ভরে সব খেয়ে দেয়ে আমরা ফাইনালি বের হয়ে আসলাম। একটা অটো ভাড়া নিলাম মোড়ের থেকে। ১০০ রুপি ভাড়া নিয়ে সেই অটো আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলো।

হোটেলে ফিরে ছোট্ট রুমটাতে ঢুকে আমার আবার মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু কি আর করা, একজন লোককে ডাকিয়ে বাথরুমটা পরিষ্কার করে দিতে বললাম। কিন্তু যেই লাউ সেই কদুই রইলো। কিছুক্ষণ পাশের রুমের সুমাইয়া, রাত্রির সাথে গল্পগুজব করে রুমে ফিরে আসলাম। ওদিকে মজুমদার আর মৌলিও ফেরত এসেছে। সবাই মিলে বিছানাটায় চাপাচাপি করে শুয়ে পড়লাম। সহসা ঘুম আসতে চাইলো না। তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

 

The Mighty INDIA CALLING: যে সৌন্দর্য শুভ্র নীহারের, যে সৌন্দর্য হিম কুয়াশার (পর্ব ১২)

লেপের তলায় মুখ গুঁজে থাকা অবস্থাতেই মৌলির ফোন বেজে উঠতে শুনলাম। ঘুম জড়ানো কন্ঠে মৌলি ফোনটা ধরলো। জাফর ফোন দিয়েছে। মৌলি ওকে জানালো আমরা ঘুম থেকে এখনো উঠি নাই, লেপের তলাতেই আছি। শুনে জাফর বললো শিগগিরি বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে তাকিয়ে দেখতে। শুনে মৌলি অনেক কষ্টে লেপের তলা থেকে বের হয়ে কোটটা গায়ে জড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নামে। হঠাৎ শুনতে পাই চিৎকার। চিৎকার শুনে মজুমদার আর রুবাইদা তড়াক করে উঠে গেলো। আমিও উঠতে গেলাম কিন্তু হাতড়ে ওভারকোটটা পাচ্ছিলাম না। এবার শুনলাম তিনজনের সম্মিলিত চিৎকার। আমি আর অপেক্ষা করলাম না। কম্বলটা গায়ে জড়িয়েই উঠে পড়লাম। দৌড়ে গেলাম জানালার কাছে।

আমি থ হয়ে গেলাম। জানালা দিয়ে দেখা গেলো একটাই রঙ- সাদা। বাইরের সবকিছু সাদা। মাটি, পাকা রাস্তা, গাড়ি, গাছের ডাল, দূরের ঘর বাড়ি- সব সাদা। এক সাদা স্বপ্নের জগতে এসে পড়েছি যেন। সারা রাত তুষারপাত হওয়ার কারনে সব কিছু পুরু বরফের নিচে চাপা পড়ে আছে। দৃশ্যটা দেখে আমার গলা দিয়ে অন্য তিনজনের মত অটোমেটিক চিৎকার বের হয়ে আসলো। আমরা চার জন লাফাতে লাফাতে চিৎকার করতেই থাকলাম। মনে হতে লাগলো খুশীতে আমাদের বুঝি মাথা নষ্ট হয়ে যাবে, আমরা বুঝি পাগল হয়ে যাবো। তারপরও আমরা থামলাম না, একে অন্যকে জড়িয়ে লাফাতে লাগলাম। তাড়াতাড়ি আম্মুকে ফোন দিলাম। খুশীতে আমার গলা দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলো না। তারপরও কোনমতে বললাম সবকিছু। একে তো মোবাইলে ব্যালেন্স তেমন নাই তার উপর কবে ব্যালেন্স ভরতে পারবো সেটাও জানি না। তাই বেশিক্ষন কথা বলতে পারলাম না। আম্মুও সব শুনে অসুখ বিসুখ না বাধানোর একগাদা উপদেশ দিয়ে ফোন রেখে দিলো।

আমরা তাড়াতাড়ি করে যে যেভাবে ছিলাম তার উপরই কোনমতে গায়ে কোট জড়িয়ে, পায়ে জুতা গলিয়েই বের হয়ে পড়লাম। চারিদিকে সাদা বরফের রাজ্যে পা দিয়েই এক ধরনের শিহরণ অনুভব করলাম। নিস্তব্ধ এক সাদা জগতে আমরা কয়েকজন রঙ্গিন পোশাক পরে হাঁটতে লাগলাম। আমার জুতার সোল বরফে ডুবে যাচ্ছিলো। ওয়াটার প্রুফ জুতা ছিলো বলে বাঁচোয়া। তারপরও মনে হচ্ছিলো জুতার সোলটা বোধহয় ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। তবে এসব পাত্তা না দিয়ে আমরা ঘুরতে লাগলাম। বরফের মধ্যে ছেলেমানুষের মতন ছুটে বেড়াতে লাগলাম। সাদা বরফগুলোকে গ্লাভস পরা আঙ্গুল দিয়ে গুতিয়ে দেখতে লাগলাম, পা দিয়ে নিচের বরফগুলোকে লাথি মারতে লাগলাম, বরফে ঢাকা গাড়ির সামনে ছবি তুললাম আর চন্দ্রমুখী কটেজের বারান্দা থেকে আমাদের যারা বের হয়নাই তারা দাঁত বের করে হাসতে লাগলো।

এফ
চন্দ্রমুখী কটেজের সামনে তখন সবই সাদা (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

কে যেন তাড়া দিলো নাশতা খেয়ে রেডি হয়ে নেওয়ার জন্য। আমরা তাড়াতাড়ি রুমে ফিরে গেলাম। রুমে একজন একজন করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে লাগলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমার গাল গুলো টকটকে লাল হয়ে গেছে। আমি বেশ কয়েকবার ছবি তুলে গালের লাল রংটা ধরে রখতে চাইছিলাম। কিন্তু কোনভাবেই ক্যামেরায় সেটা আসছিলো না। পাশের রুমের সৃষ্টির কাছে থেকে হেয়ার ড্রায়ার এনে লাগেজ খুলে যত্তগুলা গরম কাপড় এনেছিলাম সবগুলো গরম করে গায়ে পরে নিলাম। সবকিছু পরে যখন শেষে ওভারকোটটা গায়ে দিলাম তখন হাত পা আর নাড়াতে পারছিলাম না। এত্তগুলো গরম কাপড় গায়ে দিয়ে আমরা সবাই কেমন যেন কার্টুনের মত হাঁটতে চলতে লাগলাম।

হোটেল থেকে বের হয়ে বাম দিকে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার পাশে ছোট ছোট দোকান। সেগুলোতে ছাতা, গামবুট, গরম কাপড় এইসব ভাড়া দেওয়া হয়। আমরা দৈনিক হিসাবে ছাতা ৩০ রুপি আর গামবুট ৫০ রুপি দরে ভাড়া নিলাম। আকাশের অবস্থা সুবিধার ছিলো না। ঐ দোকানে থাকতে থাকতেই গুড়া গুড়া তুষার পড়তে লাগলো। আমরা এর মধ্যেই ভেজা রাস্তার মধ্য দিয়ে হেঁটে একটা ছোট পাঞ্জাবী ধাবা টাইপের দোকানে নাশতা করতে ঢুকলাম। আমরা অর্ডার দিলাম ২৫ রুপির আলু পরোটা আর ৩০ রুপির ডাবল ডিমের অমলেট। আমরা গুটিসুটি মেরে দোকানে বসে রইলাম। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা আর তুষারপাত আর ভিতরে আমরা হাহা হিহি করে নিজেদের গরম রাখার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের সামনেই একজন মহিলা আর তার স্বামী মিলে পরোটা বানাচ্ছিলো আর গরম তাওয়ায় তেল ঢেলে আলু পরোটা ভাজতে লাগলো। কিন্তু ওনাদের মধ্যে কোন তাড়া দেখতে পাচ্ছিলাম না। এমন আস্তে আস্তে ময়দা বেলে তার মধ্যে আলু ঢুকিয়ে পরোটা বানাচ্ছিলেন যেন ওনারা বাসার জন্য নাশতা রেডি করছেন। আমরা ধৈর্য ধরে বসে থাকলাম নাশতা খাওয়ার জন্য। অবশ্য চুলা থেকে নামানো পরোটা আর প্রায় ডুবো তেলে ভাজা ডিমটা অনেক মজা ছিলো।

খেয়ে দেয়ে আমরা হোটেলের সামনে এসে জড়ো হলাম। সেখানে জানতে পারলাম আমাদের আজ রাতেই আমাদের মানালি ছেড়ে দিল্লীর দিকে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আবহাওয়ার অবস্থা আর মানালির সৌন্দর্য দেখে ডিসিশন নেওয়া হয়েছে যে আজ আমরা মানালি থেকে যাবো। পরদিন দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো ইনশাল্লাহ । আর আজ রাতেই আমাদের সবার জন্য কমিটির তরফ থেকে অ্যারেঞ্জ করা হবে ‘সারপ্রাইজ পার্টি’। ইতোমধ্যে আবহাওয়ার কারণে আমাদের যে জায়গায় যাওয়ার কথা ছিলো (সম্ভবত সোলাং ভ্যালি) সেটা ক্যান্সেল হয়ে গেছে। তার বদলে আমরা নেহেরু কুন্ডে যাবো বলে ঠিক হলো। এর জন্য কমিটি জিপ ভাড়া করে রেখেছে। আমরা দুদ্দাড় করে জিপে উঠে বসতে লাগলাম। একটা করে জিপ ভরে উঠতে লাগলো আর একটা করে জিপ ছাড়তে লাগলো।

দফগ
নেহেরু কুন্ডে যাবার ঘোলাটে সাদা পথ (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

জিপে করে নেহেরু কুন্ডে যাওয়ার রাস্তাটা অত্যন্ত উপভোগ্য ছিলো। আস্তে আস্তে হাল্কা তুষারপাত বাড়তে লাগলো। এক সময় সেটা এতই বেড়ে গেলো যে ড্রাইভারকে ঘন ঘন ওয়াইপার চালাতে হলো সামনের কাঁচ পরিষ্কার রাখার জন্য। দুপাশের দৃশ্যের কথা আর কি বলবো, সেই দৃশ্য বর্ননা করার সাধ্য আমার নেই। সবাই হাঁ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মজুমদারকে ড্রাইভার বললো এই রকম ওয়েদার খুব একটা থাকে না। আর এক দুই দিনের মধ্যেই হয়তো তুষারপাত বন্ধ হয়ে আবার স্বাভাবিক ওয়েদার হয়ে যাবে। মজুমদার ওর মোবাইল গাড়ির সামনের কাঁচে লাগিয়ে ভিডিও করতে লাগলো। আমি উশখুশ করতে লাগলাম। পায়ের তালুতে কেমন যেন যন্ত্রনা হচ্ছে। যন্ত্রনা বাড়তে বাড়তে যখন অসহ্যকর হয়ে পড়লো তখন গামবুট খুলে ফেললাম। এক লেয়ার পলিথিন ব্যাগ আর তিনটা মোজা খুলে যখন পায়ে হাত দিলাম, টের পেলাম ভেজা। এত সাবধানতা সত্ত্বেও কেমন করে পায়ে পানি বা বরফ কুচি পৌঁছালো সে রহস্য ভেদ করতে পারলাম না। কি আর করা, কাপড় দিয়ে পা মুছে মাত্র একটা মোজা পরে আবার পা গামবুটে ঢুকালাম। ভেজা মোজা গুলো ব্যাগে ভরলাম।

এক সময় আমরা যায়গায় এসে পৌঁছালাম। জিপ থেকে বের হয়েই ভারি তুষার পাত মাথায় নিয়ে দৌড় দিলাম। দেখলাম সবাই একটা দোকানে ঢুকছে। আমরাও ঢুকে পড়লাম। সেখানে ২০০ রুপি দিয়ে বরফের মধ্যে দিয়ে চলাফেরা করার জন্য বিশেষ জামা ভাড়া পাওয়া যায়। দোকানে ঢুকার সাথে সাথে ওরা আমাদের সাইজের রংচঙ্গে সব জামা বের করে দিতে লাগলো। আমাকে দিলো বিশাল সাইজের লাল নীল রঙের হাস্যকর একটা জামা। আমরা ঠিক মত পরতে পারছিলাম না। ওরা আমাদের পরিয়ে দিতে সাহায্য করছিলো। আমরা গায়ের সব গরম কাপড় এমন কি ওভারকোট সহ সেই জামার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমি পায়ের জন্য কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাকে বাঁচিয়ে দিলো তমা। ও ব্যাগের ভেতর থেকে এক জোড়া মোটা মোজা বের করে দিলো। আমি চটপট সেই মোজা পায়ে পড়ে ফেললাম। তারপর বের হয়ে পড়লাম সেই দোকান থেকে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটা ছোটখাটো ঢাল, সেটা পুরাই বরফে ঢাকা। কেমন করে সেই পার হবো সেটা চিন্তা করে মাথা চুলকাতে লাগলাম।

যাই হোক হাচড় পাচড় করে কোনমতে বরফ বেয়ে বেয়ে সেই ঢাল পার হলাম। তারপর হাঁটা ধরলাম সামনের দিকে। এসে পড়লাম ঠিক যেন উত্তর মেরুর কোন জায়গায়। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। কিছু বোঝার আগেই বড় বড় পেঁজা তুলার সাইজের তুষার পড়তে লাগলো। যেন এক সাদা ঝড়ের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। অবস্থা এমন হলো যে, আমরা শুধু চার পাঁচ হাত সামনের মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছি। এর বাইরে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না, সবই সাদা আর সাদা। পুরা জিনিসটা কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগলো। নরম বরফের উপর পা ফেলে ঠিক মত হাঁটতে পারছিলাম না। এর মধ্যে রিজভীকে দেখলাম ক্যামেরা বের করে বেশ বিপদে পড়েছে। আমি ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম আর তার নিচে রিজভী ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে ছবি তুলতে লাগলো। আমার নিজের ক্যামেরাটা নিয়েও বেশ চিন্তায় পড়লাম কারণ আমার ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ নাই। তারপর পলিথিন বের করে ক্যামেরাটা ভরে ভালোমত গিঁট দিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম। জোর তুষারপাতের মধ্যেই আমরা একে ওকে বরফের বল মারতে লাগলাম। একটা করে পা ফেললেই পায়ের গামবুটের নিচে চুরচুর করে ভাংতে লাগলো বরফ। সাদার সমুদ্রে হঠাৎ হঠাৎ একেক জনকে খুঁজে পাচ্ছিলাম আমরা। উর্মি, আদিবাকে দেখলাম তুষার মানব বানাতে। আমিও হাত লাগালাম। টিভিতে তুষার মানব বানানো দেখে যতটা সোজা মনে হয় বাস্তবে ততটা সোজা নয়। আমাদের তুষারমানব দেখতে অতটা ভালো হলো না, তবে আমরা মাফলার, সানগ্লাস, চিং এর রঙ্গিন ছাতা দিয়ে ওকে ফিনিশিং দিয়ে ছবি তুললাম।

এফদ
ভারী তুষারপাতের কারণে কারও চেহারাই দেখা যাচ্ছে না (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

এর মধ্যেই স্কি নিয়ে কয়েক জন আমাদের পিছে পিছে ঘুরতে লাগলো। আমি যেহেতু স্কিয়িং পারি না, তাই রাজি হলাম না। তবে অনেকেই স্কি ভাড়া নিয়ে চেষ্টা করলো। তারপর মানালি ড্রেস নিয়ে কয়েকজন মহিলা ঘুরঘুর করতে লাগলো। ঝড় একটু কমলে মজুমদার সবার আগে মানালি ড্রেস ভাড়া করে পড়লো। দেখাদেখি আমরা সবাই সেই ড্রেস ৫০ রুপি দিয়ে ভাড়া করে পড়লাম আর ছবি তুললাম। অবনীকে মাঝখানে রেখে আমরা গোল হয়ে সবাই নাচতে লাগলাম। কোন কথা নাই, সুর নাই- তবে আনন্দের কোন কমতি ছিলো না। আমাদের কি যে ভালো লাগছিলো তা আর বলার মত না। আমরা বরফে ডুবে ডুবে ছবি তুলছিলাম। বল ছোড়া তো ছিলই, এছাড়া বরফে শুয়ে বাটারফ্লাই তৈরি করার চেষ্টাও করছিলাম আমরা। এত দৌড় ঝাপ করতে করতে আমার এক রকম গরমই লাগছিলো। তারপর শুনলাম অনেকেই বলছে যে তাদেরও গরম লাগছে। এর মধ্যে নিশাত হাসি মুখে জানালো যে ওর নাক থেকে নাকি রক্ত পড়ছে। বরফে আসলে অনেকেরই এমন হয় শুনেছি, সেদিন সামনা সামনি দেখলাম। আমাদের আশেপাশে যেসব কুকুর ঘোরাফিরা করছিলো তারা দেখতে অনেকটা নেকড়ের মত। এ ছাড়াও আস্ত এক চমড়ি গাই বিশাল শরীর নিয়ে বড়লোকি চালে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিলো। এদের সাথে ফটো তুললে মালিককে ভাড়া দিতে হয়। কেউ কেউ ফ্লাস্কে করে চা কফি বিক্রি করছিলো। আর কয়েকজন আবার কৌটায় করে ‘খাঁটি’ জাফরান নিয়ে সবার পিছে পিছে ঘুরতে লাগলো। ছেলেরা কয়েকজন ‘খাঁটি’ জাফরান কিনে ফেললো প্রায় পানির দরে। আস্তে আস্তে তুষারপাত কমতে কমতে এক সময় থেমেই গেলো। তখন চারদিক একটু একটু করে পরিষ্কার হতে লাগলো।

ওর
আস্তে আস্তে কুয়াশা সরে দূরের রহস্যময় পাহাড়গুলো উঁকি দিতে লাগলো (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম। দূরের বরফ ঢাকা পাহাড়গুলো যেন কেমন বেহেশ্ত থেকে এসেছে বলে মনে হলো। সাদা রঙের আলো ছায়ার খেলা চলতে লাগলো সেই পাহাড়গুলোতে। হাল্কা ধূসর রঙের আকাশের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ সাদা রঙের আলোর পিছনে দূরের একেকটা পাহাড় অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলো, আবার পর মুহূর্তেই সেই সাদা কুয়াশার আলো সরে যেতেই পাহাড়গুলোকে দেখা যেতে লাগলো। আমরা চোখ সরাতে পারছিলাম না। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম সেই বেহেশ্তি দৃশ্য। ছোটবেলায় যখন স্টুডিওতে ছবি তুলতে যেতাম তখন পিছনে ব্যাকগ্রাউন্ডে কাঁচা হাতে আঁকা বরফের পাহাড়ের দৃশ্য দেখতাম। আমার মনে হলো ঠিক যেন সেই রকম কোন স্টুডিওর ব্যাকগ্রাউন্ড আমি দেখতে পাচ্ছি। তবে শিল্পী যখন আল্লাহ নিজেই, তখন  ওয়ার্কম্যানশিপ কোন লেভেলের হবে সেই প্রশ্ন না করে নিজে থেকেই বুঝে নেওয়া ভালো। এই রকম মনোমুগ্ধকর জায়গা থেকে আমাদের নড়তে কোনই ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু কমিটির লোকজন তাড়া দিতে লাগলো কারণ আবার আকাশ কালো হয়ে যাচ্ছে। তার মানে আবার সেই তুষারপাত শুরু হতে পারে। আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আগেই আমাদের হোটেলে পৌঁছানো দরকার।

এফ
ট্যুরের মধ্যে সবচেয়ে আনন্দময় দিনে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আমরা আগের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে সেই দোকানে গেলাম। ওখানে ড্রেস ফেরত দিয়ে আবার জিপে চেপে বসলাম। যখন হোটেলে পৌঁছালাম তখন প্রায় দেড়টা বাজে। হোটেলে না গিয়ে সোজা আগের দিনের সেই খাওয়ার দোকানে গিয়ে ঢুকলাম। এবার ৭৫ রুপি দিয়ে অর্ডার দিলাম ভেজ চপ্সুয়ে। আমরা কান্নুর সাথে দুষ্টামি করতে লাগলাম। কান্নুও পালটা  আমাদের ছাতা টেবিল থেকে টেনে ফেলে দিতে লাগলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চপ্সুয়ে আসলো। কি যে মজা, আহহহহহ!

রুবাইদা, মৌলি আর মজুমদার শপিং এ যাবে বললো। আমার একটু আরাম করতে ইচ্ছা করছিলো। আমি শপিং এ যাবো না ঠিক করলাম। মজুমদারের কথা অনুযায়ী খুঁজে খুঁজে ভোদাফোন রিচার্জের একটা দোকান বের করলাম। সেখানের লোকটা বললো ২১৪ রুপি রিচার্জ করতে হলে ২২২ রুপি দিতে হবে। আমি তার কারণ জানতে চাইলে লোকটা জানালো যেহেতু আমারটা কলকাতার সিম, তাই কলকাতার বাইরে রিচার্জ করতে হলে বাড়তি চার্জ দিতে হবে। এই রকম আজাইরা নিয়ম শুনে মেজাজ আমার খারাপ হয়ে গেলো। কিছু না বলে তাও রিচার্জ করে নিলাম। তারপর সিমলা থেকে মজুমদারের কিনে দেওয়া ২০ রুপির কার্ড বের করে উনাকে বললাম রিচার্জ করে দিতে। লোকটা চাঁদ মুখ করে বললো মানালির বাইরে থেকে কেনা কার্ড মানালিতে রিচার্জ হবে না। এই কার্ড রিচার্জ করতে চাইলে আমাকে সিমলা যেতে হবে। শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। এ কি দেশ রে বাবা! সেই চন্ডীগড়ের শেষের দিক থেকে রিচার্জ খুঁজতে খুঁজতে এই মানালিতে এসে রিচার্জ করতে পারলাম তাও ৮ রুপি বাড়তি দিয়ে, আবার বলে এক শহরের কার্ড অন্য শহরে কাজ করবে না। এরা যদি বাংলাদেশের মোবাইল কোম্পানিগুলার সার্ভিসের অবস্থা দেখতো তাহলে মনে হয় মাথা ঘুরে পড়েই যেতো।

আমি হোটেলে ফিরে নিরিবিলি নামাজ আদায় করে লেপ, কম্বলের নিচে ঢুকে শুয়ে থাকলাম। ঘুম তেমন আসলো না। তবে বিশ্রাম হলো। এক সময় অন্তরা আসলো গল্প করতে, আমরা অনেকক্ষন গল্প করলাম। দেখতে দেখতে ঝুপ করেই সন্ধ্যা নামলো। আমি মাগরিবের নামাজ পড়ে আম্মু, বড় মামা আর মিজান আংকেলকে ফোন দিলাম। কিছুক্ষণ পর মজুমদার, মৌলি আর রুবাইদা শপিং করে ফেরত আসলো। রুবাইদা কি কি কিনেছে দেখালো। বাইরে হঠাৎ গান শুনতে পেলাম। অন্তরা বললো মনে হয় আমাদের পার্টির গান। আমি বললাম তাই বলে এত আগে গান ছাড়বে। মজুমদার আর মৌলি বললো নিচে আমাদের পার্টির জন্যই গান হচ্ছে। ডিজে আনা হয়েছে নাকি। মৌলি আর মজুমদার নিচে নাচানাচি করতে চলে গেলো। রাত ৯টার দিকে আমি আর রুবাইদাও বের হলাম। আমরা প্রথমে গেলাম গাম বুট আর ছাতা ফেরত দিতে। নিজেদের জুতা পরে আমরা আসলাম আমাদের পার্টির স্থানে।

খোলা আকাশের নিচে কতগুলো চ্যালাকাঠ জমা করে আগুন জ্বালানো হয়েছে। তার একপাশে এক ডিজে ফিউশন করা মিউজিক বাজাচ্ছে আর তালে তালে আগুনের চারপাশে সবাই গোল হয়ে নাচানাচি করছে। দেয়ালের পাশে হাফ ওয়ালে যারা টায়ার্ড হয়ে যাচ্ছে তারা বসে কিছুক্ষন রেস্ট নিচ্ছে, রেস্ট নেওয়া হয়ে গেলেই আবার নাচতে চলে যাচ্ছে। রুবাইদা বললো যে ও রুমে গিয়ে বসে থাকতে চায়। আমি বললাম ঠিক আছে, খাওয়ার সময় হলে আমি ডেকে দিবো। রুবাইদা চলে গেলে আমি হাফ ওয়ালের উপর বসে পড়ি। আমার খুব ভালো লাগছিলো। সবার চোখেমুখে এক ধরনের আনন্দের ঝিলিক। এই নাচের মধ্যেই মাঝে মাঝে কয়েকজন মিলে আলাদা হয়ে পড়ছিলো, তখন আবার বাকি সবাই মিলে তাদের পচাচ্ছিলো। কিছুক্ষন পর মায়িশা এসে আমার সাথে যোগ দেয়। আমরা দুইজন শুধু বসে থাকি আর অন্যদের দেখতে থাকি। এর মধ্যে জুবায়ের এক জগ গরম পানি এনে দেয়। সবাই খুব মাঞ্জা মেরে গরম পানি জগ থেকে ঢোঁক দিয়ে খেতে থাকে। আমি সবাইকে দেখছিলাম, অন্তরা, ঐশি, কৌশিক, নিলয়, নোভা, তুষার, জাফর, মজুমদার, মৌলি, সৃষ্টি, সৌরভ, সীমান্ত আফরা, হিমি, আদিবা – সবাইকে। সবার আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিলো যেন আমাদের জীবনে কোন দুঃখ নাই, কোন দিন ছিলোও না। এ জীবন যেন শুধুই আনন্দের।

নাচানাচি শেষ করে আমরা খাওয়ার রুমে গেলাম। সেখানে আমাদের জন্য বুফে ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাত, সবজি, মুরগি, ডাল, গাজরের সালাদ আর গরম পানি। জুবায়ের আশ্বস্ত করলো যে প্রত্যেকটা মুরগি ও নিজে জবাই করেছে। আমি রুবাইদাকে ডেকে আনলাম। তারপর সবাই খেতে বসলাম। মেনুটা যত বাঙ্গালি বলে মনে হয়, স্বাদটা ততটা নয়। সবগুলো খাবারই ঝাল। তবে সবজিটা অনেক মজা ছিলো। আর সাথে গরম পানিটাও খুব ভালো লাগছিলো। অনেকদিন পর সালাদ হিসেবে পাওয়া গাজর খেতেও মন্দ লাগছিলো না। যাই হোক আমরা খুব উপভোগ করলাম আমাদের খাওয়া। খাওয়া শেষে হাত ধুতে গেলাম যখন কলের পানিতে, আমার মনে হলো ঠান্ডা পানির স্রোতে আমার পুরা হাত অবশ হয়ে গেছে। খাওয়ার পর ঘোষণা আসলো, আমাদের জন্য মানালির বিখ্যাত তাজা ফলের সিরাপ কেনা হয়েছে। আমরা যেন কমিটির রুমে গিয়ে সিরাপ দিয়ে বানানো জুস খেয়ে আসি। আমরা ডাইনিঙ্গের সিড়ি বেয়ে কমিটির চার তলার রুমে উঠলাম।

সেটা ছিলো হানিমুন স্যুট। চৌচালা রুফের নিচে এত্ত সুন্দর একটা রুম যা দেখেই আমাদের সবার মাথা ঘুরে গেলো। আমরা সবাই মাটিতে পাতা কার্পেটের উপর বসলাম। বিছানায় বসে শুভ আমাদের মধ্যে কাল্পনিক একটা লাইন টেনে বললো দুই দলের মধ্যে গানের কলি খেলা হবে। ব্যাস আর যায় কই, সবাই হৈ হৈ করে গান যুদ্ধে নেমে পড়লো। এই হোটেলে আমরা ছাড়া আর কেউ নাই। তাই আমাদের গলা ছেড়ে গান গাওয়ার পাশাপাশি হৈচৈ চিৎকার করতে কোনই বাধা রইলো না। জোরসে শুরু হলো গান গাওয়ার পাশাপাশি আমাদের আড্ডাবাজী। আর অন্য পাশে জুবায়ের সোফায় বসে এক গ্লাস এক গ্লাস করে জুস বানাতে লাগলো। তারপর রিজভী সেগুলোকে ছোট ছোট ওয়ান টাইম কাপে ঢেলে এক কাপ এক কাপ করে সবার মধ্যে পাস করতে লাগলো। তারপর আমি উঠে গেলাম ওদের সাহায্য করতে। একটা ছোট ট্রেতে রিজভীকে বললাম কাপগুলো তুলে দিতে। আমি সেই ট্রেটা নিয়ে সবার কাছে কাছে গিয়ে এক কাপ এক কাপ করে জুস দিতে লাগলাম।

দে
ঠান্ডার রাতে জুস খেতে ব্যস্ত সবাই (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

ওদিকে গান যুদ্ধ খুব জমে উঠেছে। জাফর আর উর্মি একসাথে চড়াও হয়ে উঠছে অন্য দলের উপর। অন্য দলের নোভা আর মজুমদারও সমান সমান লড়ে যাচ্ছে। জাফর তো আরও সাংঘাতিক, ও এতই সিরিয়াস গানের ব্যাপারে যে বেশ কয়েকবার ভুল করে সে অন্য দলের পক্ষ হয়ে গানও গেয়ে ফেললো। আর ওদিকে জুবায়ের দ্যা জুস মেকার জুস বানিয়ে যেতেই লাগলো, রিজভী দ্যা সাপ্লাইয়ার কাপে জুস ঢেলে দিতে লাগলো আর আমি পাঁচ ছয় রাউন্ড করে জুস বিলি করতে লাগলাম। দুইটা ফ্লেভারের জুস ছিলো। জুসটা এতই ভালো ছিলো যে কারও সামনে নিয়ে যখন জিজ্ঞেস করতাম, ‘দিবো?’ সে বিনা দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে কাপটা তুলে নিতো।

এই করতে করতে কখন যে রাত সাড়ে ১২টা বেজে গেলো টেরই পাই নাই। এক সময় আমাদের আসর ভেঙ্গে গেলো। সবাই কমিটিকে ধন্যবাদ দিয়ে যার যার রুমে ফেরত গেলো। সেই আগের মতন আমরা সবাই লেপ কম্বলের নিচে চাপা পড়ে ঘুমাতে লাগলাম।

 

The Mighty INDIA CALLING: বিশ্রী ঠান্ডার দিনে ‘গোয়েল’ এর সাথে পরিচয় (পর্ব ৭)

সকাল বেলা যখন হিমি আর লিয়ার ফোন বেজে ওঠে, তখনো আমি কানে কবুতরের আওয়াজ শুনছিলাম। আমরা কম্বলের তলা থেকে মাথা বের করে দেখলাম বাইরে অন্ধকার। ঘড়িতে দেখি ৯ টা বাজে। আমরা ধড়মড় করে উঠে বসি। ৯ টার সময়ই তো আমাদের বের হওয়ার কথা। তাড়াহুড়া করে আমরা রেডি হই। নাশতা করার সময় নাই, আবার গত রাতেও কিছু খাই নাই। কোন উপায় না দেখে দেশ থেকে নিয়ে আসা কেকগুলো খেয়ে ফেললাম। কি পরে বাইরে যাবো সেই চিন্তায় পড়লাম। কারণ এখানকার ওয়েদার খুবই কনফিউজিং। রোদ গায়ে লাগলে গরম, আবার একটু পরেই কনকনে ঠান্ডা। ভেবে চিনতে তিনটা সোয়েটার, কানটুপি, মাফলার, দুইজোড়া হাতমোজা সবই নিয়ে বের হলাম। যখন যেটা লাগবে সেটা পরা যাবে।

আমরা নিচে নেমে বসে রইলাম। এমন সময় এক লোক হাতুড়ি নিয়ে হাজির হলো তমার লাগেজের তালা ভাঙ্গার জন্য। সেই যে হাওড়া স্টেশনে ওর পার্স চুরি গেছে, তারপর থেকে ও আর ওর ব্যাগ খুলতে পারে নাই। হোটেল থেকে এখন একজনকে পাঠিয়েছে সেই তালা ভাঙ্গার জন্য। আমি আর তমা গেলাম একসাথে ওদের রুমে। লোকটা তালাটা ভাঙতেই আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম ‘আলহামদুলিল্লাহ’। উনি অবাক হয়ে হিন্দিতে বলে, ‘আপনি মুসলমান?’। আমার উত্তর শুনে উনি জানায় উনিও মুসলমান। জানতে চায় আমাদের দেশের সবাই মুসলমান কিনা, যারা এখানে এসেছি তারা সবাই মুসলমান কিনা। তমা শেষে উনাকে বখশিশ দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় করে।

১১টার দিকে আমরা হোটেল থেকে বের হয়েই টের পেলাম ওয়েদার মোটেও সুবিধা জনক নয়। আকাশ মেঘলা আর কনকনে ঠান্ডা। আমরা গলি দিয়ে বের হয়ে প্রথম বারের মতন আমাদের ভাড়া করা বাসটা দেখতে পেলাম। ক্যাটক্যাটে কমলা রঙের বাস, গায়ে লিখা ‘গোয়েল টুরিস্ট’। গোয়েলের সাথে সেই আমাদের প্রথম দেখা। আগামী ২১ দিনের জন্য বাসটা ভাড়া করা হয়েছে। এই ২১ দিনে আমাদের একটা বড় সময় এই বাসের ভিতর কাটবে। এইসব ভাবতে ভাবতে বাসের ভিতর উঠে বসলাম। দরজা দিয়ে ঢুকে ইঞ্জিন আর ড্রাইভারের সিটটা পার হবার পর আরেকটা দরজা, তারপর আমাদের বসার জায়গা। বাসটার ভেতরের ইন্টেরিওর কেমন জানি বিয়ে বাড়ির মতন। জানালায় লাল রঙের ঝালর লাগানো, সিটগুলো উজ্জ্বল লাল- বেশির ভাগেরই প্যাকেট খোলা হয় নাই, আর সামনে খুবই অদ্ভূত এক পেইন্টিং টানানো। আমরা সবাই কোন মতে বসে পড়লাম। কয়েকটা সিট খালি। দেখা গেল সুহাইলাসহ আরও কয়েকজন আসে নাই। ওদের আবার খবর দিয়ে আনা হলো। যাই হোক আমাদের যাত্রা শুরু হলো। প্রথম গন্তব্য কুতুব মিনার।

পথেই আমরা ইন্ডিয়া গেট দেখলাম। যখন কুতুব মিনারে পৌঁছাই তখন চারপাশে ঘন কুয়াশা। কুতুব মিনার আমরা ঠিকমত দেখতেই পারছিলাম না। ১০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে গেট দিয়ে ঢুকেই আমাদের সাথে ০৯ ব্যাচের আপু ভাইয়াদের সাথে দেখা হলো। ওনারা সিমলা মানালি ঘুরে আবার দিল্লী এসেছেন। ওনাদের সাথে হাই হ্যাল্লো করতে করতেই বৃষ্টি শুরু হলো। একে তো ঝাপসা কুয়াশা ছিলোই, তার সাথে বৃষ্টিটা শীতটাকে আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে দিলো। আমরা একটু আশ্রয়ের জন্য ছুটতে লাগলাম এদিক ওদিক। ক্যামেরা স্কার্ফ দিয়ে পেচিয়ে ব্যাগে ভরলাম। কুতুব মিনার তো ঠিকমত দেখা হলোই না বরং মেজাজ খারাপ করে বৃষ্টিটা থামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এত মানুষের কাছ থেকে সাজেশন নেওয়া হয়েছে, কেউ কোনদিন ছাতা নেওয়ার কথা বলে নাই। পুরা ব্যাচের ৪৬ জনের মধ্যে কারও কাছে ছাতা নাই। আমার বেশ মন খারাপ হলো।একটা বিশাল স্থাপনার নিচে সবাই পোজ মেরে সেলফি তুলতে লাগলো। আমি মেজাজ খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।

দ
বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে কুতুব মিনারের সামনে কয়েকজন দ্বিমিকবাসী ও শূণ্যয় সদস্য (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

খনিক পর যখন মনে হলো বৃষ্টিটা কমে গিয়েছে, তখন আমরা ঝটপট বের হয়ে দৌড় দিলাম। কনকনে ঠান্ডা আমাদের হাড় ভেদ করে ঢুকতে লাগলো। কোন রকম বাসে উঠে আমরা বসলাম। হাত দুইটা বারবার অসাড় হয়ে যাচ্ছিলো, ঠান্ডাকে বকতে বকতে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। আমরা ৩ টার দিকে পৌঁছালাম লোটাস টেম্পলে। কাঁপতে কাঁপতে আমরা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার পাশে হঠাৎ ০৯ এর বাস দেখলাম। আমরা কয়েকজন সেখানে উঠে আপুদের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। আপুরা বললো ওনারা সিমলা, মানালিতেও এই রকম বিশ্রী ঠান্ডা পায় নাই। আমাদের তাড়াতাড়ি করে  দিল্লী থেকেই দুই সেট ইনার কিনে নিতে বললো। আমরা কিছুক্ষন কথা বলে ওনাদের বাস থেকে নেমে হাঁটা দিলাম।

ঝাপসা কুয়াশাময় পরিবেশে লোটাস টেম্পলটা বাইরে থেকে দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো। কিন্তু কাছে গিয়ে যখন জানতে পারলাম ভিতরে জুতা খুলে ঢুকতে হবে, তখন আমার মেজাজটা গরম হয়ে গেলো। এই ঠান্ডার মধ্যে জুতা খুললে আমার নির্ঘাত নিউমোনিয়া হয়ে যাবে, তার উপর বৃষ্টি ভেজা রাস্তা- জুতা খোলার তো প্রশ্নই আসে না। আমি পিছু হটলাম। আমার সাথে মৌলিও যোগ দিলো। আমরা আবার হেঁটে হেঁটে বাসের দিকে যেতে লাগলাম। মাঝখানে রাস্তার পাশে পার্ক করা একটা বাসের ইঞ্জিন থেকে গরম ভাপ বের হচ্ছিলো। আমি আর মৌলি বাসের সাথে গা লাগিয়ে খানিক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ আরাম লাগছিলো আমাদের। আমরা হাত আর পিঠ সেক দিয়ে বেশ উষ্ণ করে নিলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে গোয়েলে এসে পৌঁছালাম। পুরো বাসে আমি, মৌলি আর চিং।

অনেক্ষন পরে সবাই যখন ফেরত আসলো তখন সবাই বলতে লাগলো আমরা নাকি মিস করেছি, ভেতরটা অনেক সুন্দর ছিলো, কষ্ট করে ঢুকলেই পারতাম। আমার কোন আফসোস রইলো না- আমি ভাই এত ঠান্ডা সহ্য করতে পারতাম কিনা সন্দেহ। যাই হোক অনেক বেলা হয়ে গেছে কিন্তু কোন খাওয়া হয় নাই। আমরা আবার রওয়ানা দিলাম। এবার যাচ্ছি জামে মসজিদ। বাসেই ডিসিশোন হলো, ঠান্ডা আর বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ইনার আর রেইনকোট কেনা দরকার। ধারে কাছে মার্কেট আছে, মেম বাজার আর পাল্লিকা বাজার। আজকে রাতেই যেকোন একটাতে গিয়ে কেনাকাটা করতে হবে।

জামে মসজিদের কাছাকাছি পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের ৬টা বেজে গেলো। বাস থেকে নেমে রাস্তা ক্রস করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। পাকা রাস্তা পার হয়ে কাঁচা রাস্তা আসলো। সেই রাস্তা নোংরা থেকে নোংরাতর হতে লাগলো। বৃষ্টিতে, কাদায় আর ময়লায় মাখামাখি হয়ে যাওয়া রাস্তায় আমরা অত্যন্ত সাবধানে হাঁটতে লাগলাম। দুইপাশে মুসলমান দোকানপাট দেখা গেলো। জামা কাপড়, তসবি টুপি, জায়নামাজ, রোরখা, আতর, ডেকচি, হাড়ি পাতিল, জুতা স্যান্ডেল – কি নেই সেখানে! এত ময়লা কাদা পার হয়ে জামে মসজিদে আর আমরা কেউ ঢুকলাম না। পাশ দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছি তখনই নাকে কাবাবের গন্ধ লাগলো। দেখলাম সারি সারি খাবারের দোকান। সেখানে বিরিয়ানি আর শিকের মধ্যে গাঁথা ঝলসানো মাংস থেকে ভুরভুর করে সুগন্ধ বের হচ্ছে। জিভে আমাদের পানি চলে আসলো। কত দিন মাংস খাই না!

আমরা কয়েক ভাগ হয়ে একেক দোকানে ঢুকে পড়লাম। অনেকে গেলো ‘করিমস’ হোটেলে। আমি, রুবাইদা, আদিবা আরও কয়েকজন ‘সুবহানাল্লাহ’ নামের এক দোকানে ঢুকে বিফ বিরিয়ানি অর্ডার দিলাম। ওরা বলেই দিলো যে ইন্ডিয়ার বিফ আসলে মহিষ, তারপরও ৫০ রুপিতে বাসমতি চালের বিরিয়ানি খেয়ে ভালোই লাগলো। ওখানে খেয়ে দেয়ে বের হয়েই দারুন এক মিষ্টির দোকান চোখে পড়লো। দোকানের নাম ‘কল্যান সুইটস’। এখানকার মিষ্টির দোকান আমাদের মিষ্টির দোকানের চাইতে আলাদা। দোকানের ভিতর বড় বড় থালার মধ্যে হালুয়া জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। কোনটা বাদামের হালুয়া, কোনটা শাহী হালুয়া। আর সামনের কাঁচের শোকেসে সারি সারি মাটির বড় বড় গ্লাসে লাচ্ছি, বাদাম দুধ সাজানো। অন্য পাশে হরেক রকমের মিষ্টি- লাল মোহন যেটাকে ওরা বলে গুলাব্জামুন, বাদামের বরফি, রঙ বেরঙ্গের মিষ্টি দেখে আমার জিভে পানি চলে আসলো। কিন্তু মাত্রই বিরিয়ানি খেয়ে পেট ভরে রেখেছি, আবার রাতে জার্নিও আছে। তাই খাওয়ার আগে আমরা একেকটা মিষ্টির নাম জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। দোকানের লোকটা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপ কাঁহাসে হো, হায়দ্রাবাদ?’ আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘ বাংলাদেশ’।

দোকানের লোকটা আমাদের ফ্রিতে হালুয়া আর শাহী টুকরা টেস্ট করতে দিলো। দুটোই মজা ছিলো। লিয়া লাচ্ছি খেলো আর তানভীর বাদাম দুধ খেলো। ওদের লাচ্ছি অনেক ঘন, চামচে করে খেতে হয়। দোকান থেকে বের হওয়ার পর তানভীর জানায় বাদাম দুধটা অসম্ভব মজা ছিলো। তানভীরের উপর রাগ লাগলো, আরেকটু আগে বললেই আমি এক গ্লাস খেতে পারতাম। রাত হয়ে গেছে, আমরা ফেরার পথ ধরলাম। সেই ময়লা, নোংরা রাস্তা হেঁটে আমরা আবার বাসে উঠে বসলাম। রাত হয়ে যাওয়ায় সব মার্কেট বন্ধ হয়ে গেছে ভেবে আমরা সরাসরি হোটেলে ফেরত যাই।

হোটেলে গিয়ে শুনতে পারি লিয়া গেছে মার্কেটে। আমি লিয়াকে ফোন দিয়ে বলে দেই আমার জন্য একটা ইনার কিনে আনতে। আমরা ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হতে থাকি। ওদিকে লিয়াও ফেরত আসে। ও ৫৫০ রুপি দিয়ে সুখান্দ কোম্পানির ইনার কিনে আনে। আমার ইনার আমি ট্রায়াল দিয়ে দেখি, বেশ গরম বলেই মনে হয়। এই জিনিস পরে যদি গরম লাগে তাহলে বাসে খুব অশান্তি লাগবে ভেবে আমি ইনারটা না পরেই রেডি হই।

হোটেলের এক্টামাত্র ছোট্ট লিফট দিয়ে মালপত্র নামিয়ে আমরা নিচে ওয়েট করি। রাত ১২টা- ১টার দিকে আমরা মালপত্র নিয়ে বাসে উঠে বসি। সারা বেশ ছটফট করতে লাগলো। ওর ইনার পরে খুব অশান্তি লাগছে। বেচারি খুলতেও পারছে না আবার স্বস্তিও পাচ্ছে না। আমি ব্যাগ থেকে কম্বল বের করে গায়ে দিলাম। কম্বলের নিচে ভাবতে থাকি দিল্লী শহরটা তাড়াতাড়ি ছাড়তে পারলেই বাঁচি। এখানকার মানুষজন ভালো না, আবহাওয়া খুবই অসহ্যকর, রাস্তাঘাট মরা মরা। এই পচাঁ শহরটা থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। এইসব ভাবতে ভাবতে আর বাসের দুলুনিতে ঘুম পেয়ে গেলো। কখনও ভাবি নাই যে বাসে আমি ঘুমাতে পারবো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার দুই চোখ কিছুক্ষনের মধ্যেই গভীর ঘুমে বুজে আসলো।

 

 

 

The Mighty INDIA TOUR: কোলকাতা টু দিল্লী বাই ‘কলকা মেল’ (পর্ব ৫)

আমার পাশের চেয়ারে সম্ভবত লিয়া বসেছিলো। লিয়ার কম্বলটায় ভাগ বসিয়ে সারা রাত এপাশ ওপাশ করলাম। এক পর্যায়ে কে জানি বললো সামনে নিচে শুয়ে আছে এক মহিলা, তার আচরণ সন্দেহজনক। মহিলাকে নজরে রাখা দরকার। সবাই পালাক্রমে মহিলার উপর চোখ রাখতে লাগলো। অবনীকে দেখলাম চেয়ার ছেড়ে উঠে নিচে শাল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা অপরিচিত মহিলাদের মাঝে ঘুমিয়ে পড়তে। অবনীর এই স্বভাবটা ভালো, যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়তে পারে।

প্রচন্ড ঠান্ডায় আমরা জমে যাচ্ছিলাম। মোটা সোয়েটার, কানটুপি, কম্বল কিছুতেই শীত মানছিলো না। আমি লাগেজ খুলে ওভারকোট বের করে পড়ে নিলাম। সাড়ে পাঁচটা থেকেই সবাই আস্তে আস্তে উঠতে লাগলো। ফ্রেশ টেশ হয়ে আমরা সবকিছু গুছিয়ে রাখলাম। অবনীও ঘুম থেকে উঠলো। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম অবনী যাদের সাথে ঘুমিয়েছে তারা হিজড়া। তবে এখানকার হিজড়ারা মোটেও ভীতিকর কিছু নয়। তারাও ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে লাগলো।

৬টার দিকে আমরা আবার নিচে নেমে জন আহারে নাস্তা খেতে গেলাম। অর্ডার দিলাম ২৫ রুপির ভেজ কাটলেট আর বাটার পাউরুটি। ভেজ কাটলেটটা অদ্ভুত লাল রঙের, খেতে ভালো না। তাড়াতাড়ি করে খেয়ে আমরা উপরে উঠে লাগেজ নামাতে লাগলাম। একটা মাত্র লিফট। সবাই দৌড়াদৌড়ি করে নামতে লাগলো। সাড়ে ছয়টার সময় আমরা নেমে দৌড় দিলাম ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু কোন ট্রেন আসে নাই দেখে আমরা ইতস্তত দাঁড়িয়ে রইলাম।

এত মানুষের জটলা দেখে স্টেশনের কয়েকজন গার্ড টাইপের লোক এগিয়ে আসলো। শুভ তখন আমাদের টিকেট দেখালো। উনারা বললো ট্রেন অত্যন্ত কম সময়ের জন্য থামবে। বগি নম্বর দেখে এক্ষুনি আমাদের দৌড়ে প্ল্যাটফর্মের যার যার বগি নম্বর লিখা জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে থাকা দরকার। না হলে উঠার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিবে। শুনে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। জুবায়ের, শুভ চিৎকার করে আমাদের সিট নম্বর আর বগি নম্বর বলতে লাগলো। আমরা একেকজন একেক বগিতে পড়েছি। সবার চেহারা রক্তশূন্য হয়ে পড়লো। অনেকেই বগি নম্বর জেনে দৌড়াতে লাগলো। আমার বগি নম্বর এস থ্রি আর সিট নম্বর ৬৭। শুনে আমি পাগলের মত লাগেজ নিয়ে দৌড়াতে লাগলাম। এর মধ্যে ট্রেন চলে আসলো। পিঠে ব্যাকপ্যাক, কাঁধে হ্যান্ড ব্যাগ আর হাতে ট্রলি এই নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় দেখলাম বগি নম্বর এস ওয়ান, বগি নম্বর এস টু- কিন্তু তারপর বগি নম্বর এ ওয়ান! এরপর এগিয়ে দেখলাম বগি এ টু। মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো আমার। এখন আবার আমাকে এ বি সি ডি শুরু করে এস পর্যন্ত দৌড়াতে হবে? তার মানে আমি নিশ্চয়ই ট্রেন মিস করবো। আমার মাথায় কি ঘটে গেল আমি জানি না। আবার দৌড় শুরু করলাম। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ানোর এক পর্যায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আমার আশেপাশে পরিচিত কেউ নাই। কি করবো এখন? একে তো বগি খুঁজে পাচ্ছি না, তার উপর হাতে কোন টিকেট নাই। ট্রেনটাও যে কোন সময় ছেড়ে দিবে। কি হবে আমার?

হঠাৎ তানভীরকে দেখলাম ওর সুটকেসটা নিয়ে দৌড়াতে। পরিচিত একজনকে পেয়ে আমি আবার দৌড়াতে শুরু করলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় তানভীর ওর বগি পেয়ে গেলো। তারও কয়েকটা বগি পার হয়ে আমি আমার কাংখিত এস থ্রি লিখা বগি খুঁজে পেলাম। কোনমতে ট্রলিটা টেনে বগিতে উঠলাম। বেশি খুঁজতে হলো না, একটা খোপ পার হয়েই ৬৭ নম্বর সিট খুঁজে পেলাম। আমি তখনও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। এর মধ্যে নিলয়, উর্মি আর চিং হাপাতে হাপাতে লাগেজ টেনে টেনে আমার খোপের মধ্যে আসলো।

আমরা দ্রুত আমাদের লাগেজগুলা সিটের নিচে রেখে ভালো করে তালা মারতে লাগলাম। একটু পর আবিষ্কার করলাম আমরা চারজন ছাড়াও আরও চারজনের সিট আছে এই খোপের মধ্যে, তারা যেহেতু আমাদের কেউ না- অবশ্যই তারা ‘বিদেশি’ মানুষ। চারজন ‘বিদেশি’ মানুষের সাথে একই খোপে আগামী প্রায় দেড় দিন কাটাতে হবে ভাবতেই আমাদের মেজাজ বিগড়ে গেলো। উর্মি মারাত্মক টেনশনে পড়ে গেলো। ও এক্সট্রা প্রটেকশন স্বরূপ আরও শিকল তালা কিনে ওর লাগেজে জড়াতে লাগলো। আর আমাদের এক খোপ পাশেই ট্রেনের ক্লিনার টাইপের লোকদের বসার ব্যবস্থা। বাংলাদেশি শুনে ওনারা বারবার সাবধান করে দিতে লাগলো আর বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন চুরির কথা মনে করিয়ে দিতে লাগলো। ওনাদের সাবধানতা অমান্য করার ফলে কেমন করে যাত্রীদের মোবাইল আর লাগেজ চুরি গেছে সেই সব কাহিনী বারবার বলতে লাগলো। সেই সব শুনে উর্মির ভয় আরও চৌদ্দগুন বেড়ে গেলো।

ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে টের পাচ্ছি মায়িশাদের কামরাতে কোন একটা গন্ডোগোল লেগেছে। কমিটির কয়েকজন অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করছে। খানিক পরেই মায়িশা আর ঐশি ওদের লাগেজ টানতে টানতে রাগে গজগজ করতে করতে জাফরের সাথে আমাদের কামরা ক্রস করলো। ওদের কামরার সহযাত্রী কি সব জানি ঝামেলা করেছে তাই ওরা জাফর আর রাফাতের সাথে সিট বদল করছে। সব দেখে উর্মির প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। তখন চিং আর নিলয় একের পর এক সান্তনা দিতে লাগলো। কয়েক মিনিট পর আমরা চিন্তা করলাম যে এখনো যেহেতু কোন বাইরের লোক আসে নাই তাহলে দেখাই যাক না কি হয়। যখন কেউ আসবে তখন দেখা যাবে। তার আগ পর্যন্ত আমরা চারজন মিলে আটটা সিট ব্যাগ রেখে দখল করে রাখলাম। তারপর আমরা ঘুরতে বের হলাম।

আমাদের পাশের খোপেই রিজভী, আফরা আর ইশ্তিয়াক ছিলো। আমরা হেঁটে হেঁটে এক কামরা থেকে বাম দিকে অন্য কামরায় যাই। বেচারা হিমির জ্বর। ওকে দেখলাম ওর সহযাত্রী মহিলার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকতে। একই খোপে রুবাইদাও ছিলো। ওর সাথে খানিক্ষণ গল্প করলাম। তারপর আরও সামনে গেলাম। সবশেষে নিশাত, অদিতিসহ ওরা ছয়টা মেয়ে একসাথে বসে ছিলো। এরপর একটা দলের সাথেই শুধু দেখা হওয়া বাকি ছিলো। সেটা প্রায় ২২ টা বগি পরে জেরিন, ফাহাদের দল। আলসেমির জন্য সেটাতে আর গেলাম না। আমাদের কামরার ডান দিকে অন্য কামরায় জাফর, রাফাত, মৌলি আর মজুমদারকে বসে থাকতে দেখলাম। ছাড়া ছাড়া ভাবে সিট পড়ায় সব খানে সবার মন কমবেশি খারাপ দেখেছিলাম। কিন্তু এই বগিতে এক্সট্রিম থমথমে অবস্থা। কথা বলে জানলাম, সহযাত্রী আংকেলের সাথে মায়িশা আর ঐশির মনোমালিন্য হওয়ায় কেউই আর স্বাভাবিক হতে পারছে না।

সবার সাথে দেখা করে আমরা বুঝলাম যে আসলে আমরা সব থেকে ভালো অবস্থায় আছি। আমাদের এখনও পর্যন্ত কোন সহযাত্রী নাই। আমাদের কামরা বেশ আলো ঝলমলে এবং খোলামেলা। আর পাশেই ক্লিনাররা থাকায় একটু পর পর অনারা ঝাড়ু দিচ্ছিলো আর এয়ার ফ্রেশ্নার দিচ্ছিলো। আমাদের কাছাকাছি বাথরুমটাও পরিষ্কার- কোন গন্ধ নাই তবে বদনাও নাই। পানির কলটা আরও অদ্ভূত, টিপকল বলা চলে ঐটাকে। সব কিছু চিন্তা করে আমরা পজিটিভ মনোভাব নিয়ে বসি। যার যার মালপত্র সুন্দর করে গুছিয়ে খোশমেজাজে বসি।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদ উঠতে লাগলো। একটু পর পর বিভিন্ন ফেরিওয়ালা আমাদের পার হয়ে যেতে লাগলো। বাদাম, চিপস, ডালমুট, ছোলা ভুনা, সিংগারা, কালোজাম, ড্রিংকস, তালা চাবি, খেলনা, চা, নারিকেল কুচি আরও হাজারো রকমের জিনিস। আবার ট্রেনের নিজস্ব চা, চাওমিন, রাতের খাবার আর দুপুরের খাবার ছিলো। আমার বেশ ঘুম পাচ্ছিলো। আমি হ্যান্ড ব্যাগটা মাথার কাছে রেখে কম্বল জড়িয়ে ছোটখাটো একটা ঘুম দিলাম।

ঘুম থেকে উঠে আমি আর সুমাইয়া শেয়ারে লাঞ্চ খেলাম ভাত, সবজি আর ডিম। দাম পড়লো ১১০ রুপি। খাওয়া শেষে একটা লুডু কিনে আমরা চারজন খেলা শুরু করলাম। এর মধ্যে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি আর মায়িশা একটা বোতল কেটে ‘বদনা’ বানালাম। অনেকেই ঘুরতে আসলো আমাদের খোপের মধ্যে। আমাদের ‘ফার্স্ট ক্লাস’ আরাম দেখে সবাই ‘হিংসা’ করতে লাগলো। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেলো আমাদের পরিষ্কার বাথরুম আর ‘বদনা’র কথা। দূর দূরান্ত বগি থেকে লোকজন আমাদের খোপে আসতে লাগলো ‘বদনা’ নিয়ে পরিষ্কার বাথরুমে যাওয়ার জন্য। চারটা খালি সিট থাকায় অনেকেই বসে গল্পগুজব করে। এক পর্যায়ে আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখলে বাংলাদেশের মতই দেখা যায়। ফসলের মাঠ আর মাঠ, কিন্তু কোন ঘর বাড়ি নাই। তবে বাংলাদেশ অনেক বেশি কালারফুল, দেখতে বিরক্ত লাগে না। ট্রেন একেকটা স্টেশনে থামে আর তিন থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে দেয়। সবাই এর মধ্যেই ঝাঁপাঝাঁপি করে ওঠা নামা করে।

আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামতে থাকে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে শীত। আমরা অনেক গল্প করতে থাকি। এক সময় আবার অন্যদের সাথে দেখা করার জন্য ঘুরতে বের হই। অবাক হয়ে আবিষ্কার করি রুবাইদার পাশে বসে আছেন একজন সাধু বাবা। জীবনে কোনদিন সামনা সামনি সাধু দেখেছি বলে মনে হয় না। সাধু বাবার পরনে গেরুয়া বসন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে লাল সাদা ডোরাকাটা দেওয়া। বিস্তর চুল দাড়ির মধ্যে উনার হাসি হাসি মুখটা দেখা যাচ্ছে। ফাহাদ রুবাইদার উপরের সিটে বসে মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে ‘ রুবাইদার পাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ কথাটা লিখে রেখেছে। আর যেই সামনে দিয়ে যাচ্ছে তাকেই দেখাচ্ছে স্ক্রিনটা। সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে লিখাটা দেখে। আর আমাদের হাসি দেখে সাধু বাবাও বেশ মজা পাচ্ছেন। উনি হিন্দিতে একবার বলেই ফেললেন এই কথা। ঘুরতে ঘুরতে বুঝলাম সবার মন মেজাজ বেশ ভালো আর আমাদের ‘বদনা’ সুপার হিট। এর মধ্যে জুবায়েরের সাথে খানিক্ষণ কথা বললাম ট্যুর শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। আমি সব খুলে বললাম কি কি ভুল আমাদের হয়েছে, কি কি বিষয় আমাদের ক্লিয়ার করতে হবে, আর সবাইকে নিয়ে ট্যুরের উপর ওভারঅল একটা ব্রিফিংয়ের কথা বললাম। তারপর যখন নিজের কামরায় ফেরত যেতে থাকি তখন দেখি সাধু বাবা চলে গেছেন। রুবাইদা একাই বসে আছে। আসার সময় সামনে এক মহিলাকে দেখলাম দু হাতে দুই ভারি ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে। হিন্দিতে উনি বললেন উনার সিট এস ফোর এ। আমিও বললাম আমিও সেইদিকেই যাচ্ছি। উনি অনুরোধ করলেন উনার ব্যাগটা টেনে দেওয়ার জন্য। আমি টেনে দিলাম। এক পর্যায়ে উনাকে এস ফোরে নামিয়ে দিয়ে আমি গেলাম মজুমদারদের কাছে। জাফর এক বুদবুদ বানানোর খেলনা পিস্তল কিনে বাতাসে খালি বুদবুদ ওড়াচ্ছে। মৌলি একটা কাপে করে কি যেন খাচ্ছে, জিজ্ঞেস করতেই বললো ‘কাপল ড্যান্স”। জিনিসটা আসলে কাপ নুডুলস কিন্তু লোকগুলোর উচ্চারণ শুনে ওরা মনে করে কাপল ড্যান্স। কৌতুহলী হয়ে এক কাপ কিনতেই বোঝা যায় আসল রহস্য।

াফেদ
প্রচন্ড শীতের সাথে লড়াইরত দুই দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় সারাহ তাবাসসুম)

আমি যখন আবার ফিরে আসি তখন দেখি আমাদের খোপের সব চেয়ে উপরের দুইটা সিটে দুইজন লোক শুয়ে আছে আর নিচে একটু আগে পরিচয় হওয়া মহিলাটাকে টিটি টিকেট ইস্যু করে দিচ্ছেন আমাদের এখানে থাকার জন্য। মহিলার টিকেট নিয়ে কি যেন ঝামেলা হয়েছে। যাই হোক মহিলাকে আমরা নিচের একটা সিট ছেড়ে দেই। উনি ব্যাগ খুলে একটা ভর্তা হয়ে যাওয়া সুন্দর কেক বের করে আফসোস করতে থাকেন যে কেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের অবশ্য খাওয়ার জন্য সাধেন একবার। বলেন যে, ওনাদের কেকের দোকান আছে। স্বামী দিল্লী চাকরি করেন – তার জন্যই কেক নিয়ে যাচ্ছেন।

ডিনার করি আমি আর তমা শেয়ারে ১০০ রুপি দিয়ে। আইটেম ছিলো রুটি, চিজের টুকরা দেওয়া সবজি আর ডাল। সবাই ডিনার খেয়েদেয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করি। আমি নিচে, উর্মি আর চিং মাঝের দুই সিটে দুইজন। আর আমাদের সাথে ৯০ ডিগ্রী আঙ্গেলে নিচে নিলয়, ওর উপরের সিটটা একবার ফাঁকা থাকে একবার কেউ এসে বসে। নিলয় আমাদের সব গুলো ব্যাগ প্যাক নিয়ে ওর সিটে গুটিশুটি মেরে বসে থাকলো। আমরা অনেক বললাম ব্যাগগুলো নামিয়ে দিতে কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হলো না। বারবার বলতে লাগলো, তোরা ঘুমা, টেনশন করিস না, আমি জেগে আছি- বলে শাল মুড়ি দিয়ে বসে থাকলো।

আর আমি জানালার ফাঁক দিয়ে ঢোকা হিহি ঠান্ডা বাতাস বন্ধ করার জন্য মাস্কিং টেপ লাগালাম। আমার পাশের মহিলা বড়বড় চোখ করে সেটা দেখলো। তারপর শোয়ার সাথে সাথেই ঘুম।

 

The Mighty INDIA CALLING: সারাদিন ঘোরাঘুরি আর দিন শেষে হাওড়াময় রাত (পর্ব ৪)

ঘুম থেকে ঊঠলাম সকাল ৭ টার দিকে। রুবাইদা, মজুমদার আর মৌলি ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিচে ছেলেদের রুমে জমা দিয়ে বের হয়ে পড়লো। আমি একা একা ব্যাগ গুছালাম। সারা রুম তন্নতন্ন করে চেক করলাম, যে কিছু ফেলে যাচ্ছি কিনা আমরা। এক পর্যায়ে লাগেজ নিচের রুমে জমা দিয়ে রুমে এসে বসে থাকলাম। এর মধ্যে নিশাতরা ভুল করে আমাকে ফেলেই বের হয়ে পড়ে। আবার ফোন করে যোগাযোগ করে নিউ মার্কেটের সামনে ওদের সাথে যোগ দেই।

তারপর নিশাত আলাদা হয়ে যায়। আমরা অলিগলি দিয়ে বেশ ভিতরে ঢুকে পড়ি। আবার নিশাতকে খোঁজার জন্য আমি আর রিন্তু এগিয়ে যাই। এরপর দেখা যায় নিশাত সবাইকে খুঁজে পেয়েছে কিন্তু আমি আর রিন্তুই হারিয়ে গেছি। আবার খোঁজাখুঁজি করে সবাই একত্র হলাম। এরপর রওয়ানা দেই মার্কুইস স্ট্রিটে। মানি এক্সচেঞ্জে টাকা ভাঙ্গিয়ে রুপি করে নিলাম। আবার গেলাম আরাফাত হোটেলে। এবার অর্ডার দিলাম ৫ রুপির পুরি আর ৩৫ রুপির ডাল-খাসি। আমার খরচ পড়লো ২২ রুপি। পেট ভরে খেয়েদেয়ে আমরা বের হলাম- এবারের গন্তব্য সায়েন্স সিটি।

রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞেস করে বেশ কিছু দূর হেঁটে তিনটা মোড় পার হয়ে আমরা ২৪/এ বাসের জন্য দাঁড়ালাম। পথে আমি ২০ রুপি দিয়ে দুইটা ডাস ডাসা পেয়ারা কিনে নিলাম। পরে কাঠের মিনিবাস টাইপের বাসে না উঠে একটা বড় বাসে উঠে পড়ি। বেশ ফাঁকা বাস। আমরা হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসি। দূরত্ব ঘন্টাখানেকের হলেও ভাড়া ৯ রুপি। আমি জানালা দিয়ে দুপাশের কলকাতা শহর দেখতে থাকি। ভারি অদ্ভুত এই শহর, ভারি অদ্ভুত।

আমাদের সাইন্স সিটির গেটের উলটা পাশে নামিয়ে দেয়। আমরা আন্ডারপাস দিয়ে রাস্তা ক্রস করে আসি। আন্ডারপাসটায় আমরা ছাড়া আর কেউ ছিলো না। আমরা হাউকাউ করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলি। সায়েন্স সিটির গেটের সামনে বিশাল এক ডাইনোসোরের মুর্তি। আর একটু পাশে বিক্রি হচ্ছিলো স্ট্রিট ফুড। তমা চা খেলো। কাপের সাইজ এত ছোট মনে হলো যেন ওষুধ খাওয়ার কাপ। একটু পরেই রুবাইদা, মজুমদার ওদের সাথে দেখা হলো। ওরা বের হয়ে যাচ্ছে আর আমরা ঢুকছি। রুবাইদার পরামর্শ মত আমরা ৪০ রুপি দিয়ে এন্ট্রি টিকেট কাটলাম। আর নিশাত কাটলো ৭০ রুপি দিয়ে কেবল কারের টিকেট। এটা তেমন কিছুই না। খালি গেটটা পার করে দেয় কেবল কার দিয়ে।

ভেতরটা বেশ বড়। অনেকগুলো আলাদা বিল্ডিং। মেইন গ্যালারীটা পুরাই র‍্যাম্প করে স্পাইরাল হয়ে উপরে উঠে গেছে। আমরা দুই ভাগ হয়ে গ্যালারি দেখলাম। ছোট্ট কালে পড়া বিজ্ঞান বইয়ের সব উদাহরণ চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ভালোই লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে টায়ার্ড হয়ে আমি, অবনী আর তমা গ্যালারি ছেড়ে বের হলাম প্রায় পৌনে চারটার দিকে। আমাদের চারটার মধ্যে হোটেল থেকে হাওড়া স্টেশনে রওয়ানা হওয়ার কথা। দেরি হয়ে গেছে দেখে আমরা তাড়াতাড়ি একটা বাস ধরলাম নিউমার্কেট পর্যন্ত। ভাড়া একই নিলো কিন্তু উঠার সময় ট্রাফিক পুলিশ বলে দিয়ে ছিলো পকেটমার থেকে সাবধান থাকতে। আমরা কোনমতে বাস থেকে নেমে টানা রিক্সায় চড়ে সাড়ে চারটার দিকে হোটেলে পৌঁছলাম। নিচে দেখি একটা একটা করে ট্যাক্সি ক্যাবে করে মানুষজন উঠে রওয়ানা দিচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি করে নিচের রুম থেকে নিজের লাগেজ বের করে শান্ত, লিয়া, সৃষ্টির সাথে এক ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। ট্যাক্সি ভাড়া মোট ১৫০ রুপি।

আগে থেকেই কমিটি বলে দিয়েছিলো পুরানো স্টেশনে নামতে। আমরা তাই নামলাম। ট্যাক্সি থামতেই কুলির দল এসে হাজির হলো। তারা বললো দিল্লীর ট্রেন কল্কা মেইল তো নতুন স্টেশনে। আমরা তাদেরকে পাত্তা না দিয়ে নিজেরাই লাগেজ টেনে পুরানো স্টেশনে ঢুকলাম। ঢুকে জানতে পারলাম আমাদের ট্রেন আসলেই নতুন স্টেশনে আসবে। অগত্যা বিশাল রাস্তা আমাদের পাড়ি দিতে হলো এই সব ব্যাগপত্র নিয়ে। অবশেষে হাতের আঙ্গুলে লাল দাগ ফেলে আমরা নতুন স্টেশনে পৌঁছলাম। বি-শা-ল স্টেশন। অ-নে-ক মানুষ। অবশেষে খোঁজাখুঁজি করে জাফরকে পেলাম। তখনই জানলাম ঘটনাটা।

সন্ধ্যা ৭টার কল্কা মেইল ডিলে করেছে। কত সময়ের জন্য তা কেউ বলতে পারলো না। তবে মিনিমাম ১০-১১ ঘন্টা তো হবেই। বাজ পড়লো সবার মাথায়। এর মানে এই খোলা প্ল্যাটফর্মে বসে রাত পার করতে হবে? এই শীতের মধ্যে? Oh no!

তবে আমাদের মানুষেরা থাকলে কষ্ট করে হলেও কোন মতে থাকা যাবে, প্ল্যাটফর্ম দেখতে দেখতে আমি মনে মনে ভাবলাম। এর মধ্যে জাফর এসে জানালো উপরে মেয়েদের ওয়েটিং রুম আছে। আমরা সেখানেই থাকবো। প্ল্যাটফর্মে থাকতে হবে না আমি তাতেই খুশি। ব্যাগ টানতে টানতে লিফটে উঠলাম। লিফটের ভেতর মায়িশা আর নোভাকে রাগে ফেটে পড়তে দেখলাম। কমিটির কর্মকান্ড নিয়ে নাখোশ ওরা। ওদের দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম আমি। মনে হচ্ছিলো একটা না একটা গন্ডোগোল লাগবেই। ওয়েটিং রুমে ঢুকে দেখি রুবাইদা সবচেয়ে পিছনের রোতে মালপত্র গুছিয়ে, শিকল তালা মেরে ঘুমানোর পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে বসে আছে। আমাকে দেখে বল্লো, ‘নুযহাত, তোমার জন্য জায়গা রেখেছি। পিছনে দেওয়ালের সাথে মাথা ঠেস দিয়ে ঘুমানো যাবে। আর নিচে ব্যাগের উপর পা রাখলে আরাম হবে। আমরা চুপচাপ এখানে বসে থাকি। পরিস্থিতি ভালো না’। বুঝলাম আমার মত রুবাইদাও উত্তপ্ত পরিস্থিতির আঁচ পেয়েছে।

আস্তে আস্তে আমাদের মানুষজন সবাই এক এক করে আসতে লাগলো। সবাইরই মন কম বেশি খারাপ। এই রকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলো না কেউই। আমি সবার সাথে কথা বলে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করলাম। এদিক সেদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম আগামী ১২ ঘন্টা আমাকে কোথায় কাটাতে হবে। মোটমাট দুইটা ওয়েটিং রুম। ছেলেদেরটা বাইরে আর মেয়েদেরটা ভিতরে। মেয়েদেরটাতে চমৎকার টয়লেট আছে। ২ রুপি, ৩ রুপি, ৫ রুপি দিয়ে ঢুকতে হয়। ভেতরে গোসলখানাও আছে। আশেপাশের মানুষদের দেখলাম। সবাই মনে হলো ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত যে ট্রেন লেট হবে, আর এক দুই রাত ওয়েটিং রুমে থাকতে হবে। এক মহিলাকে তো গোসল করে শাড়ি বদলে চুল মুছতে দেখলাম। এক ফ্যামিলিকে দেখলাম সুন্দরমত ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে করে পরোটা, তরকারি খেতে। দেখে মনে হল যেন পিকনিক করতে এসেছে। আর বারবার মাইকে একটা অ্যানাউন্সমেন্ট বাজতে লাগলো। কি যে বলে আমরা কিছুই বুঝি না। বিরক্তিকর এই অ্যানাউন্সমেন্ট বাজতেই লাগলো। চারপাশের সবাইকে দেখে মনে হল আমরা ছাড়া কারও কোন টেনশন নেই। ১০-১২ ঘন্টা ট্রেন লেট যেন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

এক সময় আমাদের সবাই চলে আসলো। ছেলেরা ওদের মালপত্র সব মেয়েদের ওয়েটিং রুমের একটা শেলফের মধ্যে স্তুপ করে রেখে শিকল দিয়ে ভালোমত জড়িয়ে তালা মেরে দিলো। বেচারা কমিটি মেম্বারদের জন্য আমার খারাপ লাগলো। তবে বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে বলে কেউ কারও উপর চড়াও হলো না। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যুদ্ধ যুদ্ধভাবটা অনেকটাই কমে গেছে।

র‍্যাকের মধ্যে লাগেজ স্তুপ করে লাগেজ বাঁধাছাদা চলছে

সবে মোটে সন্ধ্যা পার হয়েছে। রুবাইদাকে দেখলাম চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে দেওয়ালে মাথা ঠেস দিয়ে ঘুম দিতে। আমারও ক্লান্ত লাগছিলো। খানিক্ষন চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিলাম। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। কিছু খেয়ে নেওয়া উচিৎ- মনে মনে ভাবলাম।

রাতে খাওয়ার জন্য নিচে নামলাম। ইতোমধ্যে অনেকে খেয়ে এসে রিপোর্ট দিয়ে গেছে। ওদের পরামর্শ মত খেতে ঢুকলাম ‘জন আহার’ নামক রেস্টুরেন্টে। আমি নিলাম ৩৫ রুপির ভেজ থালি। এই থালিতে ছিলো ভাত, পাতলা ডাল, আলুর ঝোল তরকারি, ফ্রি আচার আর লাল রঙের কি একটা সবজি জাতীয় জিনিস যেটা খেতে খুবই বাজে। খাওয়াটা অসম্ভব ঝাল ছিলো। আমার বেশ কষ্ট হলো। অনেকেই নিলো ৩৬ রুপির ছোলা ভাটুরা, ৩৫ রুপির ভেজ চাওমিন। চাওমিনটাই সবচেয়ে মজা ছিলো। অবাক হয়ে গেলাম ডেজার্টের দাম দেখে। মাত্র ১৪ রুপিতে পেস্ট্রি পাওয়া যায় এখানে। আমরা একসাথে বসে গল্পগুজব করে খেতে থাকি। খাওয়া শেষে আমি পেয়ারা ধুয়ে খাই। তারপর অন্য সবার সাথে স্টেশন ঘুরতে বের হই।

আমি এত বড় রেল স্টেশন আগে দেখি নাই। অনেক অনেক প্ল্যাটফর্ম। অনেক মানুষ চারপাশে। একপাশে সারি বেঁধে দোকান। রসগোল্লা, বাদাম, ডাল, চানাচুর, চিপস কি নাই সেখানে! আমাদের অনেকেই বাতাস দিয়ে ফুলানো বালিশ কিনলো। আমরা এটা সেটা দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। তারপর আবার ফেরত আসলাম ওয়েটিং রুমে।

কিছুক্ষন পর আবিষ্কার হলো, তমার পার্স চুরি হয়ে গিয়েছে। আমরা যখন দোকানপাট দেখছিলাম তখনই কেউ ওর ব্যাগ খুলে মেরে দিয়েছে পার্সটা। পার্সে এক হাজারের মত রুপি ছিলো, দেশের সিম কার্ডটা ছিলো, লাগেজের চাবি ছিলো আর ছিলো শিকলের চাবি। শিকলের চাবিটা হারিয়েছে দেখে তমা চিন্তিত হয়ে পড়লো। ওর লাগেজ তো শিকল দিয়ে বাঁধা আছে তাও আবার অন্যদের লাগেজের সাথে। শিকল খুলতে না পারলে কেমন করে হবে?

আমি খেয়েদেয়ে দাঁত মাজতে গেলাম। মেয়েদের বাথরুমে ঢুকতে গেলেই পয়সা দিতে হয়। দাঁত মাজার জন্য পয়সা দিতে ইচ্ছা হলো না। আমি গেলাম একটা খোলা বারান্দা টাইপ জায়গায়। সেখানে বেসিন আছে। আমি হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে দাঁত মাজতে লাগলাম। কনকনে শীত, উপরে খোলা আকাশ, নিচে ঝলমলে হাওড়া স্টেশন আর কাছেই রঙ্গিন হাওড়া ব্রিজ- এরকম জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি দাঁত মাজবো, জীবনে কোনদিন কল্পনাও করি নাই। দাঁত মাজতে মাজতেই দেখতে লাগলাম রাতের কোলকাতা শহর আর হাওড়া ব্রিজের রংচঙ্গে লাইট। প্রচন্ড ঠান্ডা পানি দিয়ে কুলি করে হাত মুখ সব অবশ করে আমি ফেরত আসলাম।

বেসিন ওয়ালা বারান্দা থেকে রাতের হাওড়া
বেসিন ওয়ালা বারান্দা থেকে রাতের হাওড়া

সত্যি বলতে কি আমার বেশ ভালোই লাগছিলো। এই রকম একটা অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনও হয় নাই। ওয়েটিং রুমটাকে বাসাবাড়ি বানিয়ে বসে থাকাটা চমৎকার লাগছিলো। আমরা গল্পগুজব করতে লাগলাম আর হাহা হিহি করে ফেটে পড়তে লাগলাম। অন্যরা এর মধ্যে শাল কম্বল মুড়ি দিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করলো। এক পর্যায়ে আমাদেরও কথাবার্তা কমতে লাগলো। সবাই নেক পিলোতে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করতে শুরু করলো। আমিও চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম আসলো না। মাঝে মাঝে খুট খাট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম- তমার ব্যর্থ প্রচেষ্টা শিকল আর তালা ভাঙ্গার। আর কানের কাছে জোরে জোরে বাজতেই লাগলো সেই অসহ্যকর অ্যানাউন্সমেন্ট………