The Mighty INDIA CALLING: চোখ ধাঁধাঁনো মরু প্রান্তরে দ্বিমিকবাসী এবং গভীর রাতে ঝলসানো মুরগি ও একটি পূর্ণিমার চাঁদ (পর্ব ২১)

সকালে ঝলমলে দিনের আলোতে ঘুম ভাংলো। ফ্রেশ হওয়ার পর আবার ব্যাকপ্যাক গোছগাছ করতে লাগলাম আজকে রাতের ‘ডেজার্ট নাইট’ এর জন্য। তারপর নিচে নেমে এলাম নাশ্তার জন্য। নাশতা পেলাম বড় বড় মাখন দেওয়া চকচকে রুটি, ভাজি আর টক দই। আমি আর মিম শেয়ার করে খেলাম। মনে হলো যেন বাসার নাশতা খাচ্ছি। আমার কাছে ঝাল লাগায় আমি আবার চিনি নিয়ে নিলাম। খুব তৃপ্তি করে খেলাম সব কিছু।

এর মধ্যে আমাদের বাসের ড্রাইভার আর হেল্পারের ঘুম ভেঙ্গেছে। ওনারা বাস থেকে লাগেজ নামিয়ে দিলো। আমরা যার যার লাগেজ টানতে টানতে রুমে নিয়ে গেলাম। রুমে আবার লাগেজ খুলে মালপত্র গুছালাম। আগামী কয়েক দিনের জন্যও জিনিসপত্র ভরে নিলাম ব্যাকপ্যাকে। তারপর সব গুছিয়ে আমরা রুম ছেড়ে দিলাম। ১০২ নম্বর রুমে সব লাগেজ রেখে আসলাম। লাগেজ জমা দিয়ে বের হলাম আমি, রুবাইদা, মিম আর অন্তরা। গন্তব্য ‘সোনার কেল্লা’।

ওদস
সোনার কেল্লার ভিতরে (কৃতজ্ঞতায় সাবরিনা মেহজাবিন রাত্রি)

দূর থেকে সোনার কেল্লা দেখতে দেখতে আমার চোখ জুড়িয়ে গেলো। এবার সোজা নামলাম কেল্লার সামনে। ঝলমলে দিনের আলোয় কেল্লাটা পুরো ঝকঝক করছিলো। ঢাল বেয়ে উঠতেই কতগুলো স্থানীয় মহিলাকে দেখলাম রুপার গয়না বিক্রি করতে। রুপার নূপুর, টিকলি, নথ, বিছা, নেকলেস এইসব। দাম তুলনা মূলক কম। অনেকেই গয়না কিনতে লাগলো। আরেকজনকে দেখলাম একটা বাঁশের তৈরি বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। এক সাদা টুরিস্টকে দেখলাম আগ্রহ নিয়ে সে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর চেষ্টা করতে। এই সব পার হয়ে কেল্লার ভিতরে ঢুকতে লাগলাম আমরা। চিপা চিপা অলি গলি দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম আমরা। দোকান পাট বেশির ভাগই খালি, কোন মানুষজনই নাই- এমনকি দোকানদারও নাই। দোকানে ঢুকে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে কোথা থেকে যেন দোকানের মালিক এসে হাজির হয়।  দোকান গুলোতে জয়পুরের সেই পায়জামাগুলোই পাওয়া যায় তবে জিনিসগুলো জয়পুরের চেয়ে সুন্দর আর দামও জয়পুরের চেয়ে বেশি। বেশ অ্যান্টিক টাইপের জিনিসপাতি আর রত্ন পাথরের গয়না গাটি দেখতে দেখতে আমরা হাঁটছিলাম। জয়সাল্মীরে আসার পর থেকেই মোবাইলে দেশের সাথে যোগাযোগ করতে পাচ্ছিলাম না। এই কেল্লায় এসে নেটওয়ার্ক পেলাম। বাসায় ফোন দিলাম। আম্মুকে চিৎকার করে সব জানালাম। ভাইয়াকে বললাম সব কিছু।

ফদস
সরু গলি ধরে হেঁটে চলা (কৃতজ্ঞতায় সাবরিনা মেহজাবিন রাত্রি)

কেল্লার কিনার ঘেঁষে একটা জায়গা পেলাম যেটা সুইসাইড পয়েন্ট। এখান থেকে নিচে ঝাঁপ দিয়ে বোধহয় মানুষ আত্মহত্যা করে। আমরা সেখানে ছবি তুললাম। আরেকটা জায়গা পেলাম ‘সিটি ভিউ’ যেখান থেকে শান্ত চুপচাপ জয়সাল্মীর শহরটা দেখা যায়। পুরো কেল্লাটাই হলুদ স্যান্ডস্টোন দিয়ে বানানো, খালি কয়েকটা ঘর দেখলাম নীল রঙ করা। এগুলো নাকি ব্রাহ্মণদের ঘর। যেখানে সেখানে রাস্তা দিয়ে গরু হাঁটছে নির্বিকারভাবে। ভেতরে কয়েকটা মিউজিয়াম ছিলো। তাড়াহুড়া করে সেগুলোতে আর ঢোকা হয় নাই। এর মধ্যে অন্তরাও ১৫০০ রুপির আরেকটা স্কার্ট কিনলো। রুবাইদা কিনলো বিশেষ পাথরের তৈরি মগ, আর সবশেষে অন্তরা নূপুর আর ব্যাগ কিনলো। আমরা বের হয়ে আসতে লাগলাম।

ফাভ
সুইসাইড পয়েন্ট থেকে দেখা জয়সাল্মীর শহর ( কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

বের হয়েই এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হলো। কোন নির্বাচনী প্রচারনার জন্য ট্রাক ভর্তি করে এক নেতার সমর্থক এসেছে। তারা কেল্লার গেটের সামনে ট্রাক পার্ক করে পটকা ফুটাতে লাগলো আর রাস্তা ব্লক করে নাচতে লাগলো। সেই কি আওয়াজ! আমরা কানে আঙ্গুল চেপে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু রাস্তা ব্লক হয়ে যাওয়ায় কোন অটো আমাদের নিতে চাইছিলো না। শেষমেশ বাড়তি দাম দিয়ে একটা অটো ঠিক করলাম যেটা অনেক রাস্তা ঘুরে আমাদের হোটেলের কাছে নিয়ে গেলো। এইসব রাজনৈতিক শোভাযাত্রার কারণে আমাদের পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। হোটেলের কাছাকাছি আসতেই সবাই ফোনের উপর ফোন করতে লাগলো। স্টেশনের সামনে এক পানিপুরি ওয়ালার কাছ থেকে ওরা পানি পুরি অর্ডার দিলো। কিন্তু ফোনের চোটে আমরা সেই পানিপুরি ফেলেই ছুটতে লাগলাম হোটেলের দিকে। আমরা কোনরকম দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হোটেলের সামনে গিয়ে দেখি সবাই গোয়েলে উঠে বসে আছে। শুধু আমাদের জন্যই গোয়েল ছাড়তে পারছে না। আমি বাসে উঠার আগে নিলয়কে একবার রিকোয়েস্ট করলাম ১০২ এর দরজা খুলে দেওয়ার জন্য যাতে আমি আমার গুছিয়ে রাখা ব্যাকপ্যাকটা আনতে পারি। কিন্তু এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি আর ব্যাকপ্যাকটা নিতে পারলাম না। যেভাবে ছিলাম সেভাবেই আমরা চারজন বাসে উঠে পড়লাম। আমরা বাসে উঠতেই বাস ছেড়ে দিলো।

বাসে বসে ধাতস্থ হতে আমার একটু সময় লাগলো। আমি মনে মনে হিসাব করে দেখলাম আমার কাছে এই মূহুর্তে কি কি জিনিস আছে, আর কি কি লাগতে পারে রাতে থাকার জন্য। সব মিলিয়ে দেখলাম শুধু রাতের কম্বলটাই বাদ পড়েছে। এছাড়া যে জামা ঠিক করে রেখেছিলাম সেটার বদলে যে জামা পরা আছি সেটা পড়েই সারাদিন থাকা যাবে। সবচেয়ে পিছনে বসে বাইরের দিকে তাকাতে লাগলাম। কড়কড়ে রোদে আমার বেশ গরম লাগতে লাগলো। শহরটা পার হয়ে যাওয়ার পরই কয়েকটা রাজ প্রাসাদের মত হোটেল দেখলাম। এখানেই নাকি ‘এক থা টাইগার’ সিনেমার শুটিঙ্গের জন্য নায়ক সালমান খান তার দলবল নিয়ে অবস্থান করছেন! তারপরই শুরু হলো মরুভূমি। এই মরুভূমিটার নাম থর। থর মরুভূমিটা সিনেমায় দেখা মরুভূমির চাইতে আলাদা। মরুভূমি বললেই ধূ ধূ বালির প্রান্তর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু এই মরুভূমিতে অল্প বিস্তর গাছ আছে। মাটিও আছে বলে মনে হলো। আর একেবারে বিস্তীর্ণ নয়। মাঝে মাঝেই মানুষজন, কারখানা, উইন্ড মিল, সোলার প্যানেল চোখে পড়ে। দেখে মনে হচ্ছিলো ঠিক যেন মরুভূমি নয়, কেমন যেন বিরানভূমি। মরুভূমিতে খুব বেশি গরম লাগলো না। সূর্যের তেজও সহনীয় মনে হলো।

বাস আমাদের নামিয়ে দিলো একটা জায়গায় যেখানে লাইন ধরে বসে আছে সারি সারি উট। সেখানে নামার পর আমাদের দ্বিগুন দাম দিয়ে পানির বোতল কিনতে হলো। কারণ সামনে নাকি আর পানি পাওয়া যাবে না। পানি কিনে আমরা রংচঙ্গে গদি দিয়ে সাজানো সারি সারি উটের কাছে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের জন্য উট ঠিক করে রাখা আছে। আমি আর রুবাইদা হাচড় পাচড় করে একটা উটের পিঠে চড়ে বসলাম। আমি বসলাম সামনে আর পিছনে বসলো রুবাইদা। সামনে ছোট্ট একটা হাতল আছে যেটা আমি শক্ত করে ধরে রাখলাম। আর রুবাইদা কিছু ধরার না পেয়ে আমাকে জাপটে ধরে রাখলো। একটা মাঝবয়সী নীল পাঞ্জাবী পরা মুসলমান লোক উটের দড়িটা ধরে টান দিয়ে তাকে উঠে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলো। উট দাঁড়ানোর সময় আগে পিছনের পা দুটো সোজা করে, তখন আরোহীরা ভূমির সাথে সমান্তরালে না থেকে ৯০ ডিগ্রি আঙ্গেলে অবস্থান করে। আশে পাশের উটগুলা থেকে আমাদের লোকজনদের চিৎকার শুনে বুঝতে পারছিলাম যে ব্যাপারটা বেশ ভীতিকর। যাই হোক আমাদের উট উঠে দাঁড়ালো। প্রথমে যখন পিছনের পা সোজা করলো তখন আমার মনে হলো আমি বোধহয় ছিটকে পড়ে যাবো। কিন্তু পড়ে যাবার আগেই উটটা সামনের পা সোজা করে উঠে দাঁড়ালো। গলা থেকে আর্তচিৎকার বের হবার আগেই আমি সামলে নিলাম। শুরু হলো আমাদের উটের পিঠে মরুভূমিতে জার্নি।

sv
উটে চড়ে দ্বিমিকবাসীর মরু যাত্রা (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম দিশা)

মরুভূমির মধ্যে দিয়ে সব গুলো উট লাইন ধরে চলতে লাগলো। প্রত্যেকটা উটের সাথে একজন করে লোক দড়ি ধরে হাঁটতে লাগলো। মাথার উপর গনগনে সূর্য থাকলেও কোন গরম লাগছিলো না। বালির উপর আমাদের বড় বড় ছায়া পড়ছিলো ঠিক সিনেমায় যেমনটা দেখা যায় সেরকম। উট চলে বেশ গদাই লস্করি চালে। আমরা ঝাঁকি খেতে খেতে চলতে লাগলাম। আমার বেশ ভালোই লাগছিলো কিন্তু পিছনে বসায় রুবাইদার বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে দুই একটা উট দৌড়ে আমাদের ওভারটেক করে যেতে লাগলো। সারাকে দেখলাম এরকম একটা উটের পিঠে বসে বেশ চিৎকার করতে। আমরা একেক জন একেক উটের পিঠে থেকে একেকজনকে ডাকাডাকি করতে লাগলাম। হৈ চৈ করতে করতে আমাদের শেষ বিকালের মরুভূমি যাত্রা চলতে লাগলো। আমি চোখ ভরে দুই পাশ দেখে নিলাম, উটের পিঠে মরুভূমিতে পাড়ি দেওয়া জীবনে আর কোনদিন হবে বলে ভাবতেও পারছি না। আল্লাহ কত সুন্দর একটা অভিজ্ঞতার সুযোগ দিয়েছেন আমাকে!

ঐ দূরে আমাদের ক্যাম্পের তাঁবু দেখা যায় (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম দিশা)

প্রায় আধা ঘন্টা পর আমাদের যাত্রা শেষ হলো। উটের বসাটাও সেইরকম এক্সাইটিং। তবে এবার আর আমি কোনমতেই চিৎকার দিলাম না। উটওয়ালা আমাদের ক্যামেরায় ছবি তুলে দিলো। উট থেকে নেমে ১০ রুপি বখশিশ দিলাম তাকে। সবাই একে একে উটের পিঠ থেকে নেমে হাত পা ছুড়তে লাগলো। আমার একবার উটের পিঠে চেপে উটের দৌড়ে অংশ নিতে ইচ্ছা করলো কিন্তু কাউকে পার্টনার পেলাম না বলে সেটা আর হয়ে উঠলো না। খানিক্ষন ছবিটবি তুলে আমরা পায়ে হেঁটে আমাদের ক্যাম্পের দিকে যেতে লাগলাম। কিন্তু ক্যাম্প খুলবে সূর্যাস্তের পর। আমরা ক্যাম্পের বাইরে একটা টং ঘর টাইপের দোকানে জড়ো হয়ে বসলাম। অনেকেই সিদ্ধ ডিম, মিরিন্ডা, চা আর ম্যাগী নুডুলস অর্ডার দিলো।  আমি একটা চিপস কিনে খেলাম।

এদচ
কিস কিস কো চায় চাহিয়ে????             (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম দিশা)

সূর্যাস্ত দেখার জন্য আবার আমরা আগের জায়গায় ফেরত গেলাম। দৌড়ে দৌড়ে বালির ঢিবিতে উঠলাম আমরা। দেখলাম মরুভূমির বুকে সূর্যাস্ত। ছোট্ট কমলা সূর্যটা রঙ ছড়িয়ে কেমন করে যেন মেঘের পিছনে হারিয়ে গেলো। আমরা সবাই ছবি তুললাম। ছোট্ট একটা ভিডিওও করলাম। সূর্য ডুবে যেতেই আমরা সবাই ফিরতে লাগলাম ক্যাম্পের গেটের কাছে। পাকা ওয়ালের বাউন্ডারি দেওয়া বিশাল ক্যাম্পের গেটে লিখা আছে ‘ওয়েসিস ক্যাম্প’। পাশে আবার মাভালা ভাই আর মোহাম্মদ আলী ভাই –এই দুইটা নামের পাশে মোবাইল নম্বর লিখা আছে। গেটে জয়পুরি পোশাক পরা একটা মেয়ে হাতে বরন থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দুপাশে কতগুলো বর্শার মধ্যে লাল সবুজ কাপড় বাঁধা। আর একজন বিশাল একটা ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছে। আরও বাস ভর্তি লোকজন এসে নামলো। আমরা সবাই লাইন ধরে দাঁড়ালাম। মেয়েটা প্রত্যেকের কপালে লাল তিলক দিয়ে দিতে লাগলো। এটাই বরন। আমি মনে মনে ভাবলাম আমাদের দেশ হলে নিদেন পক্ষে একটা লজেন্স বা চকোলেট তো দিতই ঢুকার সময়! আমি কপালে তিলক না দিয়েই ভিতরে ঢুকলাম। খুঁজেখুঁজে আমাদের জন্য বরাদ্দ তাঁবুটা বের করলাম। তাবুতে ঢুকে আমাদের চোয়াল ঝুলে পড়লো। বেশ আলিশান তাঁবু। পুরোটাই কার্পেট দিয়ে ঢাকা। ভিতরে একটা রট আয়রনের ডবল বেড সাথে মোটা কম্বল। কম্বল পেয়ে আমার ভাবনা দূর হয়ে গেলো। তাঁবুর সাথেই এটাচড বাথ। বাথরুমও পুরোটা কার্পেটে ঢাকা। একটা পোর্টেবল কমোড, স্টিলের বাথটাব, আর আয়না দেওয়া স্টিলের বেসিন আছে। নিজেকে কেমন জানি রাজা রাজা মনে হলো। মরুর বুকে এরকম বিলাসবহুল থাকার জায়গা পাবো ভাবতেই পারি নাই!

সা
রাজস্থানী সাজে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় সাবরিনা মেহজাবিন রাত্রি)

আমরা ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এর মধ্যে বাইরে থেকে বারবার তাগাদা আসতে লাগলো, কি এক কালচারাল প্রোগ্রাম হবে সেখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য তা না হলে আমরা নাশতা পাবো না। ‘নাশতা’ শুনেই আমরা বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লাম, ফ্রিতে পাওয়া খাবার বলে কথা! তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে পড়লাম আমরা। খোলা আকাশের নিচে একটা খাটিয়ার মত স্টেজ, সেটাকে ঘিরে আরব মরুভূমিতে বসে হুক্কা টানার জন্য যেরকম গদি থাকে সেরকম গদি সাজানো। আমরা দৌঁড়ে পিছনের দিকে একটা গদি দখল করলাম। আমাদের লোকজন সবাই পিছনের দিকে বসতে লাগলো। আমরা দেখতে লাগলাম অনুষ্ঠান। কয়েকজন লোক আঞ্চলিক গান গাইলো, তারপর দুইজন নৃত্যশিল্পী নাচের পাশাপাশি নানারকম খেলা দেখাতে লাগলো। ভালোই লাগলো সেইসব দেখতে। এর মধ্যে আমাদের সেই ‘নাশতা’ এসে হাজির হলো। এক কাপ চা আর ছোট বাটিতে যেই জিনিসটা আসলো তার নাম ‘পোহা’। জিনিসটা মুখে দিয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। মনে হলো সিঙ্গারা, সমুচার গুঁড়ার সাথে পিয়াজ মরিচ কুচিকুচি করে দিয়ে চিনির সিরা ঢেলে দিয়েছে। অত্যন্ত বাজে এই জিনিসটা আর মুখে দিতে ইচ্ছা হলো না।

দ্ভ
পূর্ণিমা চাঁদের নিচে রাজস্থানী নাচের সাথে সাথে ব্যালেন্সের খেলা চলছে (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

আরও অনেক রকমের খেলা দেখলাম। একজন লোক চাকা আর আগুন নিয়ে কসরত দেখালো। তারপর নৃত্য শিল্পীরা উঠে এসে সবাইকে সামনে গিয়ে নাচার জন্য আহবান করলো। প্রথমে কয়েকজন ইন্ডিয়ান ইতস্তত করলো। অল্প কয়েকজন মিলে নাচা শুরু করলো। তারপর একে একে বাকিরা এগিয়ে গেলো। আমাদের মধ্যে অনেকে উশখুশ করলো সামনে যাওয়ার জন্য। তারপর অনেকে মিলে একসাথে গিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ালো, তারপর আস্তে আস্তে নাচা শুরু করলো। এক পর্যায়ে সব ইন্ডিয়ানরা একে একে সরে গেলো। সামনে নাচতে লাগলো শুধু দ্বিমিকবাসী। আমি, মাইশা, রুবাইদা, জেরিন আমরা বসে বসে দেখতে লাগলাম সবাইকে। ঝলমলে পোশাক পড়া মেয়েদের আর মাথায় পাগড়ি বাঁধা ছেলেদের দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম সবাইকে। এক পর্যায়ে তুষার এসে ওর পাগড়িটা খুলে আমাকে দিয়ে গেলো। আমি আনন্দের সাথে পাগড়িটা মাথায় পড়লাম।

এর মধ্যে খবর আসলো আমাদের জন্য ডিনার দেওয়া হয়েছে। আমরা খুশি মনে দৌঁড়ে দৌঁড়ে গেলাম ডাইনিং হলে। বুফে খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কিন্তু আইটেমগুলো সবই ভেজ আর অত্যন্ত জঘন্য লাগলো দেখতে। একটা কাউন্টারে ভাত পাওয়া যাচ্ছে শুনে ছুটে গেলাম সেখানে। লোকটা সামান্য এক চামচ ভাত দিলো। আমি নিজে চামচ দিয়ে আরও বেশি ভাত নিয়ে নিলাম। দেখলাম লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বোধহয় জীবনে কাউকে এক চামচের বেশি ভাত নিতে দেখে নাই। যেকয়েকটা তরকারি ছিলো সবই খেতে অত্যন্ত বাজে। কি আর করা, পেট ভরানোর জন্য তাই দিয়ে মেখে ভাত খেতে লাগলাম। আমাদের লোকজন একে একে আসতে লাগলো। একটু পর খবর পেলাম ভাত শেষ হয়ে গেছে। উনারা নতুন করে ভাত চড়াতে গেছে। ১০ মিনিট পর ভাত পাওয়া যাবে। আমি মনে মনে হাসলাম, এই লোকগুলোর সাথে বোধহয় আগে বাঙ্গালি কোন দলের সাথে পরিচয় হয় নাই।

অত্যন্ত পচা স্বাদের খাবার খেয়ে, বিশ্রি আচার টেস্ট করে সবাই মুখ ভেংচে বের হয়ে আসলাম সেই ডাইনিং হল থেকে। কালচারাল স্টেজের সব লাইট নিভে যাওয়ায় টের পেলাম আকাশে তখন বিশাল একটা গোল চাঁদ। মরুর বুকে ঝকঝকে পূর্ণিমার চাঁদ দেকে থ হয়ে গেলাম আমি। বিস্তীর্ণ মরুভূমিটাকে আলোতে উদ্ভাসিত করে দিয়ে রেখেছে গোল চাঁদটা। ঠান্ডার প্রকোপটা একটু একটু করে টের পেলাম। তাঁবু থেকে সোয়েটার নিয়ে এসে বসলাম আমরা স্টেজটার চারপাশে গোল হয়ে। গাইতে লাগলাম একের পর এক গান। মরুর বুকে পূর্নিমা, গান গাওয়াটা তো আসেই। কিন্তু আমরা বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে পারলাম না। আশপাশের তাঁবু থেকে কমপ্লেন আসতে লাগলো। আমরাও হাতে করে চেয়ারগুলো টেনে নিয়ে আমাদের তাঁবুর সারির কাছাকাছি গোল হয়ে বসলাম। আজকে রাতে মুরগির বারবিকিউ করার কথা। এখানে নন ভেজ অ্যালাউড না। তারপরও আমাদের বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছে বারবিকিউ করার জন্য। কিন্তু শর্ত একটাই, আগে সব মেহমানরা ঘুমিয়ে পড়বে তারপর আমরা বারবিকিউ করতে পারবো। একে একে সব লোক তাঁবুর ভিতর ঢুকে পড়লে ক্যাম্পের লোকজন গুটিগুটি পায়ে এসে এক হটপট ভর্তি রুটি, কেরোসিন তেল, বারবিকিউ করার চুলা, শিক, মেরিনেড করা মুরগির মাংস দিয়ে গেলো। ছেলেরা আর ক্যাম্পের লোকজন মিলে একটা গাছের কয়েকটা ডাল ভেঙ্গে আগুন ধরায়। তার উপর চুলাটা বসিয়ে মুরগির মাংসগুলো রেখে দেওয়া হলো। মাংসগুলো মেরিনেড করেছে জুবায়ের। হালাল মুরগি জোগাড় করে মেরিনেড করতে বেচারার যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে।

কনকনে ঠান্ডার মধ্যে মুরগির বারবিকিউ চলছে
কনকনে ঠান্ডার মধ্যে মুরগির বারবিকিউ চলছে

রাত বাড়ার সাথে সাথে হুহু করে ঠান্ডা বাড়তে লাগলো। আমরা জ্বলন্ত আগুনের চারপাশে আমাদের চেয়ারগুলো সাজিয়ে বসলাম। অন্তরা পুরো কম্বলটাই নিয়ে এসেছে। আমি ওর কম্বলে ভাগ বসালাম। স্নিকার পরা পা দুটোকে ঠেলে দিলাম আগুনের কাছাকাছি। প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে অনেকেই খাওয়ার আশা বাদ দিয়ে ঘুমাতে গেলো। রুবাইদা বলে গেলো বারবিকিউ শেষ হলে যেন ওকে খবর দেওয়া হয়। আমরা বাকিরা ধৈর্য ধরে বসে রইলাম। তুষার একটু পর পর মাংসগুলোকে উলটে পালটে দিতে লাগলো। আমরা বুভুক্ষের মত তাকিয়ে রইলাম গনগনে আগুনের উপর ঝলসাতে থাকা ছোট ছোট মুরগির টুকরাগুলোর দিকে। এর মধ্যে উৎপাত শুরু হলো কুকুরের। আগুন আর মাংসের গন্ধ পেয়ে ধাড়ি ধাড়ি কুকুর এসে হাজির হলো। সেগুলো কাউকাউ করতে লাগলো। একটা কুকুর তো সারার চেয়ারের নিচেই ঢুকে পড়লো। আর তাঁবুগুলোর মধ্যে নাই কোন তালার ব্যবস্থা। কাপড়ের দরজা ঠেলেই কুকুর গুলো ভিতরে ঢুকে পড়তে লাগলো। এই কুকুর বাহিনী সামলাতে না সামলাতেই বিশাল এক গরু এসে হাজির হলো। গরুটা দূর থেকে কড়া নজরদারি করতে লাগলো আমাদের উপর। গরু আর কুকুর সামলাতে সামলাতে আমাদের প্রথম দফা বারবিকিউ হয়ে গেলো। তুষার আর রাজিব মিলে সেগুলো যত্ন করে হট পটে তুলে রাখলো। কারণ অ্যাট লিস্ট যতজন উপস্থিত, ততটা টুকরা রেডি না হলে খাওয়া শুরু হবে না। দ্বিতীয় দফা মাংস চড়ানো হলো। সবারই প্রচন্ড ক্লান্তি লাগছে কিন্তু বারবি কিউ ফেলে কেউ যেতে রাজি হচ্ছে না। নোভাকে দেখলাম চেয়ারে বসেই গালে হাত দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। আশেপাশের কয়েকজন আবার নোভার সেই পোজের ছবিও তুলে ফেললো। মাথার উপর বড় একটা চাঁদ, চারদিকে ধবধবে জোছনা, মরুর ঠান্ডা বাতাস আর এর মাঝে আগুনের চারপাশে গোলে হয়ে বসে হাসি, তামাশা, গল্প আর গান করতে করতে বারবিকিউ হতে লাগলো। শুভ হাত তুলে গেয়ে শোনালো বরবাদ সিনেমার গান ‘আসো না’। পরবর্তীতে এই গানটাই আমাদের পুরো ট্যুরের যৌথ থিম সং হয়ে যায়।

sac
গভীর রাতে পূর্ণিমা চাঁদের নিচে আমাদের আড্ডা চলছে (কৃতজ্ঞতায় রিজভী হাসান )

আনুমানিক রাত পৌনে দুইটার দিকে দ্বিতীয় দফা বার বি কিউ শেষ হয়। তখন তৃতীয় দফা মাংস চাপিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি মুরগিগুলোর উপর। কাড়াকাড়ি করে হটপট থেকে আটার রুটি ভাগাভাগি করে নিয়ে কোনরকম মুরগির টুকরাগুলো নিয়ে আমরা গপাগপ খেতে থাকি। পোড়া রুটিগুলো শক্ত হয়ে গেছে, মাংস রুটি সবখানেই মিশে আছে বালি, মুখে দিতেই কিচকিচ করে উঠছে- কিন্তু তাতে কি? যে মজার ঝলসানো মাংসের স্বাদ পাচ্ছিলাম, তা আমাদের রাতের অখাদ্য ভেজ বুফের দুঃখ একেবারে ভুলিয়ে দিলো। তৃপ্তি করে খেলাম সবাই। আমাদের সবাইকে বলে দেওয়া হলো তাঁবুতে গিয়ে যারা ঘুমাচ্ছে তাদেরকে পাঠিয়ে দিতে। আমরা তিনজন তাঁবুতে ফিরে রুবাইদাকে গভীর ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। ও আর এত রাতে ঘুম ফেলে খেতে যেতে রাজি হলো না। আমরাও আর দেরি করলাম না। চটপট সবাই উঠে পড়লাম বিছানায়। ভারি আর পাতলা দুইটা কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

চোখের সামনে ভেসে উঠলো অনেক কিছু- জ্বলজ্বলে সোনালী দূর্গ, ধূ ধূ মরুভূমি, ক্যামেল রাইডিং, সূর্যাস্ত, কালচারাল নাইট, জঘন্য ডিনার, পূর্ণিমার আলোতে কনকনে ঠান্ডায় বারবিকিউ, বিলাসবহুল তাঁবুতে ঘুম……। সব মিলিয়ে ‘ডেজার্ট নাইট’ টা অসম্ভব ভালো কাটলো। এই সব ভাবতে ভাবতেই চট করে ঘুমিয়ে পড়লাম। পূর্ণিমার রাতে মরুভূমির বুকে তাঁবুতে ঘুম, সেই ঘুমের ভাবই আলাদা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *