The Mighty INDIA CALLING: বিশ্রী ঠান্ডার দিনে ‘গোয়েল’ এর সাথে পরিচয় (পর্ব ৭)

সকাল বেলা যখন হিমি আর লিয়ার ফোন বেজে ওঠে, তখনো আমি কানে কবুতরের আওয়াজ শুনছিলাম। আমরা কম্বলের তলা থেকে মাথা বের করে দেখলাম বাইরে অন্ধকার। ঘড়িতে দেখি ৯ টা বাজে। আমরা ধড়মড় করে উঠে বসি। ৯ টার সময়ই তো আমাদের বের হওয়ার কথা। তাড়াহুড়া করে আমরা রেডি হই। নাশতা করার সময় নাই, আবার গত রাতেও কিছু খাই নাই। কোন উপায় না দেখে দেশ থেকে নিয়ে আসা কেকগুলো খেয়ে ফেললাম। কি পরে বাইরে যাবো সেই চিন্তায় পড়লাম। কারণ এখানকার ওয়েদার খুবই কনফিউজিং। রোদ গায়ে লাগলে গরম, আবার একটু পরেই কনকনে ঠান্ডা। ভেবে চিনতে তিনটা সোয়েটার, কানটুপি, মাফলার, দুইজোড়া হাতমোজা সবই নিয়ে বের হলাম। যখন যেটা লাগবে সেটা পরা যাবে।

আমরা নিচে নেমে বসে রইলাম। এমন সময় এক লোক হাতুড়ি নিয়ে হাজির হলো তমার লাগেজের তালা ভাঙ্গার জন্য। সেই যে হাওড়া স্টেশনে ওর পার্স চুরি গেছে, তারপর থেকে ও আর ওর ব্যাগ খুলতে পারে নাই। হোটেল থেকে এখন একজনকে পাঠিয়েছে সেই তালা ভাঙ্গার জন্য। আমি আর তমা গেলাম একসাথে ওদের রুমে। লোকটা তালাটা ভাঙতেই আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম ‘আলহামদুলিল্লাহ’। উনি অবাক হয়ে হিন্দিতে বলে, ‘আপনি মুসলমান?’। আমার উত্তর শুনে উনি জানায় উনিও মুসলমান। জানতে চায় আমাদের দেশের সবাই মুসলমান কিনা, যারা এখানে এসেছি তারা সবাই মুসলমান কিনা। তমা শেষে উনাকে বখশিশ দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় করে।

১১টার দিকে আমরা হোটেল থেকে বের হয়েই টের পেলাম ওয়েদার মোটেও সুবিধা জনক নয়। আকাশ মেঘলা আর কনকনে ঠান্ডা। আমরা গলি দিয়ে বের হয়ে প্রথম বারের মতন আমাদের ভাড়া করা বাসটা দেখতে পেলাম। ক্যাটক্যাটে কমলা রঙের বাস, গায়ে লিখা ‘গোয়েল টুরিস্ট’। গোয়েলের সাথে সেই আমাদের প্রথম দেখা। আগামী ২১ দিনের জন্য বাসটা ভাড়া করা হয়েছে। এই ২১ দিনে আমাদের একটা বড় সময় এই বাসের ভিতর কাটবে। এইসব ভাবতে ভাবতে বাসের ভিতর উঠে বসলাম। দরজা দিয়ে ঢুকে ইঞ্জিন আর ড্রাইভারের সিটটা পার হবার পর আরেকটা দরজা, তারপর আমাদের বসার জায়গা। বাসটার ভেতরের ইন্টেরিওর কেমন জানি বিয়ে বাড়ির মতন। জানালায় লাল রঙের ঝালর লাগানো, সিটগুলো উজ্জ্বল লাল- বেশির ভাগেরই প্যাকেট খোলা হয় নাই, আর সামনে খুবই অদ্ভূত এক পেইন্টিং টানানো। আমরা সবাই কোন মতে বসে পড়লাম। কয়েকটা সিট খালি। দেখা গেল সুহাইলাসহ আরও কয়েকজন আসে নাই। ওদের আবার খবর দিয়ে আনা হলো। যাই হোক আমাদের যাত্রা শুরু হলো। প্রথম গন্তব্য কুতুব মিনার।

পথেই আমরা ইন্ডিয়া গেট দেখলাম। যখন কুতুব মিনারে পৌঁছাই তখন চারপাশে ঘন কুয়াশা। কুতুব মিনার আমরা ঠিকমত দেখতেই পারছিলাম না। ১০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে গেট দিয়ে ঢুকেই আমাদের সাথে ০৯ ব্যাচের আপু ভাইয়াদের সাথে দেখা হলো। ওনারা সিমলা মানালি ঘুরে আবার দিল্লী এসেছেন। ওনাদের সাথে হাই হ্যাল্লো করতে করতেই বৃষ্টি শুরু হলো। একে তো ঝাপসা কুয়াশা ছিলোই, তার সাথে বৃষ্টিটা শীতটাকে আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে দিলো। আমরা একটু আশ্রয়ের জন্য ছুটতে লাগলাম এদিক ওদিক। ক্যামেরা স্কার্ফ দিয়ে পেচিয়ে ব্যাগে ভরলাম। কুতুব মিনার তো ঠিকমত দেখা হলোই না বরং মেজাজ খারাপ করে বৃষ্টিটা থামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এত মানুষের কাছ থেকে সাজেশন নেওয়া হয়েছে, কেউ কোনদিন ছাতা নেওয়ার কথা বলে নাই। পুরা ব্যাচের ৪৬ জনের মধ্যে কারও কাছে ছাতা নাই। আমার বেশ মন খারাপ হলো।একটা বিশাল স্থাপনার নিচে সবাই পোজ মেরে সেলফি তুলতে লাগলো। আমি মেজাজ খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।

দ
বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে কুতুব মিনারের সামনে কয়েকজন দ্বিমিকবাসী ও শূণ্যয় সদস্য (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

খনিক পর যখন মনে হলো বৃষ্টিটা কমে গিয়েছে, তখন আমরা ঝটপট বের হয়ে দৌড় দিলাম। কনকনে ঠান্ডা আমাদের হাড় ভেদ করে ঢুকতে লাগলো। কোন রকম বাসে উঠে আমরা বসলাম। হাত দুইটা বারবার অসাড় হয়ে যাচ্ছিলো, ঠান্ডাকে বকতে বকতে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। আমরা ৩ টার দিকে পৌঁছালাম লোটাস টেম্পলে। কাঁপতে কাঁপতে আমরা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার পাশে হঠাৎ ০৯ এর বাস দেখলাম। আমরা কয়েকজন সেখানে উঠে আপুদের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। আপুরা বললো ওনারা সিমলা, মানালিতেও এই রকম বিশ্রী ঠান্ডা পায় নাই। আমাদের তাড়াতাড়ি করে  দিল্লী থেকেই দুই সেট ইনার কিনে নিতে বললো। আমরা কিছুক্ষন কথা বলে ওনাদের বাস থেকে নেমে হাঁটা দিলাম।

ঝাপসা কুয়াশাময় পরিবেশে লোটাস টেম্পলটা বাইরে থেকে দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো। কিন্তু কাছে গিয়ে যখন জানতে পারলাম ভিতরে জুতা খুলে ঢুকতে হবে, তখন আমার মেজাজটা গরম হয়ে গেলো। এই ঠান্ডার মধ্যে জুতা খুললে আমার নির্ঘাত নিউমোনিয়া হয়ে যাবে, তার উপর বৃষ্টি ভেজা রাস্তা- জুতা খোলার তো প্রশ্নই আসে না। আমি পিছু হটলাম। আমার সাথে মৌলিও যোগ দিলো। আমরা আবার হেঁটে হেঁটে বাসের দিকে যেতে লাগলাম। মাঝখানে রাস্তার পাশে পার্ক করা একটা বাসের ইঞ্জিন থেকে গরম ভাপ বের হচ্ছিলো। আমি আর মৌলি বাসের সাথে গা লাগিয়ে খানিক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ আরাম লাগছিলো আমাদের। আমরা হাত আর পিঠ সেক দিয়ে বেশ উষ্ণ করে নিলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে গোয়েলে এসে পৌঁছালাম। পুরো বাসে আমি, মৌলি আর চিং।

অনেক্ষন পরে সবাই যখন ফেরত আসলো তখন সবাই বলতে লাগলো আমরা নাকি মিস করেছি, ভেতরটা অনেক সুন্দর ছিলো, কষ্ট করে ঢুকলেই পারতাম। আমার কোন আফসোস রইলো না- আমি ভাই এত ঠান্ডা সহ্য করতে পারতাম কিনা সন্দেহ। যাই হোক অনেক বেলা হয়ে গেছে কিন্তু কোন খাওয়া হয় নাই। আমরা আবার রওয়ানা দিলাম। এবার যাচ্ছি জামে মসজিদ। বাসেই ডিসিশোন হলো, ঠান্ডা আর বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ইনার আর রেইনকোট কেনা দরকার। ধারে কাছে মার্কেট আছে, মেম বাজার আর পাল্লিকা বাজার। আজকে রাতেই যেকোন একটাতে গিয়ে কেনাকাটা করতে হবে।

জামে মসজিদের কাছাকাছি পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের ৬টা বেজে গেলো। বাস থেকে নেমে রাস্তা ক্রস করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। পাকা রাস্তা পার হয়ে কাঁচা রাস্তা আসলো। সেই রাস্তা নোংরা থেকে নোংরাতর হতে লাগলো। বৃষ্টিতে, কাদায় আর ময়লায় মাখামাখি হয়ে যাওয়া রাস্তায় আমরা অত্যন্ত সাবধানে হাঁটতে লাগলাম। দুইপাশে মুসলমান দোকানপাট দেখা গেলো। জামা কাপড়, তসবি টুপি, জায়নামাজ, রোরখা, আতর, ডেকচি, হাড়ি পাতিল, জুতা স্যান্ডেল – কি নেই সেখানে! এত ময়লা কাদা পার হয়ে জামে মসজিদে আর আমরা কেউ ঢুকলাম না। পাশ দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছি তখনই নাকে কাবাবের গন্ধ লাগলো। দেখলাম সারি সারি খাবারের দোকান। সেখানে বিরিয়ানি আর শিকের মধ্যে গাঁথা ঝলসানো মাংস থেকে ভুরভুর করে সুগন্ধ বের হচ্ছে। জিভে আমাদের পানি চলে আসলো। কত দিন মাংস খাই না!

আমরা কয়েক ভাগ হয়ে একেক দোকানে ঢুকে পড়লাম। অনেকে গেলো ‘করিমস’ হোটেলে। আমি, রুবাইদা, আদিবা আরও কয়েকজন ‘সুবহানাল্লাহ’ নামের এক দোকানে ঢুকে বিফ বিরিয়ানি অর্ডার দিলাম। ওরা বলেই দিলো যে ইন্ডিয়ার বিফ আসলে মহিষ, তারপরও ৫০ রুপিতে বাসমতি চালের বিরিয়ানি খেয়ে ভালোই লাগলো। ওখানে খেয়ে দেয়ে বের হয়েই দারুন এক মিষ্টির দোকান চোখে পড়লো। দোকানের নাম ‘কল্যান সুইটস’। এখানকার মিষ্টির দোকান আমাদের মিষ্টির দোকানের চাইতে আলাদা। দোকানের ভিতর বড় বড় থালার মধ্যে হালুয়া জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। কোনটা বাদামের হালুয়া, কোনটা শাহী হালুয়া। আর সামনের কাঁচের শোকেসে সারি সারি মাটির বড় বড় গ্লাসে লাচ্ছি, বাদাম দুধ সাজানো। অন্য পাশে হরেক রকমের মিষ্টি- লাল মোহন যেটাকে ওরা বলে গুলাব্জামুন, বাদামের বরফি, রঙ বেরঙ্গের মিষ্টি দেখে আমার জিভে পানি চলে আসলো। কিন্তু মাত্রই বিরিয়ানি খেয়ে পেট ভরে রেখেছি, আবার রাতে জার্নিও আছে। তাই খাওয়ার আগে আমরা একেকটা মিষ্টির নাম জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। দোকানের লোকটা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপ কাঁহাসে হো, হায়দ্রাবাদ?’ আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘ বাংলাদেশ’।

দোকানের লোকটা আমাদের ফ্রিতে হালুয়া আর শাহী টুকরা টেস্ট করতে দিলো। দুটোই মজা ছিলো। লিয়া লাচ্ছি খেলো আর তানভীর বাদাম দুধ খেলো। ওদের লাচ্ছি অনেক ঘন, চামচে করে খেতে হয়। দোকান থেকে বের হওয়ার পর তানভীর জানায় বাদাম দুধটা অসম্ভব মজা ছিলো। তানভীরের উপর রাগ লাগলো, আরেকটু আগে বললেই আমি এক গ্লাস খেতে পারতাম। রাত হয়ে গেছে, আমরা ফেরার পথ ধরলাম। সেই ময়লা, নোংরা রাস্তা হেঁটে আমরা আবার বাসে উঠে বসলাম। রাত হয়ে যাওয়ায় সব মার্কেট বন্ধ হয়ে গেছে ভেবে আমরা সরাসরি হোটেলে ফেরত যাই।

হোটেলে গিয়ে শুনতে পারি লিয়া গেছে মার্কেটে। আমি লিয়াকে ফোন দিয়ে বলে দেই আমার জন্য একটা ইনার কিনে আনতে। আমরা ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হতে থাকি। ওদিকে লিয়াও ফেরত আসে। ও ৫৫০ রুপি দিয়ে সুখান্দ কোম্পানির ইনার কিনে আনে। আমার ইনার আমি ট্রায়াল দিয়ে দেখি, বেশ গরম বলেই মনে হয়। এই জিনিস পরে যদি গরম লাগে তাহলে বাসে খুব অশান্তি লাগবে ভেবে আমি ইনারটা না পরেই রেডি হই।

হোটেলের এক্টামাত্র ছোট্ট লিফট দিয়ে মালপত্র নামিয়ে আমরা নিচে ওয়েট করি। রাত ১২টা- ১টার দিকে আমরা মালপত্র নিয়ে বাসে উঠে বসি। সারা বেশ ছটফট করতে লাগলো। ওর ইনার পরে খুব অশান্তি লাগছে। বেচারি খুলতেও পারছে না আবার স্বস্তিও পাচ্ছে না। আমি ব্যাগ থেকে কম্বল বের করে গায়ে দিলাম। কম্বলের নিচে ভাবতে থাকি দিল্লী শহরটা তাড়াতাড়ি ছাড়তে পারলেই বাঁচি। এখানকার মানুষজন ভালো না, আবহাওয়া খুবই অসহ্যকর, রাস্তাঘাট মরা মরা। এই পচাঁ শহরটা থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। এইসব ভাবতে ভাবতে আর বাসের দুলুনিতে ঘুম পেয়ে গেলো। কখনও ভাবি নাই যে বাসে আমি ঘুমাতে পারবো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার দুই চোখ কিছুক্ষনের মধ্যেই গভীর ঘুমে বুজে আসলো।

 

 

 

3 Replies to “The Mighty INDIA CALLING: বিশ্রী ঠান্ডার দিনে ‘গোয়েল’ এর সাথে পরিচয় (পর্ব ৭)”

  1. I miss Delhi! দিল্লীর কাবাব,বাদাম দুধ,মিষ্টি!! :'( দিল্লীর সবকিছু!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *