The Mighty INDIA CALLING: মরুর বুকে সোনালি শহর জয়সালমীরে (পর্ব ২০)

বেশ সকালে আমাদের গোয়েল থামলো এক ধাবাতে। আমরা সবাই নেমে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কেউ কেউ খাওয়াদাওয়া অর্ডার দিতে বসলো। পাওয়া যাচ্ছে শুধু আলু পরোটা যেটাতে আবার লবন নাই। আমার লবন ছাড়া পরোটা খেতে ইচ্ছা করলো না। আমি বিস্কুটের প্যাকেট কিনে খেতে শুরু করলাম। নাশতা খেয়ে দাঁত মেজে নিলাম ধাবার সামনে হাত ধোয়ার বেসিনে। সব শেষে আবার বাসে উঠলাম। গোয়েল ছেড়ে দিলো। আমরা চলতে শুরু করলাম জয়সাল্মিরের দিকে।

প্রায় সকাল ১১টার দিকে আমরা পৌঁছালাম ছোট শহর জয়সালমিরে। আমাদের জন্য ঠিক করা হলো হোটেল অশোকা। ছোট দোতলা হোটেল। বলতে গেলে আমরাই হোটেলের প্রায় সবগুলো রুম দখল করে নিয়ে নিলাম। আমাদের ভাগ্যে জুটলো ট্রিপল বেডের একটা রুম। আমাদের চারজনের সাথে মিমেরও জায়গা হলো এই রুমে। ঝকঝকে দিনের আলোতে উদ্ভাসিত রুমটা আমাদের বেশ পছন্দই হলো। এই ঝকঝকে আলোতেই আবিষ্কার করলাম গায়ের রঙ কয়েক পোচ কালো হয়ে তো গেছেই প্লাস আমার বাম গালে বিশাল এক কালো ছাপ পড়েছে। মিম দেখে বললো, ‘সান বার্ন’। একে একে আমরা গোসল করতে ঢুকলাম। আমি কলে গরম পানির ব্যবস্থা পেয়ে বেশ খুশি হয়ে গেলাম। দারুন একটা গোসল করে বারান্দার রোদে আমাদের সব কাপড় মেলে দিলাম। এই হোটেলে প্রায় প্রতিটা রুমের দুইটা করে দরজা। একটা সামনের দরজা যেটাতে লবি থেকে ঢুকতে হয়, অন্যটা পিছনের দরজা যেটা দিয়ে টানা একটা বারান্দায় যাওয়া যায়। এই টানা বারান্দা আবার সবগুলো রুমকে কানেক্ট করে। আমি বারান্দা দিয়ে হেঁটে হেঁটে অন্যদের রুমে ঘুরে আসতে লাগলাম।

আমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যায় যে নিচে বড় চুলাতে রান্নাবান্না হচ্ছে আর খোলা আকাশের নিচে খাটিয়ায় বসে লোকজন খাচ্ছে। আমার এখানে খেতে ইচ্ছা হলো না। দুপুরে খাওয়ার জন্য আমি বের হলাম মজুমদার, মৌলি আর জাফরের সাথে। হোটেল থেকে বের হয়ে চারপাশটা দেখলাম। এটাকে ঠিক শহর না বলে আমাদের দেশের উপজেলা বা সদর বললে মনে হয় ভালো হতো। যে রাস্তা দিয়ে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম সেটা পুরো মাটির কাঁচা রাস্তা। দুপাশে জঙ্গল টাইপের গাছ। এর মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা সাইজের শুকর। আমাদের গ্রামগুলোতে যেমন রাস্তাঘাটে ছাগল ঘুরে বেড়ায় তেমনি এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুকর। যাই হোক কড়া রোদের মধ্যে হেঁটে গিয়ে শেষমেশ একটা খাবারের হোটেল পাওয়া গেলো। আমরা সবাই সেখানে ঢুকলাম। কিন্তু সেখানে ভেজ নাই। সবই মুরগি আর শুকর। আমি সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। আবার সেই জঙ্গল আর শুকরের রাস্তা পার হয়ে হোটেলে ফেরত এলাম। হঠাৎ দেখি রুবাইদা হোটেলের নিচেই একটা ছোট্ট রুমে বসে আমার দিকে হাত নাড়ছে। আমি গিয়ে দেখলাম উপর থেকে যে রান্না বান্না দেখেছিলাম, তাদের ইনডোরে বসে খাওয়ার জায়গা এই রুমটা। রুবাইদা অর্ডার দিয়েছে রুটি বাদে শুধু ভাত দিয়ে ভেজ থালি। আমিও সেটাই অর্ডার দিলাম। মালিকটা অবাক হয়ে বললো, ‘আপ ভি রোটি নেহি মাংতা, স্রেফ চাওয়াল?’। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

বড় একটা স্টেনলেস স্টিলের থালিতে অনেকগুলো সাদা ভাত, ছোট ছোট বাটিতে ফুলকপির তরকারি, ডাল আর টক দই আসলো। খাবারটা বেশ মজা। কেমন জানি বাসায় রান্না করা খাবারের মত লাগছিলো। অনেকদিন পর তৃপ্তি করে পেট ভরে ভাত খেলাম। শুধু ফুলকপির তরকারিটা ঝাল ছিলো। কিন্তু আমি বলতেই আমাকে এক বাটি চিনি দিয়ে গেলো। আমার কাছে খেতে খুব ভালো লাগছিলো। আমরা ভাতের উপর তরকারি ঢেলে মাখিয়ে খাচ্ছিলাম। আশেপাশের লোকজন একটু অবাক হয়ে দেখছিলো আমাদের ভাত খাওয়ার তরিকা। সব শেষে ডালটা যখন প্লেট কাত করে চুমুক দিয়ে খাচ্ছিলাম তখন মালিকটা আমাদের জিজ্ঞেস করলো, ‘আপ কাঁহাসে আয়া হো’। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে জানতে চাইলো, ‘ক্যায়া ওয়াহা পে সাব লোগ চাওয়াল খাতা হ্যায়?’। সবাই ভাত খায় শুনে উনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘রোটি নেহি খাতা হ্যায় ক্যায়া?’। আমি হেসে জানালাম যে আমরা রুটিও খাই কিন্তু সকালের নাশ্তায়। লোকটা বেশ অবাক হলো। বিল নেওয়ার সময় আমরা রুটি খাই নাই বলে ৬০ রুপির থালি আমাদের কাছে ৫০ রুপি রাখলো। রুবাইদা জিজ্ঞেস করলো রাতেও ভাত পাওয়া যাবে কিনা। উনি জানালো এমনিতে বেশির ভাগ সময় উনারা ভাত রান্না করে না। কিন্তু আমরা যদি খাই তাহলে বারান্দা দিয়ে চিৎকার করে বলে দিলেই উনি ভাত চড়িয়ে দিবেন।

খাওয়া শেষে আমি আর রুবাইদা একটু ঘুরতে বের হলাম। একটু সামনেই একটা রেল স্টেশন। সেই দিকে হাঁটতে লাগলাম। চারিদিকে কেমন কড়া রোদ আর বালি বালি ভাব। রাস্তা ঘাটে তেমন কোন মানুষ জন নাই। কয়েকটা ছেলে মানুষ তাও দেখতে পেলাম। কিন্তু কোথাও কোন মহিলা পেলাম না। মনে হলো সারা শহরে বোধহয় আমরা দুই জনই মেয়ে। স্টেশনটাতে ঢুকে মনে হলো সারা স্টেশনে আমরা দুইজন ছাড়া আর কোন মানুষ নাই। পুরো জনমানবশূন্য একটা স্টেশন। কেমন যেন অস্বস্তি লাগলো আমাদের। আমরা তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসলাম। স্টেশন থেকে বের হয়ে একটু আগাতেই আমাদের মানুষজনের সাথে দেখা হলো। সবাই কথাবার্তা বলে ঠিক করলাম দুপুরের পর রোদের আঁচ একটু কমলেই আমরা ঘুরতে বের হবো। আমরা হোটেলে ফেরত আসলাম। গনগনে সূর্যের কড়া রোদের মধ্যে আমরা গল্প করার জন্য ছাদে উঠলাম। ছাদে ছাউনি দেওয়া চমৎকার বসার জায়গা আছে। সেখানে বসে আমি, মৌলি, সীমান্ত, তুষার, মজুমদার আমরা চরম হাসাহাসি করতে লাগলাম। এর মধ্যে হিমি এলো চমৎকার একটা জামা পরে। জয়পুর থেকে কিনে এরই মধ্যে ও ফিটিং করে নিয়েছে। খানিক পরে আমরা উঠে গেলাম ছোট্ট একটা ঘুম দেওয়ার জন্য। বিছানায় ধড়াম করে পড়েই আমরা ঘুমিয়ে গেলাম।

ঘুম ভাঙতেই আমরা তাড়াহুড়া করে তৈরি হয়ে বের হয়ে পড়লাম।  ছয় জন মিলে একটা অটো ঠিক করলাম বাজারে যাওয়ার জন্য। পার হেড খরচ পড়লো ১০ টাকা। বাজার আর কেল্লা পাশাপাশি। প্রথমে বাজারে নেমে আমরা হাঁটতে লাগলাম। বাজারের জিনিসগুলো বেশ ফ্যাকাশে আর মলিন। মনে হচ্ছে যেন বহু বছর ধরে এখানে নতুন কোন মাল তোলা হয় নাই। লোকজন নাই, ভিড় নাই কেমন যেন চুপচাপ। আমি ওয়াফির জন্য ছোট্ট একটা লাল টুকটুকে পাগড়ি কিনলাম ৩০ রুপি দিয়ে। থান কাপড়, ওয়ান পিস, ঘাগড়া, জুতা, জুয়েলারি আর সেই সব পায়জামা দেখতে দেখতে আমরা হাঁটতে লাগলাম। এখানে বেশির ভাগ জিনিসের দাম জয়পুরের চেয়ে বেশি আর কয়েকটা জিনিসের দাম কম। হঠাৎ মিম ‘পতঞ্জলি’ নামের এক আয়ুর্বেদিক দোকান থেকে আমাকে সান বার্নের জন্য কিছু একটা কিনে নিতে বললো। আমি আর রুবাইদা মিলে একটা অ্যালোভেরা জেল আর সানস্ক্রিন লোশন কিনলাম। এরই মধ্যে অন্তরা ফোন দিয়ে মন খারাপ করলো যে আমরা ওকে না খবর দিয়েই বের হয়ে পড়েছি। ও একা একা হোটেলে বসে আছে।  ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার একটু আগে আমরা কেল্লার ভিতরে ঢুকলাম। কেল্লাটা দেখে কেমন যেন লাগলো। সন্ধ্যার আলোতে বিশাল বড় পাহাড়ের উপর কেল্লাটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো কি যেন একটা মনে পড়ছে, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বলার আগেই মিম বলে উঠলো, ‘সোনার কেল্লা!’।

সোনার কেল্লা! সোনার কেল্লা!! সোনার কেল্লা!!!
সোনার কেল্লা! সোনার কেল্লা!! সোনার কেল্লা!!!

আমার হৃদপিন্ড তখন ড্রাম বাজাতে লাগলো। সোনার কেল্লা! এই সেই সোনার কেল্লা, সেই ক্লাস থ্রিতে থাকতে প্রচ্ছদে পিস্তল হাতে সৌমিত্রর ছবি দেওয়া  নীল আকাশের পিছনে ঝকঝকে সোনালি রঙের যে কেল্লাটার ছবি দেখতাম – এটা সেই কেল্লা! এক সাথে আমার মনে পড়ে গেলো সব। জাতিস্মর মুকুলের কথা, নীলুর কিডন্যাপিঙ্গের কথা, যোধপুরে ট্রেনে ফেলুদার সাথে গুন্ডাদের মারামারির কথা, লালমোহন বাবুর সাথে পরিচয়, শুধু মাত্র জিভে গজা খেয়ে স্টেশনে রাত কাটানোর কথা, সবশেষে সামান্য বানান ভুলের সূত্র ধরে নকল ডক্টর হাজরাকে এই সোনার কেল্লাতেই পাকড়াও করা-। আমি তাকিয়ে রইলাম কেল্লাটার দিকে। আমার শৈশবের অত্যন্ত প্রিয় বই ‘সোনার কেল্লা’র সেই কেল্লাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি! ইয়া আল্লাহ, এত সুখ কেন জীবনে?

ঢাল বেয়ে আমরা উপরে উঠতে লাগলাম। মনে হচ্ছিলো যেন কোন সিনেমার ভিতরে ঢুকে পড়েছি। দুপাশের দেওয়াল জুড়ে নানা রকম জামাকাপড় ঝুলানো। কাঁচ বসানো আসল জয়পুরি সুতার কাজ করা জামা কাপড় দেখলাম। দাম অনেক বেশি। হবেই তো- হাতে কাজ করা যে! আশেপাশে ছোটখাট রেস্টুরেন্ট আছে। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমরা সামনে যেতে লাগলাম। বেশ একটা চত্বরের মত খোলা জায়গায় এসে পড়লাম। চারপাশে দোকান পাট, রেস্টুরেন্ট, ঘরবাড়ি। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম সব কিছু। সন্ধ্যার দিকে দোকানপাট সব বন্ধ করে দিচ্ছিলো লোকজন। একটা গলি ধরে একটু আগাতেই এক দোকানে সুতার কাজ করা সিল্কের স্কার্ট মিমের খুব পছন্দ হলো। দরাদরি করে ১৫০০ রুপিতে মিম সেটা কিনে ফেললো। আমি পাশেই দেখলাম একটা দোকান, ‘মুকুল স্টোন শপ’। ভিতরে সাজানো সারি সারি ‘সোনার পাথর বাটি’। আমি মুখ হাঁ করে দেখতে লাগলাম।

মুকুল স্টোন শপে সাজানো সারি সারি 'সোনার পাথর বাটি'
মুকুল স্টোন শপে সাজানো সারি সারি ‘সোনার পাথর বাটি’

দোকান পাট সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো দেখে আমরা আর ভিতরে ঢুকলাম না। ঢালু রাস্তা বেয়ে নেমে আসলাম। ভাবলাম বাজারে কোন রেস্টুরেন্টের কোথাও বসে খেয়ে নিবো। কিন্তু ঘুরেফিরে কোনটাই ভালো লাগলো না। আবার অটো ঠিক করে হোটেলে ফেরত চলে আসলাম। হোটেল পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেলো। ঢুকতেই দেখলাম হোটেলের দরজার কাছে তুষার মন খারাপ করে বসে আছে। ওদের ছেলেদের দুইটা রুম কম ছিলো। ওরা এক রুমের লোকজন ভাগাভাগি হয়ে যায়। আরেক রুমের লোকজন বাকি থাকে। বলা হয়েছিলো বিকালের পর একটা রুম খালি হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন রুম খালি হয় নাই। ওরা পাশের আরেকটা হোটেল দেখে এসেছে কিন্তু রুম ওদের পছন্দ হয় নাই। এজন্য ওদের মন খারাপ। আমি বললাম যাই হোক অন্য কোথাও থাকার দরকার নাই। একান্তই যদি কোন উপায় না থাকে তাহলে আমরা মেয়েরা প্রত্যেকটা ডাবল রুমে পাঁচ জন করে থাকবো, তাহলেই একটা রুম খালি হয়ে যাবে। আশেপাশে যারা ছিলো তারা সবাই ব্যাপারটাতে সায় দিলো। আরও কিছুক্ষন গল্প করে আমরা উঠে আসলাম রুমে। সবাই পরদিনের ডেজার্ট নাইটের জন্য ব্যাগ প্যাক গুছাতে লাগলো। আমরা বারান্দা দিয়ে চিৎকার করে বললাম ভাত রান্না করার জন্য। পরে নিচে খেতে গেলাম। আমাদের থালিতে সাজিয়ে দিলো ভাত, আলুর তরকারি আর ডাল। তৃপ্তি করে খেলাম। খাওয়া বাবদ ৬০ রুপি দিয়ে আমরা আবার রুমে ফেরত গেলাম। ততক্ষনে মিমের স্কার্টের কথা জানাজানি হয়ে গেছে। সবাই দেখতে আসলো সেই স্কার্ট। আমরাও সবাইকে দেখালাম।

গোছগাছ শেষ করে আমরা শুয়ে পড়লাম। লাইট নিভিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই।

4 Replies to “The Mighty INDIA CALLING: মরুর বুকে সোনালি শহর জয়সালমীরে (পর্ব ২০)”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *