‘স্কাল্পচার সেন্টার’ – যা মনে প্রশ্ন জাগায় হোয়াট ইজ আর্কিটেকচার???

যে দিন আমরা ‘স্বরচিত সেবতী’ নামক বাড়িটার উপর রিপোর্ট করে প্রথম দফা জমা দিলাম, সেই দিনই নতুন প্রজেক্ট ঘোষণা করা হলো, ‘স্কাল্পচার সেন্টার’ যার সাইট ধানমন্ডিতে। পরদিন হরতালের মধ্যে পড়িমড়ি করে ছুটে গেলাম সাইট দেখতে। সেই থেকে শুরু হলো আমার স্কাল্পচার সেন্টারের পথ চলা। শুরুতেই স্টুডিওতে রিয়াদ স্যারের স্বপ্নময়ী আইডিয়া শুনে পুরা মাথাটা আউলে গেলো। যেই ফর্ম চিন্তা করি, সেটাই অর্ডিনারি মনে হয়। অনেক কষ্টে কাবজাব ওয়ালা একটি চোঙ্গা সদৃশ ফর্ম নিয়ে হাজির হলাম। স্যারের কথায় সেই ফর্ম ঝড়ো হাওয়ার মতই উড়ে গেলো। আবার শূন্য অবস্থায় ফেরত আসলাম। তারপর যেই ফর্ম বানালাম, সেটা দেখে আশেপাশে সবাই বললো, ‘স্মৃতি সৌধ থেকে ইন্সপিরেশন নিয়েছো বুঝি?’ যা হোক মোটামুটি নিজের সেই ফর্মটা নিজের কাছে ভালোই লাগে। এরপর পরের স্টেপ ফাংশন সলভ করতে শুরু করলাম। শুরু করতে গিয়েই বুঝলাম এই ফর্মে আদৌ ফাংশন ঢুকানো সম্ভব না। তবুও পড়ে রইলাম সেই ফর্ম নিয়ে, কিছু একটা করেই ছাড়বো। এইভাবে কেটে গেলো প্রায় দুই সপ্তাহ। শূন্য এক ফর্ম নিয়ে পাগল পাগল হয়ে ঘুরি, সমাধান পাই না, আইডিয়া পাই না..
তারপর একদিন স্টুডিওতে আসলেন শাহেদা ম্যাডাম। ম্যাডাম এসে এমন এক লেকচার দিলেন, যা শুনে আমি ডিসাইড করি, অনেক হয়েছে আর না। নতুন ফর্ম চাই, তবে আগের চাইতে সহজ এবং সাধারণ। বাসায় এসে সব নতুন করে ডিসাইড করি- সেই বাবল ডায়াগ্রাম, সেই স্কেমেটিক ডায়াগ্রামে ফেরত যাই। পুরাই জিরো থেকে শুরু করি। আবার যাই স্টুডিওতে স্যারদের দেখাতে। সিরিয়াল অনুসারে বাঁধন ভাইয়াকে ডিজাইন দেখাতে যেতে হয়, কিন্তু সাইটের উপর প্ল্যান না এঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেদিন তিনি ডিজাইন দেখেন না। পরদিন কোন এক কারণে সরকারী ছুটি থাকলেও ডিপার্টমেন্টে আমাকে যেতে হয় ডিজাইন দেখানোর জন্য। মোটামুটি রকম কমেন্ট আর রেফারেন্স পেয়ে যখন বের হয়ে আসি, তখন মনে এক ধরনের ফুরফুরে আনন্দ। যাক, আমার ডিজাইন প্রসেস দেরিতে হলেও শুরু হয়েছে।
কিন্তু আটকা পড়ি পরের সপ্তাহে। আগের ফর্ম আর কিছুতেই বাঁধন ভাইয়ার পছন্দ হয় না। বারবার ফর্ম ভেঙ্গে ফেলার পরামর্শ আসে। তারপর সাহস করে ফর্ম ভেঙ্গেই ফেলি। তৈরি হয় অতি জটিল ফর্ম। ভয়ানক ত্যাড়াব্যাকা। ফাংশন সলভ করতে গিয়ে হিমশিম খাই। তারপর আবার দেখাই, এবারও ফর্ম ওনার পছন্দ হয় না। জটিল ত্যাড়াব্যাকা ফর্মের কুফল বুঝতে পারি এবং আবার ফর্ম বদলে ফেলার পরামর্শ পাই। জমার এক সপ্তাহ আগে এরকম পরামর্শ পেয়ে হতাশা চেপে ধরে আমাকে। সাহস করে রিয়াদ স্যারকে দেখালেও তিনিও ফর্ম সহজ করে বদলে ফেলার একই পরামর্শ দেন। আবার সিদ্ধান্ত নেই প্রথম টাইপের ফর্মে ফিরে যাবো, যা চেঞ্জ করার সেটাতেই করবো। শুরু হয় পি. এল.। ক্লাশ খুললেই শনিবার জমা। তার আগের রবিবার আমি শেষবারের মত প্রিলি দেখাতে যাই। সেদিনও ফর্ম চেঞ্জ হয়, রুফ নিয়ে নতুন আইডিয়া পাই। রিকয়ারমেন্ট অনুযায়ী ড্রইং করতে গিয়ে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। এত ড্রইং শেষ করে মডেলসহ শনিবার জমা দেওয়া সম্ভব না।
যাই হোক নাক মুখ গুঁজে ড্রইং করতে থাকি। দিন যায়, রাত আসে, রাত যায়, দিন আসে, কিন্ত কাজ আর শেষ হয় না। শুক্রবার রাতে পাগলের মত কাজ করে সকাল বেলা বুয়েটে গিয়ে দেখি বাঁশ ফেলে গেট ব্লক করা। কোন মতে ভিতরে ঢুকে দেখি সাবমিশন ক্যান্সেল। জানে পানি ফেরত আসে। আবার সব কিছু গুছিয়ে বাসায় আসি। গোসল করে, খেয়ে দেই ঘুম। সন্ধ্যাবেলা ডিপার্টমেন্টে আসি, পরদিন পহেলা বৈশাখের কাজ করার জন্য। সব ব্যাচ ধুমসে কাজ করছে, শুধু আমাদের ব্যাচ এতিমের মত ঘোরাঘুরি করছে- আমাদের কোন প্রিপারেশন নাই, প্ল্যান নাই, কিছুই নাই। অনেক কষ্টে এক খানা স্ট্রাকচার জোড়াতালি দিয়ে মাস্কট বানানো হলো। পরদিনও সেই একই অবস্থা। সব ব্যাচেরই সবাক অংশগ্রহন আছে, খালি আমরা কিছুতেই নাই। যাই হোক, বেশ রাত পর্যন্ত কনসার্টে থেকে বাসায় আসি।
পরদিন খবর পাই আজকে জমা। আবার মাথায় বাজ পড়ে। তাড়াতাড়ি ড্রইংয়ের শুরু করি। খানিক বাদেই খবর পাই, আজকে জমা দেওয়া সম্ভব না। আবার খানিক বাদেই খবর পাই আজকেই হবে জমা। সব মিলিয়ে মাথায় তখন দেড়শ টনের চিন্তা। যাই হোক অনেক কষ্টে আমরা আবার স্যারদের বলে কয়েকটা দিন সময় বাড়াই।

তারপর শুরু হয় সেই লেভেলের কোপা জুরি- যাকে বলে রক্তাক্ত অবস্থা।শাহেদা ম্যাডামের চরম কোপ খেয়ে কয়েকজন ছাড়া আমরা অধিকাংশই মাটির সাথে মিশে গেছি।দীর্ঘ দেড়-দুই মাসের সাধনা পুরস্কারের বদলে তিরস্কার উপহার দেওয়ায় বিষন্নতার ছায়া নেমে আসে জীবনে। এক বুক হতাশা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে হোয়াট ইজ আর্কিটেকচার??? 

সবচাইতে মজার ব্যাপার হয় টার্ম শেষে যখন আমাদের গ্রেড টানানো হয় তখন অবাক হয়ে আমরা জানতে পারি যে আমাদের স্কাল্পচার সেন্টারের টোটাল গ্রেড, ফাইনাল প্রজেক্ট কমার্শিয়াল ব্যাংকের একটা প্রিলির গ্রেডের সমান গুরুত্ব পেয়েছে। তাহলে এই দেড় দুই মাস পাগলের মত খেটে, পহেলা বৈশাখ বিসর্জন দিয়ে, জুরিতে সাফ ধোলাই খেয়ে রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে বাসায় যে ফিরলাম, তার অর্থ কি হল? কিসের জন্য এত খাটলাম আর সেই খাটনির মূল্যটাই বা কি রইলো?   হোয়াট ইজ আর্কিটেকচার??? ???

আমার বেকুব হওয়ার কাহিনী (পর্ব-৩)

ভারতীয় উপমহাদেশে চারশত খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত শাসনামলে প্রথম মন্দির বা ‘টেম্পল’ এর ধারনা আসে। গুপ্ত সম্রাজ্যের পর প্রভাকরবর্ধন (৫৮০-৬০৫), রাজ্যবর্ধন(৬০৫-৬০৬) এবং হর্ষবর্ধন(৬০৬-৬৪৭)নতুন সম্রাজ্যের শুরু করেন সে সময় শাসক রাজ্যবর্ধনের সাথে বর্তমান বাংলাদেশ এলাকার রাজা শশাঙ্কের সাথে কিছুটা গন্ডগোল হয়, যার ইঙ্গিত সংক্ষিপ্ত শাসনামল দেখেই কিছুটা পাওয়া যায়। তবে আসল মিরাকেল ঘটে হর্ষবর্ধনের শাসনামলে। গুপ্ত সম্রাজ্যের সময়ই সর্বপ্রথম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিলো পাটালিপুত্রের পাশে পাটনা শহরের ৫৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে। হর্ষবর্ধনের সময় এই বিশ্ববিদ্যালয় উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিলো।

মোটামুটিভাবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টা কলেজ ছিল সব মিলিয়ে যার ছাত্র সংখ্যা ছিলো ১০ হাজার। সুন্দরভাবে প্ল্যান করা ৮টা আলাদা বিল্ডিং ছিলো যা দেখতেও ছিলো খুব চমৎকার। তিনটা ভিন্ন দালানে ছিলো সমৃদ্ধ পাঠাগার যাদের নাম ছিলো রত্নসাগর, রত্নদধি ও রত্ন্ররঞ্জক। সম্ভবত প্রত্যেকটা দালান প্রায় ৯ তলা বিল্ডিঙের সমান উঁচু ছিলো। উল্লেখ্য পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ইটের তৈরি ছিলো। এটি ছিলো পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত উঁচু মানের পড়াশোনা হতো। বৌদ্ধ দর্শন, গনিত, আয়ুর্বেদ, চিকিৎসা বিজ্ঞান, আইন, বৈদিক দর্শনসহ আরও অনেক বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর একজন বাঙালি ছিলেন। ভদ্রলোকের নাম ছিলো শীল ভদ্র। পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিও ছিলো। নিয়মিত বিতর্ক হতো। ছাত্রদের ক্লাস অ্যাসাইন্মেন্ট দেওয়া হত। বিশ্ববিদ্যালয় ২৪ঘন্টা খোলা থাকতো। বাইরের দেশ থেকে ভিজিটিং প্রফেসররা আসতেন। কোরিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, চীন, তুরস্ক এবং ইরান থেকেও ছাত্ররা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতো।

সবচাইতে চমৎকার ব্যাপার হলো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ব্যবস্থা। এত বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সরকার থেকে কোনও বরাদ্দ দেওয়া হত না। আশেপাশের ১৮০টা গ্রামের সকল আয় ব্যায় করা হত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে।

হর্ষবর্ধনের সময় পরিব্রাজক হিউয়েন সাং উপমহাদেশে এসেছিলেন। তার বিবরণ থেকে নালন্দা সম্বন্ধে জানা যায়। ‘হর্ষচরিত’ বই থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। লেখক এ. ঘোষ এর বই ‘এ গাইড টু নালন্দা’ থেকে বর্তমান যুগে নালন্দা ভ্রমনের অভিজ্ঞতা জানা যায়।

এবার আসা যাক তুলনায়। আমরা আবার সবসময় নিজেদের ‘মূর্খ, অসভ্য, অশিক্ষিত’ জেনেছি আর ইউরোপিয়ানদের ‘জ্ঞানী, সভ্য, শিক্ষিত’ জেনে এসেছি তো, তাই তাদের সাথে ছোট্ট একটা তুলনা না করার লোভ সামলাতে পারছি না। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে হিউয়েন সাং যখন নালন্দার কথা লিপিবদ্ধ করতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়ে বর্তমান ইতিহাসখ্যাত অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তখনও জংগল হয়ে পড়ে আছে। আর আমেরিকা? আমেরিকা তখনও কলম্বাস আবিষ্কার করেন নি। সভ্যতার ছোঁয়া সেখানে পৌঁছাতে আরও শত শত বছর বাকি।

স্যারের কথা শুনে আমি চুপ করে বসে থাকি। প্রায় এক হাজার বছর আগে এই ছিলো আমাদের সাথে ইউরোপ-আমেরিকার তুলনা। আর এখন?

আমার বেকুব হওয়ার কাহিনী (পর্ব ২): পাটালিপুত্র শহর ও অশোকের স্তুপা

ভারতবর্ষের ইতিহাসে গ্রীকদের শাসন বেশ উল্লেখযোগ্য। তবে সে আমলের কোন কথা ভারতের কোন অধিবাসীর রের্কড থেকে পাওয়া যায় নাই। আমাদের সেই আমলের কথা আমরা বিদেশিদের কাছ থেকে জানতে পারি। স্যার এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেন যে, আমাদের ইতিহাস আমরা সংরক্ষণ করিনি- করেছে বিদেশিরা। জনৈক গ্রীক অ্যাম্বাসেডর মেগাস্থিনিসের বিবরন থেকে সেই আমলের কিছু কথা জানা গেছে। গ্রীকরা এদেশের যে জিনিসটা দেখে বেশি অবাক হত তা হলো, এদেশের মানুষ দিনে মাত্র দুই ঘন্টা কাজ করে আর সারা দিন গল্প করে, গান গায়, খায়দায় আর ঘুমায়। গ্রীকদেশের বৈরী আবহাওয়ার জন্য তাদের মানুষদের স্বভাবতই কর্মঠ ও পরিশ্রমী হতে হয়। কঠোর পরিশ্রম করে তারা একমুঠো ফসলের জন্য। অথচ এদেশে মাটিতে বীজ পড়লেই গাছ হয়ে যায়, নদীতে জাল ফেললে কাঁড়ি কাঁড়ি মাছ পাওয়া যায়, কনকনে শীত নেই, নেই ঝাঁ ঝাঁ গরম, সবসময় আরামদায়ক আবহাওয়া। এখান থেকেই সেই কথাটা এসেছে, ”হায় সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!”। উল্লেখ্য সেলুকাস ছিলেন ভারতবর্ষে আলেক্সান্ডারের গভর্নর। তারা অবাক হওয়ার পাশাপাশি এদেশের অঢেল প্রাচূর্য এবং ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েছিলো।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য অন্যান্য গ্রীক গভর্নরদের পরাজিত করেন। শুধু সেলুকাসের সাথে চুক্তি করা হয় এবং তাকে ২০০ হাতি (খুব সম্ভবত) দেওয়া হয়। সে সময় পাটালিপুত্রে রাজধানী স্থাপন করা হয়। স্যার বড় পর্দায় পাটালিপুত্রের যে ছবি দেখালেন তা দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। পুরো শহর উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, ফাঁকে ফাঁকে তীরন্দাজদের জন্য ছোট ছোট খোপ, শহরের চারপাশে চওড়া ও গভীর পরিখা, ৫০০টা টাওয়ার, ৬৪টা গেট – এ এক বিশাল কান্ড! দেওয়াল, দূর্গ, ঘরবাড়ি অর্থাৎ পুরো শহর কাঠের তৈরি ছিলো। ছবিটা দেখে আমার চোয়াল ঝুলে পড়লো। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালের দিকে আমাদের এত উন্নত শহর ছিলো! কি অবাক করা কান্ড!!

তাদের শাসন ব্যাবস্থা শুনে আমি আবার বেকুব হয়ে গেলাম। রাজা চন্দ্রগুপ্ত ৩০ জন সদস্য নিয়ে ৬টা বোর্ড তৈরি করেছিলেন। তাদের কাজ ছিলো যথাক্রমে,

  • শিল্পজাত পন্যের উৎপাদন পর্যবেক্ষন করা
  • বিদেশি অর্থাৎ গ্রীকদের সমস্যা সমাধান করা
  • জন্মমৃত্যুর হিসাব রাখা
  • বাজারে পন্যের গুণাগুণ ও ওজন পর্যবেক্ষন করা
  • ভেজাল, বাসি ও পচা জিনিসপত্র যাতে পন্যে মিশানো না হয় তা পর্যবেক্ষন করা
  • পন্যের বিক্রয়মূল্য থেকে ট্যাক্স আদায় করা

৬টা বোর্ডের মধ্যে প্রায় ৪টাই বাজারের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। অত বছর আগেও রাজা অন্যান্য সবকিছু থেকে বাজারকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আর এতবছর পরও আমরা ঠিকমত বুঝতে পারছি না বাজার ব্যাবস্থাকে আসলে কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো। হায়, আমরা কত অভাগা জাতি!

সাঁচিতে অবস্থিত তোরনসহ একটি স্তুপা

এরপর সম্রাট অশোকের সময় স্থাপত্যের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার শুরু হয়। স্তুপা নামক অর্ধগোলাকৃতি এক ধরনের স্থাপনা তৈরি করা হয় যার উচ্চতা ৩৫ ফুট, ব্যাসার্ধ ৭০ ফুট। এর গেটকে বলা হতো ‘তোরন‘ যাকে অনুসরন করে এখন জাপানে বিভিন্ন রকম গেট তৈরি করা হয়। কি আশ্চর্য, জাপানিজ গেটের উৎপত্তি আমাদের ভারতবর্ষে!! হাঁ হয়ে গেলাম যখন শুনলাম ১/২ টা নয়, সম্রাট অশোক সারা ভারতবর্ষে ৮৪০০০টা স্তুপা তৈরি করে গিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে অজন্তা ইলোরায় পাহাড় কেটে বানানো বিশেষ ‘রক কাট চেম্বার‘ বানানো হয়েছিলো। আরও ছিলো বৌদ্ধবিহার বা মনেস্ট্রি। সেগুলোর প্ল্যান দেখে থ হয়ে গিয়েছিলাম। কি বুদ্ধি ছিলো মানুষের! এত সুন্দর প্ল্যান করা জিনিস আমাদের এখানে ছিলো ভাবতেই কেমন অদ্ভুত লাগে।

আমার বেকুব হওয়ার কাহিনী (পর্ব ১): সিন্ধু সভ্যতা এবং আলেক্সান্ডার

খুব ছোটকালে বাঙালি জাতি সম্পর্কে চমৎকার ধারনা পেয়েছিলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে। কবিতার কয়েকটা লাইন এরকম ছিলো,

”অলস দেহ ক্লীষ্ট গতি-
গৃহের প্রতি টান।
তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু
নিদ্রারসে ভরা,
মাথায় ছোট বহরে বড়
বাঙালি সন্তান।”

কবিতাটা পড়ে তখন থমকে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভাবলাম সত্যি সত্যি বাঙালি কি এমন? নাহলে কবিগুরু তো আর এমনি এমনি লিখে যাননি। আস্তে আস্তে সব কিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে এলো, কবিগুরু কোন ফালতু কথা বলে যাননি। বাঙালি আসলেই এমন। এটা বোঝা অবশ্য কঠিন কিছু না। আমরা পরপর তিনবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, এটা কি এমনি এমনি সম্ভব? আমার বিদেশে থাকা কাজিনদের কাছ থেকে শুনতে পাই বাঙালি পরিচয় দিলে ওদের কতরকম অসুবিধা হয় কারন ওদের দেশে সকল প্রকার অপরাধ কর্মের সাথে সাথে কমপক্ষে এক জন বাঙালি জড়িত থাকবেই। এক কাজিন তো বলেই ফেললো কোনভাবে ন্যাশনালিটি বদলানো যায় কিনা! তাছাড়া সব কাজে বাঙালি নিজেকে নিজেই ব্যাঙ্গ করে, যেমন- বাঙ্গালির টাইম বলে একটা কথা আছে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি এটা কোন বিদেশি মানুষ বলে যাননি। বাঙালি যে সময়ানুবর্তীতার প্রতি কেমন উদাসীন তা প্রমান করার জন্যই নিজেরাই এই প্রবচন চালু করেছে। যতই বড় হচ্ছি ততই দেখছি বাঙালি হিসেবে আসলে বড় গলায় বলার কিছু নেই। আমাদের গর্ব করার বিষয় শুধু বায়ান্ন, একাত্তর আর ড. মুহম্মদ ইউনুস। এছাড়া এত বিশাল জাতি হিসেবে আমাদের সত্যিকার অর্থে অর্জন খুব বেশি কিছু নাই।
আমি এই ধারনা নিয়েই এত বছর বেড়ে উঠেছিলাম। অন্তত কয়েক মাস আগ পর্যন্ত আমার বাঙালি জাতি সম্পর্কে এই ধারনাই ছিলো। কিন্তু রমজান মাসের এক শনিবার হঠাৎ আমি ধাক্কা খেলাম। যে সে ধাক্কা না, বেশ বড়সড় ধাক্কা।

আমাদের লেভেল-১, টার্ম-২ এ নতুন একটা কোর্স পেলাম যার নাম হিস্ট্রি অফ বেঙল আর্কিটেকচার। খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিলাম প্রচন্ড বোরিং একটা ক্লাস হবে। কিন্তু ক্লাসে ঢুকে স্যার প্রথম যে কথা বললেন শুনে হচকিয়ে গেলাম। স্যার আমাদের খুব সিম্পল প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশে কয়টা নদী আছে? বেশ অবাক হয়ে আমি আবিষ্কার করলাম প্রশ্নের উত্তরটা তো আমি জানিনা। শুধু আমি যে জানিনা তা নয়, ক্লাসের কেউই সঠিক উত্তরটা জানে না। স্যার বললেন, ”আমাদের দেশ সম্পর্কে আমরা শুধু এটা জানি যে আমরা আসলে কিছুই জানি না”। লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেলো। স্যার জানতে চাইলেন আমাদের প্রধান খাদ্য চালের বাৎসরিক চাহিদা সম্পর্কে। আমরা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। স্যার বোর্ডে বিশাল সংখ্যাটা লিখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”আমরা পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের একটা হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার চাল খাই। শুধু খাই না, সবটাই নিজেরা উৎপাদন করি। এটা মোটেই কম কথা নয়”। খানিকপর স্যার বললেন আমাদের ইতিহাসের কথা। মহেঞ্জদারো, হরপ্পা, সিন্ধু সভ্যতার কথা। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে গড়ে ওঠা সে শহরে ছিল ড্রেনেজ সিস্টেম, অ্যাটাচড বাথরুম, আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াটার স্টোরেজ। একই সময়ে ইংল্যান্ডে চলছে স্টোনহেঞ্জের যুগ! শুনে আমি কেমন যেন বেকুব হয়ে গেলাম। আমাদের ভারতবর্ষে যখন প্ল্যানড সিটি, ইংল্যান্ডে তখন মাত্র স্টোনহেঞ্জ!! স্কুল কলেজে শিক্ষা নিতে নিতে জীবনের ১২ টা বছর পার করলাম, অথচ আমাদের ইতিহাসের এই সাংঘাতিক কথাটা আমি জানতাম না। কি আশ্চর্য!!!

পরের ক্লাসগুলোতে আরও ধাক্কা খেলাম। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে যখন আলেক্সান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমন করে, তখন পুরো ভারতবর্ষ দখল করলেও মাত্র দুটো এলাকা আক্রমন করে নাই। সত্যি বলতে আক্রমন করার সাহস পায় নাই। সে এলাকার দূর্গ এবং রক্ষণ ব্যবস্থা এতই উন্নত ছিলো যে আলেক্সান্ডারের নীতিনির্ধারকেরা সে দিকে আক্রমণ করার চিন্তা ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছিলেন। সে জায়গা দুটোর নাম ছিলো গঙ্গারিডো আর প্রাসিওই। নাম দুটো গ্রীকদের দেওয়া। যখন নাটকীয়ভাবে স্যার বললেন প্রাচীন এই দুটো জায়গাকে বর্তমানে বাংলাদেশ বলা হয়, আমার মাথায় বাজ পড়লেও আমি এত অবাক হতাম না। কি সাংঘাতিক কথা, আমার দেশ এত উন্নত ছিলো! আলেক্সান্ডার দ্যা গ্রেট পর্যন্ত এই দেশ আক্রমন করতে সাহস পায় নি। হায় খোদা! নিজের দেশের এই কথা আমি এত বছর জানলাম না, কি পোড়া কপাল!!

আগে বাঙালি হিসেবে মানসিকভাবে ‘একটু’ দূর্বল ছিলাম, এখন আমি আর দূর্বল না। আমার ভারতবর্ষ, আমার দেশের ইতিহাস মোটেও হেলাফেলা করার মত না। শুধু দুঃখের ব্যাপারটা হলো, এই সাংঘাতিক ইতিহাসগুলো আমরা কেউই জানি না। এই স্যার না বললে আমরাও কোনদিন জানতে পারতাম না।

লাইফে আর কি (Archi)!

মানুষের কল্পনারও পরিধি থাকে, আমারও ছিলো। কিন্তু বাস্তবতা আমার কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। কল্পনায় অনেক কিছুই দেখতাম, বড় হয়ে এই হবো, সেই হবো । কিন্তু কোনদিন ভুলেও ভাবিনি আর্কিটেক্ট হবো। নিয়তির কি অদ্ভুত খেয়াল, আমার ঠিকানা এখন স্থাপত্যে। তো যাই হোক, ভর্তি পরীক্ষার পর থেকে ক্লাশ শুরু হবার আগ পর্যন্ত কি কি ঘটেছে সেই কথা আর নাই বললাম, লেভেল ১ টার্ম ১ শেষ করে তিন মাস পিছনে ফিরে দেখতে ইচ্ছা করছে কেমন কাটলো আমার প্রথম আর্কি লাইফ।

ফেব্রুয়ারী মাসে প্রথম যেদিন ক্লাশ করতে আসলাম, সবার আগে দেখা হলো আমার মতই ইতস্তত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো সারার সাথে। একটু সামনে এগিয়ে আমার স্কুল কলেজের কিছু পুরানো মানুষজন খুঁজে পেলাম। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ক্লাশে ঢুকলাম। ক্লাশ নিতে যিনি আসলেন তাঁকে দেখে আর যাই মনে হোক টিচার মনে হয় নাই। ক্লাশ শেষ হওয়ার পর টপাটপ দুজন সিনিয়র ভাইয়া ঢুকে গম্ভীর গলায় বললেন, “ক্লাশ শেষে প্রত্যেককে যেন ডিজাইন স্টুডিওতে পাই। দুজনের মধ্যে একজনকে আমি চিনতে পারলাম, টিভিতে নাটক করে। সামান্য ভয় লাগলো আসন্ন র‍্যাগএর কথা চিন্তা করে।

ডিজাইন ক্লাশ শেষে আমরা বিরিয়ানি আর কোক পেলাম। কিন্তু খাওয়ার আগেই সিনিয়ররা এসে পড়লো। তক্ষুণি টের পেলাম র‍্যাগকি জিনিস! যাই হোক, অনেক ঝামেলার শেষে ক্লাশ ও ওরিয়েন্টেশন শেষ করে যখন বাসায় ফিরলাম, তখন শরীরে আর কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। দীর্ঘ তিন মাস আরামে লুতুপুতু হয়ে যাওয়া শরীরের পক্ষে সারা দিনের ধকল সহ্য করতে পারা কষ্ট বইকি।

সপ্তাহ খানেক ক্লাশ করে যেটা বুঝতে পারলাম তা হলো আমরা অন্য সব ডিপার্টমেন্ট থেকে আলাদা। আমাদের সিনিয়ররা আমাদের র‍্যাগ দিয়ে চরম আনন্দ পায় যা আর কোন ডিপার্টমেন্টে নেই। তবে র‍্যাগ জিনিসটা যে একেবারে খারাপ তা বলবো না, কারণ এই র‍্যাগের কারণেই সিনিয়রদের সাথে আমরা খুব সহজেই পরিচিত হতে পেরেছি। তাই অন্য ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা যখন বলে যে সিনিয়রদের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই, তখন একটু অবাকই লাগে। আরও একটা জিনিস বুঝতে পারলাম, এখানে সব কিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে হয়। আমার ডিজাইন স্যারের পছন্দ হবে কিনা সেটা বুঝার কোন উপায় নেই। সবচেয়ে বড় যে কথা সেটা হল, আর্কিটেকচার পড়তে চাইলে অবশ্যই পকেট ভারী থাকতে হবে।

নবীন বরণ অনুষ্ঠানে গিয়ে যেটা আবিষ্কার করলাম সেটা হলো, স্টেজে পারফর্মার উঠলে তাকে দলগতভাবে পঁচিয়ে সবাই বিমলানন্দ পায়। আমাদের তো সিনিয়ররা পঁচানি দিচ্ছিলোই পাশাপাশি আমাদের ইমিডিয়েট সিনিয়র, যারা অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করেছিলো তাদের সহ পঁচানো হচ্ছিলো। তবে এ কথা ঠিক যে, যাকে পচানো হয় সে ছাড়া বাকি সবাই ব্যাপারটা খুব উপভোগ করে। যেমন গান শুরু করার আগে গিটার টেস্ট করতে অনেকক্ষণ লাগছিলো বলে পিছন থেকে সব আপু ভাইয়ারা একসাথে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারীগানটার কোরাস ধরেছিলো। স্টেজে থাকা ভাইয়ারা তখন কি যে বিব্রত হয়েছিলো…………

একই ঘটনা দেখা গেলো পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে। সেখানে একটা হাই থট নাটক হচ্ছিলো যার নাম দুইয়ে দুইয়ে চার‘ ( অবশ্য আমার এক বন্ধুর ভাষ্য অনুযায়ী নাম হওয়া উচিত ছিলো মাথার স্ক্রু ঢিলাGrin )। তো যেহেতু হাই থট নাটক, তাই অর্থ বোধগম্য হবে না এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আশ্চর্য হচ্ছে আমরা ভাষাটাও বুঝতে পারলাম না। তাই বারবার পিছন থেকে আবেদন আসছিলো, “সাবটাইটেল চাই” কিংবা ট্রানশলেশন করে দেন। খানিক পর সরাসরি আক্রমণ আসলো বন্ধ কর নাটক”, “ভাই মাফ করেন, আর না”। অবশেষে নাটক শেষ হবার সময়ও নানারকম খোঁচা মার্কা মন্তব্য করে বেচারা পারফর্মারদের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করা হলো।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে যখন কোন অনুষ্ঠান হবে সেখানেও এই পঁচানোর ধারা অব্যাহত থাকবে। এটাই হয়তো এই ডিপার্টমেন্টের ঐতিহ্য যা আর কোন ডিপার্টমেন্টে নাই।