The Mighty INDIA CALLING: রাজধানী দিল্লীতে পদার্পণ (পর্ব ৬)

সকাল সাড়ে সাতটা কি পৌনে আটটার দিকে উর্মির ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গে। উর্মি বলতে থাকে আমরা নাকি প্রায় চলে এসেছি। আমি অবাক হয়ে যাই। আমাদের দুপুর বেলা দিল্লী পৌঁছানোর কথা আর এখন সকাল বেলাতেই চলে এসেছি –এটা আবার কেমন কথা। মনে হলো ট্রেন বুঝি রাতে উড়ে উড়ে এসেছে। যাই হোক ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে মালপত্র সব গুছিয়ে বসতে বসতে অনেকক্ষণ কেটে গেলো। এর পর দেখলাম নিলয়ের সাথে কানটুপি পরা এক লোক বেশ কথা বলছে ইংরেজীতে। উনি আমরা ৪৬ জন দেড় মাসের জন্য বেড়াতে এসেছি শুনে বেশ পুলকিত হয়েছেন। খানিকক্ষণ পর উর্মি আর চিংয়ের সাথেও নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। আমাদের কথা, বাংলাদেশের কথা, বুয়েটের কথা এইসব নিয়ে আলোচনা হতে লাগলো।

এক পর্যায়ে উনি জিজ্ঞেস করলেন এই দেশ কেমন লাগছে আমাদের কাছে। উর্মি জবাব দিলো ভালো লাগছে, কোলকাতা খুব চমৎকার লেগেছে। উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন আমাদের অভিজ্ঞতা কি ইন্ডিয়া নিয়ে? এই বার আমি দৃষ্টি আকর্ষন করে বললাম, ‘এই যে ব্যাগের সাথে লাগানো যে শিকলগুলো দেখতে পাচ্ছেন, আমি আমার দেশে অনেকভাবে ভ্রমণ করেছি কিন্তু কখনো এই জিনিস কখনো দেখি নাই। শিকল দিয়ে ব্যাগের সাথে তালা মেরে রাখার ব্যাপারটা আমাদের কাছে একেবারেই নতুন’। ভদ্রলোক বেশ লজ্জা পেয়ে গেলেন আমার কথা শুনে। উনি আরও অনেকক্ষণ কথা বললেন। আমার পাশের মহিলাও আমাদের সাথে যোগ দিলো। ঠিক স্টেশনে নামা নিয়ে আমরা টেনশনে ছিলাম। কিন্তু উনারা আমাদের আশস্ত করলেন যে আমাদের ঠিক স্টেশনেই নামিয়ে দিবেন।

কমলাপুরের আগে যেমন এয়ারপোর্ট স্টেশন, নিউ দিল্লীর আগে তেমন গাজিয়াবাদ স্টেশন। গাজিয়াবাদ আসার পরই দেখলাম যাত্রীরা সবাই মালপত্র নিয়ে একদম রেডি। আমরা প্রায় দশটার দিকে নিউ দিল্লী স্টেশনে নামলাম। সবাই একত্র হয়ে আমরা স্টেশনের ভিতরেই মালপত্র নিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগলাম, আর আমাদের কমিটির লোকজন গেলো হোটেল ঠিক করতে। স্টেশনের ভিতরেই ম্যাকডোনাল্ডস থেকে সকালের নাশতা ম্যাক আলু টিক্কি খেলাম ২৮ রুপি দিয়ে। খেয়ে পেট ভরে গেলো। অনেকে আবার চিকেন আর ভেজ র‍্যাপ খেয়েছে ৭০ রুপি দিয়ে।

্দচে
আমাদের নিউ দিল্লী স্টেশনে রেখে কমিটি গেছে হোটেল ঠিক করতে (কৃতজ্ঞতায় সারাহ তাবাসসুম)

অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পর হোটেলের সন্ধান পাওয়া গেলো। হোটেল থেকে আমাদের জন্য মাইক্রোবাস পাঠানো হয়। সেইগুলোতে মালপত্র তুলে আমরা গাদাগাদি করে চড়ে বসি। দিল্লী ব্যস্ত শহর। আশেপাশে অনেক ঘোড়ার গাড়ি। গাড়িতে আমার বেশ গরম লাগে। সব শীতের কাপড় খুলে আমি ব্যাগের উপর মাথে রেখে ঘুমিয়ে পড়ি। দুপুর পৌনে একটায় আমরা পাহাড়্গঞ্জের হোটেল ইউকে তে পৌঁছাই। হোটেল ম্যানেজারের চেহারা অত্যন্ত ধুরন্দর। উনি কুতকুতে চোখ আর পুরুষ্টু গোঁফ নিয়ে কমিটির লোকজনদের সাথে কথা বলতে লাগলেন। হোটেলে আমাদের চারজনের গ্রুপ ভাগ হয়ে যায়। আমি পড়ি লিয়া, হিমি আর সুহাইলার সাথে।

আমাদের রুমটা অনেক উপরে। রুমে  ঢুকেই আমার মনটা ভালো হয়ে যায়। আগেরটার চাইতে অনেক ভালো রুম। বাথরুমটাও বড় এবং সাদা ধবধবে। তবে বাথরুমের দরজা ঠিকমত আটকায় না, আর নো বদনা নো হোস পাইপ। তবে একটা বড়সড় মগ ছিলো। শুনলাম পার হেড নাকি ৬০ রুপি করে খরচ পড়েছে রুম ভাড়ায়। সবার আগে হিমি গোসলে ঢুকলো। বের হয়ে বললো গিজার কাজ করছে না। তারপর সুহাইলা ঢুকলো। ওর গোসল শেষ হলে আমি আর লিয়া রুম সার্ভিসে খবর দিলাম গরম পানির জন্য। একজন লোক এসে জানালো এটাতে বয়লার আছে যেটা রুম সার্ভিসে খবর পেয়ে উনারা অন করে দিয়েছেন। এখন আর গরম পানির কোন অসুবিধা হবে না। লিয়া গোসলে ঢুকে ‘উহ বাবা, পুড়ে গেলাম’ বলে চিৎকার করতে লাগলো। সবশেষে আমি গোসলে ঢুকি। গরম আর ঠান্ডা পানি মিশিয়ে সাবান শ্যাম্পু দিয়ে জম্পেশ একটা গোসল দেই। ভীষন আরাম লাগে আমার।

প্রায় বিকাল পাঁচটার দিকে আমরা লাঞ্চ খেতে যাই। রাস্তায় বের হওয়ার সাথে সাথেই সতর্কবার্তা শুনি দিল্লীতে ব্যাগট্যাগ খুব সাবধানে রাখতে হবে। আমি আমার হ্যান্ডব্যাগটা সামনে ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকি। হোটেলের কাছেই একটা দোকানে আমরা অনেকে একসাথে ঢুকে পড়ি। আমি আর রুবাইদা অর্ডার দেই সাউথ ইন্ডিয়ান থালি। ১১০ রুপির সেই থালিতে ছিলো আলুর ঝোল তরকারি, ছোলারতরকারি, সাম্বার ( টক পাতলা ডাল), ঘন ডাল, টক দই, ভাত, রুটি আর পাঁপড়। অনেকেই দম আলু, মটর পনির, চানা, মশলা দেওয়া ধোসা এই সব অর্ডার দিলো। প্রত্যেকটা খাবারেই প্রচুর মশলা ছিলো আর অনেক টেস্টি ছিলো।

খাওয়া দাওয়া শেষে আমি চট করে হোটেলে গিয়ে মোটা সোয়েটার নিয়ে আসি। সূর্য ডোবার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডা বাড়তে লাগে। দেখি সবাই দুইটা দলে ভাগ হয়ে ঘুরতে বের হচ্ছে। আমরা রাজীব চক যাবো বলে ঠিক করি। রাস্তায় দাঁড়ানো ট্রাফিককে জিজ্ঞেস করতেই উনি দেখিয়ে দেন ডিরেক্ট বাস। আমরা বাস থামতেই বাসে উঠার জন্য হাঁটা ধরি। কিন্তু পিছন থেকে ডাক আসে। ট্রাফিক আমাদের বলে যে আমাদের জন্য অটোতে করে যাওয়া ভালো হবে। ততক্ষণে মিম, অন্তরা আর তমা বাসে উঠে গেছে। আর এদিকে আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অটো ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু আমাদের কথা শুনে উনারা বেশি বেশি দাম হাঁকায়। এগিয়ে আসেন এক বয়স্ক মহিলা। উনি নিজে এক্টার পর একটা অটো ঠিক করে দেন আমাদের জন্য। উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা দলে দলে রওয়ানা দেই।

ঐশি, মায়িশা, আমি আর নোভা এক অটোতে উঠি। আমাকে নোভা আর মায়িশা পালা করে কোলে নেয়। অটোওয়ালা আমাদের পরিচয় জেনে অনেক্ষণ কথা বলে। জানতে চায় এত ভালো হিন্দি আমরা কোথায় শিখলাম। নোভা সব কৃতিত্ব স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোকে দিয়ে দেয়। ৬০ রুপি ভাড়া দিয়ে খানিক পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম রাজিব চক। বিল্ডিং গুলো আমাদের বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের মতন। সবগুলো বিল্ডিং বৃত্তাকারে সাজানো আর বৃত্তের কেন্দ্রে আছে বিশাল এক ইন্ডিয়ার পতাকা। চারপাশে সব দামি আর অভিজাত দোকান। দোকানের বাইরে শহরের উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা আড্ডা দিচ্ছে। আমি, নিশাত, রিন্তু, রুবাইদা একসাথে ঘুরলাম। নিশাত বাটা থেকে দুই জোড়া স্যান্ডেল কিনলো। ঝলমলে সব দোকানের চোখ ঝলসানো সব জিনিস দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে গেলাম। ফাস্ট ট্র্যাকের একটা নীল জিন্সের বেল্ট দেওয়া বড় ডায়ালের ঘড়ি আমার অনেক পছন্দ হলো। কিন্তু টাকা সাথে না থাকায় আমি কিনলাম না। পরে কোন এক সময় কিনে নিবো- এই চিন্তা করে ওখান থেকে বের হয়ে আসি। অনেকক্ষণ পর আমরা সবাই একসাথে জড়ো হলাম। এরপর গেলাম ‘ক্যাফে কফি ডে’ র উদ্দেশ্যে।

'ক্যাফে কফি ডে'তে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)
‘ক্যাফে কফি ডে’তে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

‘ক্যাফে কফি ডে’ ইন্ডিয়ার নামকরা কফি চেইনশপ। আমি আর রুবাইদা সেখানে ছোট্ট কাপে করে বেলজিয়ান চকো শট আর ম্যাংগো মেলডি খেলাম। দাম ৩০ রুপি করে। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা অনেক চিন্তাভাবনা করে কাছের মেট্রো স্টেশনে গেলাম। ৮ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে আগের মতই গাদাগাদি করে চড়ে বসলাম মেট্রোতে। কয়েক মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম আমাদের স্টেশনে। মেট্রো থেকে নেমে আমরা চল্লিশ জনের মতন মানুষ উচ্চস্বরে হাহা হিহি করতে করতে হাঁটতে থাকি। আমাদের হৈচৈয়ে বিশাল মেট্রো স্টেশনটা গম গম করে উঠে। আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমরা এভাবেই চেঁচামেচি করতে করতে বের হয়ে আসি স্টেশন থেকে।  এখান থেকেও পাহাড়গঞ্জ একটু দূরে। রাস্তার পাশে ইজি বাইক টাইপের কয়েকটা যান ঠিক করতে চাইলে তারা উলটাপালটা দাম চায়। সবশেষে আমরা হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। লাইন ধরে আমরা হাঁটতে থাকলাম।

রাত প্রায় দশটার সময় দিল্লীর রাস্তা ধরে এতগুলো ছেলেমেয়ের গল্প করতে করতে লাইন ধরে হেঁটে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। তাই অনেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখছিলো। রাতের দিল্লী অদ্ভূত রকমের। স্ট্রিট লাইটিং আর পাহাড়্গঞ্জের সাইনেজ দেখে কেমন জানি লাস ভেগাস শহরের মতন লাগে। এরই মধ্যে বৃষ্টি আর ইশতিয়াকের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। যাইহোক আমরা অবশেষে হোটেলে এসে পৌঁছলাম। অনেকেই রাতের খাবার খেতে গেলো। আমার পেট ভরা ছিলো। আমি আর কিছু খেলাম না। খাওয়ার পানি কিনে হোটেলে ফেরত চলে আসলাম। রুমে ঢুকতে পারলাম না কারণ রুমমেটরা কেউ আসে নাই।

গিয়ে বসলাম নিশাতদের রুমে। দেখি মজুমদার বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে আর রিন্তু নানা রকম নাচ গান করে ওর মন ঠিক করার চেষ্টা করছে। জানতে পারলাম রাত ১২টার সময় আমাদের মিটিং আছে প্রত্যেককে হাজির থাকতেই হবে। অনেকক্ষণ ওদের সাথে গল্প করলাম। তারপর রুমে ফিরে আসলাম। আবার রাত ১২টার সময় শান্তদের রুমে আমরা সবাই জড়ো হলাম।

একটা ডাবল বেডের রুমে আমরা ৪৬ জন মানুষ কেমন করে আঁটলাম সে এক ভারি রহস্য। কিন্তু তারপরেও আমরা ৪৬ জন মানুষ আর আমাদের ৪৬ জোড়া স্যান্ডেল নিয়ে দূর্দান্ত এক মিটিং করলাম। শুভ আর অবনী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কথা বললো। কল্কা মেইলে ঘটে যাওয়া ঝগড়াঝাটি, কেন আমরা একসাথে সিট পেলাম না, আর এই নিয়ে নানা গুজব – এই সব কিছু নিয়ে দৃঢ় বক্তব্য দিলো অবনী। একটা বাইরের দেশে এসে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত এই টাইপের কথা বার্তাও হলো। শুভ জানালো আজকে আমরা যখন ঘুরতে বের হয়েছি তখন কমিটির লোকজন আগামী ২১ দিনের জন্য একটা বাস ঠিক করতে যায়। ওরা ৪৫ সিটের একটা বাস পেয়েছে যেটার পিছনের ৫ জনের জায়গায় ৬ জন বসতে হবে। আগের বার রুবাইদা একা পুরা জার্নিতে কষ্ট করেছে। এইবার সবাইকে মিলে মিশে কষ্ট করতে হবে। ওর কথায় আমরা সবাই সমর্থন জানালাম। ও আরও ব্যাখ্যা দিলো, এতদিন আমরা সবাই আলাদা আলাদা ঘুরেছি, এখন থেকে আমরা বাসে করে ঘুরবো- আক্ষরিক অর্থে আসল ট্যুর শুরু হবে এখন থেকে। আমরা আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠি। তারপর জুবায়ের রাস্তাঘাটে সবার সাথে সহনশীল আচরন করার কথা বলে। কারণ থানা পুলিশ ঝামেলা হলে কমিটি কোন দায়িত্ব নিবে না জানিয়ে দেয়। আমরা তাতেও খুশিতে সমর্থন জানাই। কিছুক্ষণ পর আশেপাশে রুম থেকে কমপ্লেইন আসতে থাকে। আমরা দ্রুত আমাদের মিটিং শেষ করে যার যার রুমে চলে যাই।

রাতের বেলা সীমান্ত হিমিকে ফোন দিয়ে জানায় যাতে আমরা ভালো করে দরজা বন্ধ করে ঘুমাই। কারণ হোটেলে নাকি উলটা পালটা অদ্ভূত লোকজন আছে। আমরা সব রকম ব্যবস্থা এনশিওর করে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে যাই। রুমের জানালার পাশেই মনে হয় কবুতরের খোঁয়াড়, সেখান থেকে ফরফর করে কবুতরের শব্দ আসতে লাগলো।

The Mighty INDIA TOUR: কোলকাতা টু দিল্লী বাই ‘কলকা মেল’ (পর্ব ৫)

আমার পাশের চেয়ারে সম্ভবত লিয়া বসেছিলো। লিয়ার কম্বলটায় ভাগ বসিয়ে সারা রাত এপাশ ওপাশ করলাম। এক পর্যায়ে কে জানি বললো সামনে নিচে শুয়ে আছে এক মহিলা, তার আচরণ সন্দেহজনক। মহিলাকে নজরে রাখা দরকার। সবাই পালাক্রমে মহিলার উপর চোখ রাখতে লাগলো। অবনীকে দেখলাম চেয়ার ছেড়ে উঠে নিচে শাল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা অপরিচিত মহিলাদের মাঝে ঘুমিয়ে পড়তে। অবনীর এই স্বভাবটা ভালো, যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়তে পারে।

প্রচন্ড ঠান্ডায় আমরা জমে যাচ্ছিলাম। মোটা সোয়েটার, কানটুপি, কম্বল কিছুতেই শীত মানছিলো না। আমি লাগেজ খুলে ওভারকোট বের করে পড়ে নিলাম। সাড়ে পাঁচটা থেকেই সবাই আস্তে আস্তে উঠতে লাগলো। ফ্রেশ টেশ হয়ে আমরা সবকিছু গুছিয়ে রাখলাম। অবনীও ঘুম থেকে উঠলো। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম অবনী যাদের সাথে ঘুমিয়েছে তারা হিজড়া। তবে এখানকার হিজড়ারা মোটেও ভীতিকর কিছু নয়। তারাও ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে লাগলো।

৬টার দিকে আমরা আবার নিচে নেমে জন আহারে নাস্তা খেতে গেলাম। অর্ডার দিলাম ২৫ রুপির ভেজ কাটলেট আর বাটার পাউরুটি। ভেজ কাটলেটটা অদ্ভুত লাল রঙের, খেতে ভালো না। তাড়াতাড়ি করে খেয়ে আমরা উপরে উঠে লাগেজ নামাতে লাগলাম। একটা মাত্র লিফট। সবাই দৌড়াদৌড়ি করে নামতে লাগলো। সাড়ে ছয়টার সময় আমরা নেমে দৌড় দিলাম ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু কোন ট্রেন আসে নাই দেখে আমরা ইতস্তত দাঁড়িয়ে রইলাম।

এত মানুষের জটলা দেখে স্টেশনের কয়েকজন গার্ড টাইপের লোক এগিয়ে আসলো। শুভ তখন আমাদের টিকেট দেখালো। উনারা বললো ট্রেন অত্যন্ত কম সময়ের জন্য থামবে। বগি নম্বর দেখে এক্ষুনি আমাদের দৌড়ে প্ল্যাটফর্মের যার যার বগি নম্বর লিখা জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে থাকা দরকার। না হলে উঠার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিবে। শুনে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। জুবায়ের, শুভ চিৎকার করে আমাদের সিট নম্বর আর বগি নম্বর বলতে লাগলো। আমরা একেকজন একেক বগিতে পড়েছি। সবার চেহারা রক্তশূন্য হয়ে পড়লো। অনেকেই বগি নম্বর জেনে দৌড়াতে লাগলো। আমার বগি নম্বর এস থ্রি আর সিট নম্বর ৬৭। শুনে আমি পাগলের মত লাগেজ নিয়ে দৌড়াতে লাগলাম। এর মধ্যে ট্রেন চলে আসলো। পিঠে ব্যাকপ্যাক, কাঁধে হ্যান্ড ব্যাগ আর হাতে ট্রলি এই নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় দেখলাম বগি নম্বর এস ওয়ান, বগি নম্বর এস টু- কিন্তু তারপর বগি নম্বর এ ওয়ান! এরপর এগিয়ে দেখলাম বগি এ টু। মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো আমার। এখন আবার আমাকে এ বি সি ডি শুরু করে এস পর্যন্ত দৌড়াতে হবে? তার মানে আমি নিশ্চয়ই ট্রেন মিস করবো। আমার মাথায় কি ঘটে গেল আমি জানি না। আবার দৌড় শুরু করলাম। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ানোর এক পর্যায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আমার আশেপাশে পরিচিত কেউ নাই। কি করবো এখন? একে তো বগি খুঁজে পাচ্ছি না, তার উপর হাতে কোন টিকেট নাই। ট্রেনটাও যে কোন সময় ছেড়ে দিবে। কি হবে আমার?

হঠাৎ তানভীরকে দেখলাম ওর সুটকেসটা নিয়ে দৌড়াতে। পরিচিত একজনকে পেয়ে আমি আবার দৌড়াতে শুরু করলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় তানভীর ওর বগি পেয়ে গেলো। তারও কয়েকটা বগি পার হয়ে আমি আমার কাংখিত এস থ্রি লিখা বগি খুঁজে পেলাম। কোনমতে ট্রলিটা টেনে বগিতে উঠলাম। বেশি খুঁজতে হলো না, একটা খোপ পার হয়েই ৬৭ নম্বর সিট খুঁজে পেলাম। আমি তখনও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। এর মধ্যে নিলয়, উর্মি আর চিং হাপাতে হাপাতে লাগেজ টেনে টেনে আমার খোপের মধ্যে আসলো।

আমরা দ্রুত আমাদের লাগেজগুলা সিটের নিচে রেখে ভালো করে তালা মারতে লাগলাম। একটু পর আবিষ্কার করলাম আমরা চারজন ছাড়াও আরও চারজনের সিট আছে এই খোপের মধ্যে, তারা যেহেতু আমাদের কেউ না- অবশ্যই তারা ‘বিদেশি’ মানুষ। চারজন ‘বিদেশি’ মানুষের সাথে একই খোপে আগামী প্রায় দেড় দিন কাটাতে হবে ভাবতেই আমাদের মেজাজ বিগড়ে গেলো। উর্মি মারাত্মক টেনশনে পড়ে গেলো। ও এক্সট্রা প্রটেকশন স্বরূপ আরও শিকল তালা কিনে ওর লাগেজে জড়াতে লাগলো। আর আমাদের এক খোপ পাশেই ট্রেনের ক্লিনার টাইপের লোকদের বসার ব্যবস্থা। বাংলাদেশি শুনে ওনারা বারবার সাবধান করে দিতে লাগলো আর বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন চুরির কথা মনে করিয়ে দিতে লাগলো। ওনাদের সাবধানতা অমান্য করার ফলে কেমন করে যাত্রীদের মোবাইল আর লাগেজ চুরি গেছে সেই সব কাহিনী বারবার বলতে লাগলো। সেই সব শুনে উর্মির ভয় আরও চৌদ্দগুন বেড়ে গেলো।

ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে টের পাচ্ছি মায়িশাদের কামরাতে কোন একটা গন্ডোগোল লেগেছে। কমিটির কয়েকজন অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করছে। খানিক পরেই মায়িশা আর ঐশি ওদের লাগেজ টানতে টানতে রাগে গজগজ করতে করতে জাফরের সাথে আমাদের কামরা ক্রস করলো। ওদের কামরার সহযাত্রী কি সব জানি ঝামেলা করেছে তাই ওরা জাফর আর রাফাতের সাথে সিট বদল করছে। সব দেখে উর্মির প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। তখন চিং আর নিলয় একের পর এক সান্তনা দিতে লাগলো। কয়েক মিনিট পর আমরা চিন্তা করলাম যে এখনো যেহেতু কোন বাইরের লোক আসে নাই তাহলে দেখাই যাক না কি হয়। যখন কেউ আসবে তখন দেখা যাবে। তার আগ পর্যন্ত আমরা চারজন মিলে আটটা সিট ব্যাগ রেখে দখল করে রাখলাম। তারপর আমরা ঘুরতে বের হলাম।

আমাদের পাশের খোপেই রিজভী, আফরা আর ইশ্তিয়াক ছিলো। আমরা হেঁটে হেঁটে এক কামরা থেকে বাম দিকে অন্য কামরায় যাই। বেচারা হিমির জ্বর। ওকে দেখলাম ওর সহযাত্রী মহিলার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকতে। একই খোপে রুবাইদাও ছিলো। ওর সাথে খানিক্ষণ গল্প করলাম। তারপর আরও সামনে গেলাম। সবশেষে নিশাত, অদিতিসহ ওরা ছয়টা মেয়ে একসাথে বসে ছিলো। এরপর একটা দলের সাথেই শুধু দেখা হওয়া বাকি ছিলো। সেটা প্রায় ২২ টা বগি পরে জেরিন, ফাহাদের দল। আলসেমির জন্য সেটাতে আর গেলাম না। আমাদের কামরার ডান দিকে অন্য কামরায় জাফর, রাফাত, মৌলি আর মজুমদারকে বসে থাকতে দেখলাম। ছাড়া ছাড়া ভাবে সিট পড়ায় সব খানে সবার মন কমবেশি খারাপ দেখেছিলাম। কিন্তু এই বগিতে এক্সট্রিম থমথমে অবস্থা। কথা বলে জানলাম, সহযাত্রী আংকেলের সাথে মায়িশা আর ঐশির মনোমালিন্য হওয়ায় কেউই আর স্বাভাবিক হতে পারছে না।

সবার সাথে দেখা করে আমরা বুঝলাম যে আসলে আমরা সব থেকে ভালো অবস্থায় আছি। আমাদের এখনও পর্যন্ত কোন সহযাত্রী নাই। আমাদের কামরা বেশ আলো ঝলমলে এবং খোলামেলা। আর পাশেই ক্লিনাররা থাকায় একটু পর পর অনারা ঝাড়ু দিচ্ছিলো আর এয়ার ফ্রেশ্নার দিচ্ছিলো। আমাদের কাছাকাছি বাথরুমটাও পরিষ্কার- কোন গন্ধ নাই তবে বদনাও নাই। পানির কলটা আরও অদ্ভূত, টিপকল বলা চলে ঐটাকে। সব কিছু চিন্তা করে আমরা পজিটিভ মনোভাব নিয়ে বসি। যার যার মালপত্র সুন্দর করে গুছিয়ে খোশমেজাজে বসি।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদ উঠতে লাগলো। একটু পর পর বিভিন্ন ফেরিওয়ালা আমাদের পার হয়ে যেতে লাগলো। বাদাম, চিপস, ডালমুট, ছোলা ভুনা, সিংগারা, কালোজাম, ড্রিংকস, তালা চাবি, খেলনা, চা, নারিকেল কুচি আরও হাজারো রকমের জিনিস। আবার ট্রেনের নিজস্ব চা, চাওমিন, রাতের খাবার আর দুপুরের খাবার ছিলো। আমার বেশ ঘুম পাচ্ছিলো। আমি হ্যান্ড ব্যাগটা মাথার কাছে রেখে কম্বল জড়িয়ে ছোটখাটো একটা ঘুম দিলাম।

ঘুম থেকে উঠে আমি আর সুমাইয়া শেয়ারে লাঞ্চ খেলাম ভাত, সবজি আর ডিম। দাম পড়লো ১১০ রুপি। খাওয়া শেষে একটা লুডু কিনে আমরা চারজন খেলা শুরু করলাম। এর মধ্যে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি আর মায়িশা একটা বোতল কেটে ‘বদনা’ বানালাম। অনেকেই ঘুরতে আসলো আমাদের খোপের মধ্যে। আমাদের ‘ফার্স্ট ক্লাস’ আরাম দেখে সবাই ‘হিংসা’ করতে লাগলো। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেলো আমাদের পরিষ্কার বাথরুম আর ‘বদনা’র কথা। দূর দূরান্ত বগি থেকে লোকজন আমাদের খোপে আসতে লাগলো ‘বদনা’ নিয়ে পরিষ্কার বাথরুমে যাওয়ার জন্য। চারটা খালি সিট থাকায় অনেকেই বসে গল্পগুজব করে। এক পর্যায়ে আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখলে বাংলাদেশের মতই দেখা যায়। ফসলের মাঠ আর মাঠ, কিন্তু কোন ঘর বাড়ি নাই। তবে বাংলাদেশ অনেক বেশি কালারফুল, দেখতে বিরক্ত লাগে না। ট্রেন একেকটা স্টেশনে থামে আর তিন থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে দেয়। সবাই এর মধ্যেই ঝাঁপাঝাঁপি করে ওঠা নামা করে।

আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামতে থাকে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে শীত। আমরা অনেক গল্প করতে থাকি। এক সময় আবার অন্যদের সাথে দেখা করার জন্য ঘুরতে বের হই। অবাক হয়ে আবিষ্কার করি রুবাইদার পাশে বসে আছেন একজন সাধু বাবা। জীবনে কোনদিন সামনা সামনি সাধু দেখেছি বলে মনে হয় না। সাধু বাবার পরনে গেরুয়া বসন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে লাল সাদা ডোরাকাটা দেওয়া। বিস্তর চুল দাড়ির মধ্যে উনার হাসি হাসি মুখটা দেখা যাচ্ছে। ফাহাদ রুবাইদার উপরের সিটে বসে মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে ‘ রুবাইদার পাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ কথাটা লিখে রেখেছে। আর যেই সামনে দিয়ে যাচ্ছে তাকেই দেখাচ্ছে স্ক্রিনটা। সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে লিখাটা দেখে। আর আমাদের হাসি দেখে সাধু বাবাও বেশ মজা পাচ্ছেন। উনি হিন্দিতে একবার বলেই ফেললেন এই কথা। ঘুরতে ঘুরতে বুঝলাম সবার মন মেজাজ বেশ ভালো আর আমাদের ‘বদনা’ সুপার হিট। এর মধ্যে জুবায়েরের সাথে খানিক্ষণ কথা বললাম ট্যুর শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। আমি সব খুলে বললাম কি কি ভুল আমাদের হয়েছে, কি কি বিষয় আমাদের ক্লিয়ার করতে হবে, আর সবাইকে নিয়ে ট্যুরের উপর ওভারঅল একটা ব্রিফিংয়ের কথা বললাম। তারপর যখন নিজের কামরায় ফেরত যেতে থাকি তখন দেখি সাধু বাবা চলে গেছেন। রুবাইদা একাই বসে আছে। আসার সময় সামনে এক মহিলাকে দেখলাম দু হাতে দুই ভারি ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে। হিন্দিতে উনি বললেন উনার সিট এস ফোর এ। আমিও বললাম আমিও সেইদিকেই যাচ্ছি। উনি অনুরোধ করলেন উনার ব্যাগটা টেনে দেওয়ার জন্য। আমি টেনে দিলাম। এক পর্যায়ে উনাকে এস ফোরে নামিয়ে দিয়ে আমি গেলাম মজুমদারদের কাছে। জাফর এক বুদবুদ বানানোর খেলনা পিস্তল কিনে বাতাসে খালি বুদবুদ ওড়াচ্ছে। মৌলি একটা কাপে করে কি যেন খাচ্ছে, জিজ্ঞেস করতেই বললো ‘কাপল ড্যান্স”। জিনিসটা আসলে কাপ নুডুলস কিন্তু লোকগুলোর উচ্চারণ শুনে ওরা মনে করে কাপল ড্যান্স। কৌতুহলী হয়ে এক কাপ কিনতেই বোঝা যায় আসল রহস্য।

াফেদ
প্রচন্ড শীতের সাথে লড়াইরত দুই দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় সারাহ তাবাসসুম)

আমি যখন আবার ফিরে আসি তখন দেখি আমাদের খোপের সব চেয়ে উপরের দুইটা সিটে দুইজন লোক শুয়ে আছে আর নিচে একটু আগে পরিচয় হওয়া মহিলাটাকে টিটি টিকেট ইস্যু করে দিচ্ছেন আমাদের এখানে থাকার জন্য। মহিলার টিকেট নিয়ে কি যেন ঝামেলা হয়েছে। যাই হোক মহিলাকে আমরা নিচের একটা সিট ছেড়ে দেই। উনি ব্যাগ খুলে একটা ভর্তা হয়ে যাওয়া সুন্দর কেক বের করে আফসোস করতে থাকেন যে কেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের অবশ্য খাওয়ার জন্য সাধেন একবার। বলেন যে, ওনাদের কেকের দোকান আছে। স্বামী দিল্লী চাকরি করেন – তার জন্যই কেক নিয়ে যাচ্ছেন।

ডিনার করি আমি আর তমা শেয়ারে ১০০ রুপি দিয়ে। আইটেম ছিলো রুটি, চিজের টুকরা দেওয়া সবজি আর ডাল। সবাই ডিনার খেয়েদেয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করি। আমি নিচে, উর্মি আর চিং মাঝের দুই সিটে দুইজন। আর আমাদের সাথে ৯০ ডিগ্রী আঙ্গেলে নিচে নিলয়, ওর উপরের সিটটা একবার ফাঁকা থাকে একবার কেউ এসে বসে। নিলয় আমাদের সব গুলো ব্যাগ প্যাক নিয়ে ওর সিটে গুটিশুটি মেরে বসে থাকলো। আমরা অনেক বললাম ব্যাগগুলো নামিয়ে দিতে কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হলো না। বারবার বলতে লাগলো, তোরা ঘুমা, টেনশন করিস না, আমি জেগে আছি- বলে শাল মুড়ি দিয়ে বসে থাকলো।

আর আমি জানালার ফাঁক দিয়ে ঢোকা হিহি ঠান্ডা বাতাস বন্ধ করার জন্য মাস্কিং টেপ লাগালাম। আমার পাশের মহিলা বড়বড় চোখ করে সেটা দেখলো। তারপর শোয়ার সাথে সাথেই ঘুম।

 

The Mighty INDIA CALLING: সারাদিন ঘোরাঘুরি আর দিন শেষে হাওড়াময় রাত (পর্ব ৪)

ঘুম থেকে ঊঠলাম সকাল ৭ টার দিকে। রুবাইদা, মজুমদার আর মৌলি ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিচে ছেলেদের রুমে জমা দিয়ে বের হয়ে পড়লো। আমি একা একা ব্যাগ গুছালাম। সারা রুম তন্নতন্ন করে চেক করলাম, যে কিছু ফেলে যাচ্ছি কিনা আমরা। এক পর্যায়ে লাগেজ নিচের রুমে জমা দিয়ে রুমে এসে বসে থাকলাম। এর মধ্যে নিশাতরা ভুল করে আমাকে ফেলেই বের হয়ে পড়ে। আবার ফোন করে যোগাযোগ করে নিউ মার্কেটের সামনে ওদের সাথে যোগ দেই।

তারপর নিশাত আলাদা হয়ে যায়। আমরা অলিগলি দিয়ে বেশ ভিতরে ঢুকে পড়ি। আবার নিশাতকে খোঁজার জন্য আমি আর রিন্তু এগিয়ে যাই। এরপর দেখা যায় নিশাত সবাইকে খুঁজে পেয়েছে কিন্তু আমি আর রিন্তুই হারিয়ে গেছি। আবার খোঁজাখুঁজি করে সবাই একত্র হলাম। এরপর রওয়ানা দেই মার্কুইস স্ট্রিটে। মানি এক্সচেঞ্জে টাকা ভাঙ্গিয়ে রুপি করে নিলাম। আবার গেলাম আরাফাত হোটেলে। এবার অর্ডার দিলাম ৫ রুপির পুরি আর ৩৫ রুপির ডাল-খাসি। আমার খরচ পড়লো ২২ রুপি। পেট ভরে খেয়েদেয়ে আমরা বের হলাম- এবারের গন্তব্য সায়েন্স সিটি।

রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞেস করে বেশ কিছু দূর হেঁটে তিনটা মোড় পার হয়ে আমরা ২৪/এ বাসের জন্য দাঁড়ালাম। পথে আমি ২০ রুপি দিয়ে দুইটা ডাস ডাসা পেয়ারা কিনে নিলাম। পরে কাঠের মিনিবাস টাইপের বাসে না উঠে একটা বড় বাসে উঠে পড়ি। বেশ ফাঁকা বাস। আমরা হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসি। দূরত্ব ঘন্টাখানেকের হলেও ভাড়া ৯ রুপি। আমি জানালা দিয়ে দুপাশের কলকাতা শহর দেখতে থাকি। ভারি অদ্ভুত এই শহর, ভারি অদ্ভুত।

আমাদের সাইন্স সিটির গেটের উলটা পাশে নামিয়ে দেয়। আমরা আন্ডারপাস দিয়ে রাস্তা ক্রস করে আসি। আন্ডারপাসটায় আমরা ছাড়া আর কেউ ছিলো না। আমরা হাউকাউ করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলি। সায়েন্স সিটির গেটের সামনে বিশাল এক ডাইনোসোরের মুর্তি। আর একটু পাশে বিক্রি হচ্ছিলো স্ট্রিট ফুড। তমা চা খেলো। কাপের সাইজ এত ছোট মনে হলো যেন ওষুধ খাওয়ার কাপ। একটু পরেই রুবাইদা, মজুমদার ওদের সাথে দেখা হলো। ওরা বের হয়ে যাচ্ছে আর আমরা ঢুকছি। রুবাইদার পরামর্শ মত আমরা ৪০ রুপি দিয়ে এন্ট্রি টিকেট কাটলাম। আর নিশাত কাটলো ৭০ রুপি দিয়ে কেবল কারের টিকেট। এটা তেমন কিছুই না। খালি গেটটা পার করে দেয় কেবল কার দিয়ে।

ভেতরটা বেশ বড়। অনেকগুলো আলাদা বিল্ডিং। মেইন গ্যালারীটা পুরাই র‍্যাম্প করে স্পাইরাল হয়ে উপরে উঠে গেছে। আমরা দুই ভাগ হয়ে গ্যালারি দেখলাম। ছোট্ট কালে পড়া বিজ্ঞান বইয়ের সব উদাহরণ চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ভালোই লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে টায়ার্ড হয়ে আমি, অবনী আর তমা গ্যালারি ছেড়ে বের হলাম প্রায় পৌনে চারটার দিকে। আমাদের চারটার মধ্যে হোটেল থেকে হাওড়া স্টেশনে রওয়ানা হওয়ার কথা। দেরি হয়ে গেছে দেখে আমরা তাড়াতাড়ি একটা বাস ধরলাম নিউমার্কেট পর্যন্ত। ভাড়া একই নিলো কিন্তু উঠার সময় ট্রাফিক পুলিশ বলে দিয়ে ছিলো পকেটমার থেকে সাবধান থাকতে। আমরা কোনমতে বাস থেকে নেমে টানা রিক্সায় চড়ে সাড়ে চারটার দিকে হোটেলে পৌঁছলাম। নিচে দেখি একটা একটা করে ট্যাক্সি ক্যাবে করে মানুষজন উঠে রওয়ানা দিচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি করে নিচের রুম থেকে নিজের লাগেজ বের করে শান্ত, লিয়া, সৃষ্টির সাথে এক ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। ট্যাক্সি ভাড়া মোট ১৫০ রুপি।

আগে থেকেই কমিটি বলে দিয়েছিলো পুরানো স্টেশনে নামতে। আমরা তাই নামলাম। ট্যাক্সি থামতেই কুলির দল এসে হাজির হলো। তারা বললো দিল্লীর ট্রেন কল্কা মেইল তো নতুন স্টেশনে। আমরা তাদেরকে পাত্তা না দিয়ে নিজেরাই লাগেজ টেনে পুরানো স্টেশনে ঢুকলাম। ঢুকে জানতে পারলাম আমাদের ট্রেন আসলেই নতুন স্টেশনে আসবে। অগত্যা বিশাল রাস্তা আমাদের পাড়ি দিতে হলো এই সব ব্যাগপত্র নিয়ে। অবশেষে হাতের আঙ্গুলে লাল দাগ ফেলে আমরা নতুন স্টেশনে পৌঁছলাম। বি-শা-ল স্টেশন। অ-নে-ক মানুষ। অবশেষে খোঁজাখুঁজি করে জাফরকে পেলাম। তখনই জানলাম ঘটনাটা।

সন্ধ্যা ৭টার কল্কা মেইল ডিলে করেছে। কত সময়ের জন্য তা কেউ বলতে পারলো না। তবে মিনিমাম ১০-১১ ঘন্টা তো হবেই। বাজ পড়লো সবার মাথায়। এর মানে এই খোলা প্ল্যাটফর্মে বসে রাত পার করতে হবে? এই শীতের মধ্যে? Oh no!

তবে আমাদের মানুষেরা থাকলে কষ্ট করে হলেও কোন মতে থাকা যাবে, প্ল্যাটফর্ম দেখতে দেখতে আমি মনে মনে ভাবলাম। এর মধ্যে জাফর এসে জানালো উপরে মেয়েদের ওয়েটিং রুম আছে। আমরা সেখানেই থাকবো। প্ল্যাটফর্মে থাকতে হবে না আমি তাতেই খুশি। ব্যাগ টানতে টানতে লিফটে উঠলাম। লিফটের ভেতর মায়িশা আর নোভাকে রাগে ফেটে পড়তে দেখলাম। কমিটির কর্মকান্ড নিয়ে নাখোশ ওরা। ওদের দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম আমি। মনে হচ্ছিলো একটা না একটা গন্ডোগোল লাগবেই। ওয়েটিং রুমে ঢুকে দেখি রুবাইদা সবচেয়ে পিছনের রোতে মালপত্র গুছিয়ে, শিকল তালা মেরে ঘুমানোর পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে বসে আছে। আমাকে দেখে বল্লো, ‘নুযহাত, তোমার জন্য জায়গা রেখেছি। পিছনে দেওয়ালের সাথে মাথা ঠেস দিয়ে ঘুমানো যাবে। আর নিচে ব্যাগের উপর পা রাখলে আরাম হবে। আমরা চুপচাপ এখানে বসে থাকি। পরিস্থিতি ভালো না’। বুঝলাম আমার মত রুবাইদাও উত্তপ্ত পরিস্থিতির আঁচ পেয়েছে।

আস্তে আস্তে আমাদের মানুষজন সবাই এক এক করে আসতে লাগলো। সবাইরই মন কম বেশি খারাপ। এই রকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলো না কেউই। আমি সবার সাথে কথা বলে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করলাম। এদিক সেদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম আগামী ১২ ঘন্টা আমাকে কোথায় কাটাতে হবে। মোটমাট দুইটা ওয়েটিং রুম। ছেলেদেরটা বাইরে আর মেয়েদেরটা ভিতরে। মেয়েদেরটাতে চমৎকার টয়লেট আছে। ২ রুপি, ৩ রুপি, ৫ রুপি দিয়ে ঢুকতে হয়। ভেতরে গোসলখানাও আছে। আশেপাশের মানুষদের দেখলাম। সবাই মনে হলো ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত যে ট্রেন লেট হবে, আর এক দুই রাত ওয়েটিং রুমে থাকতে হবে। এক মহিলাকে তো গোসল করে শাড়ি বদলে চুল মুছতে দেখলাম। এক ফ্যামিলিকে দেখলাম সুন্দরমত ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে করে পরোটা, তরকারি খেতে। দেখে মনে হল যেন পিকনিক করতে এসেছে। আর বারবার মাইকে একটা অ্যানাউন্সমেন্ট বাজতে লাগলো। কি যে বলে আমরা কিছুই বুঝি না। বিরক্তিকর এই অ্যানাউন্সমেন্ট বাজতেই লাগলো। চারপাশের সবাইকে দেখে মনে হল আমরা ছাড়া কারও কোন টেনশন নেই। ১০-১২ ঘন্টা ট্রেন লেট যেন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

এক সময় আমাদের সবাই চলে আসলো। ছেলেরা ওদের মালপত্র সব মেয়েদের ওয়েটিং রুমের একটা শেলফের মধ্যে স্তুপ করে রেখে শিকল দিয়ে ভালোমত জড়িয়ে তালা মেরে দিলো। বেচারা কমিটি মেম্বারদের জন্য আমার খারাপ লাগলো। তবে বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে বলে কেউ কারও উপর চড়াও হলো না। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যুদ্ধ যুদ্ধভাবটা অনেকটাই কমে গেছে।

র‍্যাকের মধ্যে লাগেজ স্তুপ করে লাগেজ বাঁধাছাদা চলছে

সবে মোটে সন্ধ্যা পার হয়েছে। রুবাইদাকে দেখলাম চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে দেওয়ালে মাথা ঠেস দিয়ে ঘুম দিতে। আমারও ক্লান্ত লাগছিলো। খানিক্ষন চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিলাম। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। কিছু খেয়ে নেওয়া উচিৎ- মনে মনে ভাবলাম।

রাতে খাওয়ার জন্য নিচে নামলাম। ইতোমধ্যে অনেকে খেয়ে এসে রিপোর্ট দিয়ে গেছে। ওদের পরামর্শ মত খেতে ঢুকলাম ‘জন আহার’ নামক রেস্টুরেন্টে। আমি নিলাম ৩৫ রুপির ভেজ থালি। এই থালিতে ছিলো ভাত, পাতলা ডাল, আলুর ঝোল তরকারি, ফ্রি আচার আর লাল রঙের কি একটা সবজি জাতীয় জিনিস যেটা খেতে খুবই বাজে। খাওয়াটা অসম্ভব ঝাল ছিলো। আমার বেশ কষ্ট হলো। অনেকেই নিলো ৩৬ রুপির ছোলা ভাটুরা, ৩৫ রুপির ভেজ চাওমিন। চাওমিনটাই সবচেয়ে মজা ছিলো। অবাক হয়ে গেলাম ডেজার্টের দাম দেখে। মাত্র ১৪ রুপিতে পেস্ট্রি পাওয়া যায় এখানে। আমরা একসাথে বসে গল্পগুজব করে খেতে থাকি। খাওয়া শেষে আমি পেয়ারা ধুয়ে খাই। তারপর অন্য সবার সাথে স্টেশন ঘুরতে বের হই।

আমি এত বড় রেল স্টেশন আগে দেখি নাই। অনেক অনেক প্ল্যাটফর্ম। অনেক মানুষ চারপাশে। একপাশে সারি বেঁধে দোকান। রসগোল্লা, বাদাম, ডাল, চানাচুর, চিপস কি নাই সেখানে! আমাদের অনেকেই বাতাস দিয়ে ফুলানো বালিশ কিনলো। আমরা এটা সেটা দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। তারপর আবার ফেরত আসলাম ওয়েটিং রুমে।

কিছুক্ষন পর আবিষ্কার হলো, তমার পার্স চুরি হয়ে গিয়েছে। আমরা যখন দোকানপাট দেখছিলাম তখনই কেউ ওর ব্যাগ খুলে মেরে দিয়েছে পার্সটা। পার্সে এক হাজারের মত রুপি ছিলো, দেশের সিম কার্ডটা ছিলো, লাগেজের চাবি ছিলো আর ছিলো শিকলের চাবি। শিকলের চাবিটা হারিয়েছে দেখে তমা চিন্তিত হয়ে পড়লো। ওর লাগেজ তো শিকল দিয়ে বাঁধা আছে তাও আবার অন্যদের লাগেজের সাথে। শিকল খুলতে না পারলে কেমন করে হবে?

আমি খেয়েদেয়ে দাঁত মাজতে গেলাম। মেয়েদের বাথরুমে ঢুকতে গেলেই পয়সা দিতে হয়। দাঁত মাজার জন্য পয়সা দিতে ইচ্ছা হলো না। আমি গেলাম একটা খোলা বারান্দা টাইপ জায়গায়। সেখানে বেসিন আছে। আমি হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে দাঁত মাজতে লাগলাম। কনকনে শীত, উপরে খোলা আকাশ, নিচে ঝলমলে হাওড়া স্টেশন আর কাছেই রঙ্গিন হাওড়া ব্রিজ- এরকম জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি দাঁত মাজবো, জীবনে কোনদিন কল্পনাও করি নাই। দাঁত মাজতে মাজতেই দেখতে লাগলাম রাতের কোলকাতা শহর আর হাওড়া ব্রিজের রংচঙ্গে লাইট। প্রচন্ড ঠান্ডা পানি দিয়ে কুলি করে হাত মুখ সব অবশ করে আমি ফেরত আসলাম।

বেসিন ওয়ালা বারান্দা থেকে রাতের হাওড়া
বেসিন ওয়ালা বারান্দা থেকে রাতের হাওড়া

সত্যি বলতে কি আমার বেশ ভালোই লাগছিলো। এই রকম একটা অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনও হয় নাই। ওয়েটিং রুমটাকে বাসাবাড়ি বানিয়ে বসে থাকাটা চমৎকার লাগছিলো। আমরা গল্পগুজব করতে লাগলাম আর হাহা হিহি করে ফেটে পড়তে লাগলাম। অন্যরা এর মধ্যে শাল কম্বল মুড়ি দিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করলো। এক পর্যায়ে আমাদেরও কথাবার্তা কমতে লাগলো। সবাই নেক পিলোতে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করতে শুরু করলো। আমিও চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম আসলো না। মাঝে মাঝে খুট খাট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম- তমার ব্যর্থ প্রচেষ্টা শিকল আর তালা ভাঙ্গার। আর কানের কাছে জোরে জোরে বাজতেই লাগলো সেই অসহ্যকর অ্যানাউন্সমেন্ট………

The Mighty INDIA CALLING: যত কান্ড কোলকাতাতে (পর্ব ৩)

ঘুমের ঘোরেই টের পেলাম মজুমদার, মৌলি, রুবাইদা রেডি হচ্ছে বের হওয়ার জন্য। ওরা বের হওয়ার সময় আমাকে ডেকে দিলো। আমি কোনমতে টলতে টলতে উঠে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। তারপর বিছানায় উঠে আবার ঘুম।

সাড়ে নয়টার দিকে দরজায় নক পড়লো, কোনমতে ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে?’ টের পেলাম নিশাত আর তমা। ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দিলাম। ওরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘কি রে? বের হবি না? তোর রুমের লোকজন সব কই?’ আমি চোখ ডলতে ডলতে বললাম যে ওরা চলে গেছে, আমি ঘুমাচ্ছিলাম। ওরা বলল, ‘তুই কি একা থাকবি নাকি? পনের মিনিটের মধ্যে রেডি হ। আমরা বের হবো।’

ওরা চলে গেলে আমি চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘুম তাড়িয়ে ঝটপট রেডি হয়ে গেলাম। ঠিকঠিক পনের বিশ মিনিট পর আমরা বের হয়ে পড়লাম। ঢুকলাম আরাফাত হোটেলে। আমি, নিশাত, তমা, রিন্তু, পৃথ্বী পাঁচজনে মিলে অর্ডার দিলাম নান রুটি আর ডাল দিয়ে খাসী মাংস। হোটেলটা মুসলিম। সুতরাং আমরা তৃপ্তি করে খেলাম। আমার বিল আসলো ৩০ রুপি।

রফ
কোলকাতার পথেঘাটে (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

এখান থেকে বের হয়ে ট্রাম লাইন ধরে এগিয়ে একটা চায়ের দোকানে থেমে ওরা মাটির ভাঁড়ে করে চা খেলো। চা খেতে খেতে আমরা দোকানের মানুষগুলোর সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে আমাদের বেশ কদর করলো। ওনারা আমাদের সাজেশন দিলো হেঁটে হেঁটে কলকাতা শহর ঘোরার জন্য। হাঁটার জন্য নাকি কলকাতা খুব চমৎকার। ট্যাক্সি বা রিক্সা ভাড়া করতে গেলেই নাকি গলা কেটে দিবে। ইউনিফর্ম ছাড়া কোন মানুষের কাছে কোন কিছু জিজ্ঞেস না করতে বললো। আরও বললো, ভিক্টোরিয়া, ভারত মিউজিয়াম এগুলো নাকি খুবই কাছে।

উনাদের কাছ থেকে উপদেশ পেয়ে আমরা হাঁটা ধরলাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে পার্ক স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে লাগলাম। কি চমৎকার নিরিবিলি রাস্তা, পুরানো দেয়াল, পুরানো আমলের বাড়ি, নতুন ডিজাইনের বাড়ি, চওড়া ফুটপাথ। হাঁটতে হাঁটতে আমরা মেইন রোডে উঠে পড়লাম। সেখানে বড় একটা ফ্লাই ওভার। আমরা তার নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। রাস্তার ঐ পাশে দেখা যাচ্ছে ডগ শো টাইপের কিছু একটা হচ্ছে। ঠিক হলো প্রথমে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, তারপর দরকার হলে ডগ শো। আবার রাস্তা ক্রস করে আগের পাশে এসে হাঁটা ধরলাম। ফুটপাতে কি চমৎকার সব জিনিসপত্র! লেবুর শরবত অর্থাৎ নিম্বু পানি, টি শার্ট, বাচ্চাদের জামা, জুয়েলারি, ক্যালেন্ডার, পোস্টার, পুরানো কয়েন, শো পিস আরও কত কি! নিশাত আর তমা দুজনে দুটো পিতলের বালা কিনলো। একটা ৬০ অন্যটা ৪০ রুপি দিয়ে। সেইটা পড়েই ওরা হাঁটতে লাগলো। আমরা জাদুঘরে পৌছে গেলাম। রিন্তু গেলো টিকেট কাটতে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে বললো লোকটা আমাদের আইডি দেখাতে বলেছে অথবা বিদেশি টিকেট কাটতে বলেছে। হিজাব পড়া রিন্তুকে সে কলকাতার মানুষ বলে বিশ্বাস করে নাই। সাধারণ টিকেট ২০ রুপি আর বিদেশি টিকেট ২০০-৩০০ রুপির মত। এত টাকা দিয়ে বিদেশি টিকেট কাটার কোন মানেই হয় না। ইন্ডিয়ার প্রথম টিকেট কাটতে গিয়েই ধরা খেয়ে আমরা বেশ হতাশ হলাম।

মিউজিয়ামে ঢুকতে না পারি তো কি হয়েছে? ডগ শো তো আছে। আবার রাস্তা পার হয়ে ডগ শোতে গেলাম। এবার পৃথ্বী ১০ রুপির টিকেট কেটে দিলো। ভেতরে ঢুকলাম। খোলা আকাশের নিচে নানা রকমের কুকুর নিয়ে বড়লোক মানুষজন এসেছে। হাউন্ড, অ্যালসেশীয়ান, ল্যাব্রাডর, বুল ডগ, পিকনিজ কি নেই এখানে। ইয়া বিশাল দৈত্যের সমান কুকুর থেকে শুরু করে ছোট্ট নিরিহ কুইকুই করছে এমন কুকুরও আছে। একটা কুকুর দেখলাম একদম মেরু অঞ্চলের নেকড়ে বাঘের মতন। মালিকরা তাদের কুকুরগুলোকে সাজগোজ করাচ্ছে। দাঁত মাজিয়ে দিচ্ছে, ক্রিম লাগাচ্ছে, স্প্রে দিচ্ছে- কুকুরগুলো আরাম করে সে সব উপভোগ করছে। কুকুর ছাড়াও আছে কুকুরের জন্য দোকান। কুকুরের খাবার, কসমেটিক্স, খেলনা, ঘরবাড়ি, বিছানাপত্র, ওষুধপাতি – এই সব জিনিস্পাতি নিয়ে একেকটা স্টল বসেছে। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কুকুরের সাথে পোজ মেরে ছবি তুললাম। তারপর টায়ার্ড হয়ে বিশ্রাম নিতে বসলাম।

আমি এক ফাঁকে বাথরুমটা দেখে আসতে চাইলাম। সবাই বললো আগে তুই যা তারপর আমরা যাবো। খুঁজে খুঁজে লেডিস বাথরুমটা বের করলাম। শামিয়ানার ভেতর কাপড়ের পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। বাথরুম দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। খোলা আকাশের নিচে একটা কাপড়ের পার্টিশানের দুই পাশে মাটির উপর স্রেফ আলগা দুইটা হাই কমোড বসানো। কমোডের জিনিসগুলো যাবার কোন যায়গা নাই। কিন্তু সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হলো না। এর মাঝেই বড়লোক মানুষজন সব বাথরুম ব্যবহার করছে। পানির কোন ব্যবস্থা নাই, একটা দরজা পর্যন্ত নাই, দুর্গন্ধে আমার বমি আসার উপক্রম হলো। আমি দৌড়ে বের হয়ে আসলাম। ওদের সবাইকে সাবধান করে দিলাম, ভুলেও যেন বাথরুমের দিকে না যায়। শুনে ওরাও ভয় পেলো, সব জায়গায় এরকম বাথরুম থাকলে তো সমস্যা। আমরা এখান থেকে বের হওয়ার জন্য উঠলাম। গেটে এক অসম্ভব কিউট বাচ্চা মেয়েকে তার মায়ের কোলে লেপ্টে থাকতে দেখলাম। আমরা সবাই সেই বাচ্চা, তার পিচ্চি ভাই আর মায়ের সাথে ছবি তুললাম। বের হয়ে দারোয়ানের সাথে কথা বলে আমরা সামনে যেন কি একটা আছে শুনে হাঁটতে লাগলাম।

কিছুদূর আগানোর পরেই আমরা রাস্তার মাঝে একটা বিশাল পার্ক টাইপের জায়গায় গাছ দিয়ে বানানো ময়ুর দেখলাম। ভেতরে ঢুকতে হলে অনেক দূর হাঁটতে হবে দেখে আর ভিতরে ঢুকলাম না। বাইরে দিয়েই দেখেই আবার হাঁটতে লাগলাম। কোলকাতার এই জায়গাটা অনেকটা আমাদের বনানী এলাকার মতন। রাস্তার একপাশে উঁচু উঁচু সব কমার্শিয়াল বিল্ডিং, তবে দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে অনেক গ্যাপ। রাস্তার অন্য পাশে পার্ক, গার্ডেন, ময়দান টাইপের জায়গা। তার সাথে চওড়া ফুটপাথ, চওড়া বুলেভার্ড টাইপের জায়গা। আবার ফুটপাথের সাথে পার্কের ভিজুয়াল কানেকশন খুবই ভালো। এক পাশে পার্ক, চওড়া ফুটপাথ, একটু পর পর বিশ্রাম নেবার জায়গা আর মেট্রো ধরার জন্য আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবার সিঁড়ি, ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলছে রংচঙ্গে বাস- আমরা হাঁটাটা খুবই উপভোগ করছিলাম। সুন্দর আরবান প্ল্যানিং নগরবাসীর মনে কি রকম প্রভাব ফেলে তা হাতে কলমে বুঝতে পারছিলাম।

একসময় আমরা ইলিয়ট পার্ক নামের একটা পার্ক পেলাম। সেখানে ঢুকে ঘুরলাম, ফিরলাম। চমৎকার জায়গা। কোন আজেবাজে লোক নাই আর মেইন্ট্যানেন্স খুবই ভালো। আমরা অনেক ছবি তুললাম। বের হয়ে এসে জানতে পারলাম এটা টাটা কোম্পানি সরকারকে উপহার দিয়েছে। কি উপহার! কিছুদূর গিয়ে আমরা বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম পেলাম। কিন্তু শোর সময় আমাদের সাথে না মিলার কারনে আমরা বাইরে থেকেই ছবি তুললাম। এইটাও নাকি বিড়লা কোম্পানি সরকারকে উপহার দিয়েছে! প্ল্যানেটোরিয়ামের গেট থেকে বের হয়ে একটু এগিয়েই দেখলাম নানা রকম ফল কেটে বিক্রি করছে একজন। পেপে, তরমুজ, শশা, পেয়ারা, আপেল ছোট ছোট কিউব করে কাটা, উপরে বিট লবন টাইপ কিছু একটা ছিটিয়ে ওয়ান টাইম ইউজ কাগজের প্লেটে সাজিয়ে রেখেছে। আমি আর নিশাত ২০ রুপি দিয়ে একটা প্লেট কিনে ভাগ করে খেলাম। বেশ ভালো লাগলো।

খানিক দূর আগাতেই গুগল ম্যাপ দেখে চিৎকার করে উঠলাম আমি, গড়ের মাঠ! গড়ের মাঠ!! সামনে তাকিয়ে দেখলাম- এই তা হলে সেই গড়ের মাঠ? শুধু মাঠ বললে ভুল হবে, এ তো এক ময়দান। বি-শা-ল বড় খালি জায়গা। তাতে কত মানুষ! কেউ খেলছে, কয়েকটা দল ফুটবল প্র্যাক্টিস করছে, এখানে ওখানে ছাগল চড়ে বেড়াচ্ছে, অনেক মানুষ হাত পা ছড়িয়ে গল্প করছে, তাদের ঘিরে পানিপুরিওয়ালা, ফলওয়ালাসহ আরও বহু রকমের স্ট্রিট ফুড নিয়ে লোকজন বসে আছে।আমি চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম, মনে হলো টেনিদা আর প্যালারামকে বোধহয় একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে!

অবশেষে এসে পৌছালাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ফুটপাথ থেকেই দেখা যায় বিশাল রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ধবধবে সাদা মহলটা। বাইরে থেকে দেখেই বোঝা গেলো এটা গ্রীক স্থাপত্য। এবার আমরা আবার পৃথ্বীকে পাঠালাম টিকেট কাটতে। সহজেই ১০ রুপির টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। অনেক দূরে হেঁটে আমরা দালানের ভিতর ঢুকলাম। সারা জীবন যে গ্রীক স্থাপত্য পড়ে এসেছি তার বিভিন্ন উপাদান যেমন- কলাম, রোজ উইন্ডো, ডোম, পেন্ডেন্টিভ ইত্যাদি চোখের সামনে দেখে বেশ উত্তেজিত বোধ করলাম। ভেতরে বিশাল বিশাল সব চমৎকার স্ট্যাচু, পেইন্টিং, দলিল, অস্ত্র ইত্যাদি আছে। আর আরেকটা হলে ভারতের ইতিহাস, তাদের বীরদের কথা, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অনুযায়ী তাদের ঘরবাড়ির সেট ইত্যাদি জিনিস বানানো আছে। এই অংশটা আমার কাছে বেশ রঙ চঙ্গে মনে হলো।

এখান থেকে বের হয়ে আমাদের সাথে প্রথম ‘সুলভ শৌচালয়’ এর সাথে পরিচয় হলো। এটা আর কিছুই না, এটা হলো পরিষ্কার বাথরুম তবে টাকা দিয়ে ব্যবহার করতে হয়। যখন আমরা ভিক্টোরিয়া থেকে বের হয়ে আসি তখন খেয়াল করি, এর অনেক অংশই এখনো আন্ডার কন্সট্রাকশনে আছে। পেটে তখন আমাদের খিদের আগুন জ্বলছে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে স্ট্রিট ফুডে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমি নিলাম ২০ রুপি দিয়ে ডিম রোল নামের একটা জিনিস। অন্যরা নিলো ভেলপুরি, চাট, চানাচুর, পেটিস, নুডুলস, নিম্বু পানি- এই সব। কোনটারই দাম ২৫ রুপির বেশি না। আমরা তৃপ্তি করে পেট ভরে খেলাম।

dgr
জিভে পানি আসা পাপড়ি চাট (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

এরপর আমরা মোড়ের ট্রাফিককে জিজ্ঞেস করতে গেলাম বেলুর মঠ কিভাবে যাওয়া যায়। কিন্তু তারা আমাদের আশায় পানি ঢেলে দিয়ে বলল যে এখন বাজে চারটা আর বেলুর মঠ পৌছাতে পৌছাতে পাঁচটা বেজে যাবে। আর পাঁচটার সময়ই বেলুর মঠ বন্ধ হয়ে যায়। কি আর করা, আমরা কুইক ডিসিশন নিলাম যে কফি হাউজে যাবো। ওনারা সাজেশন দিলো এখান থেকে মেট্রো করে চলে যেতে। আমরা মহা আনন্দে আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো স্টেশনে গেলাম। কি সুন্দর ফাঁকা আর পরিষ্কার! আমরা দেওয়ালে টানানো লিস্টে কলেজ স্ট্রিটের নাম খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু পেলাম না। একজন ইউনিফর্ম পড়া মহিলা এগিয়ে এসে আমাদের বলল এম জি রোডের টিকেট কাটতে। আমরা কাউন্টারে লাইন ধরে ৫ রুপির টিকেট কাটলাম। টিকেট কোথায়, এ তো প্লাস্টিকের কয়েন! প্ল্যাটফর্মে ঢুকার আগে মেশিনে স্ক্যান করে সেই কয়েন দেখিয়ে ঢুকতে হয়। আমরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে দেখলাম ফাঁকা, শুনশান প্ল্যাটফর্ম। মুহুর্তের মাঝেই মেট্রো আসলো। তবে মেট্রোটা ফাঁকা নয়- প্রচুর ভীড়। মুহুর্তের জন্য দরজা খুললো, আমরা কিছু বোঝার আগেই সবাই ঠ্যালা ধাক্কা দিয়ে কোন মতে ভিতরে ঢুকে গেলাম। কোন মতে উপরে ঝুলতে থাকা হাতল ধরলাম, আর সাথে সাথেই দরজা বন্ধ করে ভয়ানক ত্বরণে মেট্রোটা এগিয়ে যেতে লাগলো। আমরা সবাই পিছন দিকে একদম হেলে পড়লাম। প্রচন্ড ভীড় , গায়ে গা ঘেঁষে আমরা দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু সুবিধা করতে পারলাম না। একটু পর পর একেকটা স্টেশন আসে আর আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি একজন আরেকজনের উপর। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, কত স্বপ্ন ছিলো, আমরা সবাই পাশাপাশি মেট্রোতে বসে একসাথে সেলফি তুলবো, তারপর সবাইকে দেখাবো যে আমরা কত এক্সাইটিং একটা কাজ করেছি- কিন্তু তা আর হলো কোথায়? এখন এখান থেকে নামতে পারলে বাঁচি। কান খাড়া করে রেখে এক সময় আমরা টের পেলাম যে আমাদের এম জি রোড স্টেশন চলে এসেছে। সেই আগের মতন কয়েক সেকেন্ডের জন্য মেট্রো থামতেই আমরা ধাক্কাধাক্কি করে হুড়মুড় করে নেমে পড়ি। মেট্রো থেকে নেমেই আমরা একজন অন্যজনের দিকে তাকাই, সবার চোখেই একই দৃষ্টি ‘এটা কি হইলো? একেই কি বলে মেট্রো? কিছু বুঝার আগেই তো শেষ হয়ে গেলো’ ।

যাই হোক আমরা সেই প্লাস্টিকের কয়েনটা জমা দিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হয়ে আসি। ফাঁকা এম জি রোডের কোন দিকে কফি হাউজ তা বুঝতে পারি না। আবার ট্রাফিকের কাছে যাই। রাস্তা দেখিয়ে উনি আমাদের হাঁটতে বলে। আমরাও হাঁটতে থাকি। বেশ কিছুদূর হেঁটে খুঁজে পাই বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ আর তার উল্টা পাশে কফি হাউজ।

কফি হাউসের ভেতরে যখন ঢুকি তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৫টা ছুঁই ছুঁই। অত্যন্ত সাধারণ চেহারার দালান। নিচ তলায় বোধহয় গোডাউন। দোতলায় কোন এক ব্যক্তির শোক সভা চলছিলো। আমরা তিনতলায় গিয়ে বসলাম। এই সেই বিখ্যাত কফি হাউজ! পাইক পেয়াদাদের মতন ফিটফাট পোশাক পড়ে বেয়ারারা ঘুরছে, আশেপাশে সব তরুন-যুবক বয়সী লোকেরা আড্ডা দিচ্ছে, আর নিচতলায় শোক সভায় আগত মানুষ -সব মিলিয়ে এক অদ্ভূত কম্বিনেশন তৈরি হলো। আমরা কোল্ড কফি, আর কি সব পাকোড়া অর্ডার দিলাম। একটু পর যত্ন করে ধোয়া কাঁচের গ্লাসে করে পানি দিয়ে গেলো। আমরা উসখুস করতে লাগলাম কখন খাবার আসবে, তার জন্য। এর মধ্যে অবনী, আদিবা, সৌরভ, জেরিন, আফরা আসলো। আমরা এক টেবিলে বসে গল্প করতে লাগলাম। খানিক পরে রিজভী, তুষার, শুভ, জুবায়ের, রাজিবসহ আরও অনেকেই যোগ দিলো। আমরা সবাই মিলে জোর গলায় হাসাহাসি করতে লাগলাম। অনেক্ষন পর খাবার আসলো। যদিও পাকোড়াটা মজার ছিলো না, তারপরও কফি হাউজ বলে কথা!  বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, হৈচৈ সব মিলিয়ে আমরা দারুন সময় পার করলাম।

সাড়ে সাতটার দিকে আমরা সবাই বের হয়ে বাসে উঠলাম। ৬ রুপিতে একটা লোকাল বাস আমাদের হাওড়া ব্রিজ পার করে নামিয়ে দিলো।  আমরা কাছ থেকে ঝলমলে হাওড়া ব্রিজ দেখলাম। ভারি চমৎকার লাইটিং, ক্ষনে ক্ষনে রঙ বদলায়। ব্রিজের স্ট্রাকচারটাও অত্যন্ত দারুন। ডাবল ট্রাস দেওয়া, নিচে কোন সাপোর্ট নাই, পুরাই ঝুলন্ত এক ব্রিজ। আমরা ব্রিজের উপরে উঠলাম। নিচে হুগলী নদী। ঠান্ডা বাতাসে জমে যাওয়ার উপক্রম হলেও আমাদের বেশ ভালোই লাগছিলো। আমরা ব্রিজ থেকে নেমে নিচে ফুলের পাইকারি বাজারে গেলাম। পচা গন্ধে নাক চাপা দিয়ে হাঁটতে হলো। শেষমেশ একটা নদীর তীর পাওয়া গেলো যেখান থেকে সুন্দর ব্রিজের ভিউ আসে। আমরা দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। তারপর আবার বাসে উঠলাম।

আলোকিত হাওড়া ব্রিজ (কৃতজ্ঞতায় সামিয়া অবনী)

কোলকাতার বাসগুলো বেশ সুন্দর। কাঠের বডি, বেশ চওড়া, ভেতরে দাঁড়ানোর অনেক জায়গা, জানালাগুলো স্লাইড করে বাসের দেওয়ালের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলা যায়। সিটগুলোতেও বসে আরাম। তবে হাত দিয়ে ধরার রড অনেক উপরে, হাত সবসময় টানটান করে রাখতে হয়। আরেকটা ব্যাপার হলো সবগুলো বাসেই ‘জয় মা তারা’ লিখা থাকে। বাইরে আবার বাসগুলো বেশ রংচঙ্গে। আর বাস ভাড়াও অ-নে-ক কম। আমি যখন বাসের ফ্যান হয়েই যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই সুহাইলার সাথে বাসে দাঁড়ানো নিয়ে এক মহিলার সাথে দারুন ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। যখন দেখে মনে হচ্ছিলো ব্যাপারটা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যাবে তখনই শুভ আমাদের সবাইকে নিয়ে ধর্মতলার স্টপেজে নেমে গেল। আমরা সুহাইলাকে ঠান্ডা করে আবার ধর্মতলা টু পার্ক স্ট্রিট আরেকটা বাসে উঠলাম। এবার আমরা সুন্দর মতন পার্ক স্ট্রিটে নেমে যাই।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা রাস্তা হারিয়ে এইগলি, ওইগলি ঘুরতে থাকি। মেইন রোডে সব বড় বড় রেস্টুরেন্ট- সাবওয়ে, ম্যাক ডোনাল্ডস, চাইনিজ তুং ফং, পাঞ্জাবী হোটেল – এইসব দেখতে পাই। এর মধ্যে এক গলিতে শামিয়ানা টানিয়ে কোন এক চিশতী বাবার উদ্দেশ্যে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখি। সেখানে একটা বাচ্চার গলায় ‘মুঝে মাজবুর হ্যায় জয় চিশতী’ গানটা আমার কানে এখনো বাজে। তারপর যাই হোক রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা সোজা দাওয়াত হোটেলে ঢুকি। এটা মুসলমান হোটেল। আমি ১১০ রুপি দিয়ে নান আর চিকেন টিক্কা অর্ডার দেই। দামটা একটু বেশি হলেও খাবার বেশ মজা। খাওয়া শেষে পানির বড় বোতল কিনে হোটেলে ফেরত আসি। আমি অন্যদের সাথে কথা বলে জানলাম, আমরা ছাড়া আর কেউ ভিক্টোরিয়া দেখে নাই, বেলুর মঠ বন্ধ ছিলো, ফুড ফেস্টিভ্যাল বোরিং ছিলো। শুনে বেশ খুশি হলাম। যাক দিনটা সাকসেস্ফুল হয়েছে।

খানিক পরে চিং লাফাতে লাফাতে আসলো। লাফ মানে লাফ, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই লাফ। ব্যাপার কি? এত খুশি কেন চিং? আমরা জিজ্ঞেস করছিলাম, কিন্তু খুশির ঠ্যালায় ওর মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। পরে আমরা বুঝতে পারলাম, চিং, উর্মি আর অদিতি দিপিকা পাড়োকানকে সামনা সামনি দেখেছে। দিপিকা নতুন ছবির শুটিং করার জন্য কলকাতায় এসেছে। দিপিকা হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় ওরা ধাক্কাধাক্কি করে একেবারে সামনে থেকে দেখে এসেছে। দিপিকার সাথে আরও ছিলো ইমতিয়াজ আলি আর সুনিধী চৌহান। কালো টপ-স্কার্ট, লাল সোয়েটার, লাল জুতা আর ছোট চুলে দিপিকাকে নাকি বেশ সুন্দরী লাগছিলো। পরে বুঝেছি, সিনেমাটা ছিলো ‘তামাশা’।

যাই হোক চিং চলে গেলে আমরা যার যার লাগেজ গুছিয়ে  রাখি, পরদিন ট্রেন জার্নি। ঠিক হয় যে, সকালে বের হওয়ার আগেই সব লাগেজ নিচতলায় ছেলেদের রুমে জমা দিয়ে বের হতে হবে। আমরা গোছগাছ করতে করতে উর্মির অট্টহাসি শুনতে পাই। আমাদের নিচেই ওদের রুম। জানালা দিয়ে ওদের হাহা হিহি শব্দ ভেসে আসতেই থাকে। আমরাও অনেক গল্প করে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।

তুলা মেঘের সাজেক উপত্যকা

এ বছরের শুরুতে দেড় মাস ব্যাপী ইন্ডিয়া ট্যুর দেওয়ার পর দ্বিমিকবাসী বেশ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। পুরো একটা টার্ম জুড়ে কোন ট্যুর না দেওয়ার ঘটনা এই লেভেল ৪ টার্ম ১ এ প্রথমবারের মত ঘটে। তাই এইবার বাই হুক অর বাই  কুক একটা ট্যুর দিতেই হবে- এমন চিন্তা শুরু থেকেই আমাদের মাথায় আসে। আমরা বিক্ষিপ্তভাবে নানা প্ল্যান করলেও অবশেষে ওয়ান এন্ড অনলি জাফরের আয়োজনে সবাই বের হয়ে পড়ি মেঘ পাহাড়ের দেশ সাজেকের উদ্দেশ্যে। অনেকদিন পর একটা ব্যাচ ট্যুর- হাসি, আনন্দ আর অ্যাডভেঞ্চারে কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো দুইটা দিন। যারা যায় নাই তাদের জন্য যে চরম মিস- সে কথা না বললেও চলে।

 

বাস থেকে নেমেই মনে হলো হাত, পা সব জয়েন্ট থেকে খুলে পড়ে যাবে। সারা রাতে বাসে মুড়ির মতন ঝাঁকানি খেতে খেতে বাস থেকে নেমেই তাই আমরা ২১ জন দ্বিমিকবাসী হাত পা ছুড়তে লাগলাম। যে জায়গাটায় দাঁড়িয়েছিলাম সেটা হলো শাপলা চত্বর। খাগড়াছড়ি শহরের এটাই মনে হলো সব চেয়ে বড় কেন্দ্রস্থল। প্রায় সাথে সাথেই জাফরের সাথে কন্টাক্ট করে জাফরের ঠিক করে রাখা দুই চান্দের গাড়ি এসে হাজির হলো। চান্দের গাড়ি পেয়ে আমরাও মহা উৎসাহে টপাটপ উঠে পড়ি। কিন্তু আমাদের গাড়ি আর ছাড়ে না। খবর নিয়ে জানলাম, সার্কিট হাউস থেকে কর্মকর্তা কেউ একজন আসছেন আমাদের রিসিভ করতে। অবশেষে একজন অফিসার আসলেন। তিনি নোভার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে আমাদের সাথে রওয়ানা দিলেন সার্কিট হাউসে। আমরা মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস নোভা ছিলো!

পাহাড়ের উপর চমৎকার, ছিমছাম, পরিপাটি সার্কিট হাউস দেখেই আমাদের সবার মনে একসাথে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারী চাকরি করার খায়েশ জাগলো। যাই হোক, চমৎকার তিন খানা রুম আমাদের জন্য খুলে দেওয়া হলো। আমরা মেয়েরা দুইটা রুমে ভাগ হয়ে পালা করে ফ্রেশ হয়ে নিতে লাগলাম। ঐদিকে জাফর আমাদের জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে আসতে বললো। আমরা সবাই ডাইনিঙয়ে বসে অফিসারদের মত করে নাশতা খেলাম। পরোটা, ভাজি আর চা। পেট ভরে এসব খেয়ে আমরা ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে পড়লাম। আবার চেপে বসলাম চান্দের গাড়িতে। হেল্পার আমাদের জানালো চাইলে চান্দের গাড়ির উপরেও আমরা বসতে পারি। শিশির টকাটক উঠে গেলো আমাদের গাড়ির উপরে। প্রায় দশটার দিকে দুই গাড়ি লাইন ধরে চলতে লাগলো।

খাগড়াছড়ি শহর পার হতেই রাস্তার দুইপাশে লোকজন কমতে লাগলো। চমৎকার সব পাহাড়ের দিকে আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে আমরা চলতে লাগলাম। আর নিজেরা মজাসে গল্পগুজব করছিলাম। নোভা জানালো সাজেক ভ্যালি আসলে রাঙ্গামাটি জেলায় পড়েছে কিন্তু খাগড়াছড়ি থেকে যেতে সুবিধা হয় বলেই নাকি সবাই খাগড়াছড়ি থেকেই সাজেক যায়। শুনে বেশ ভালোই লাগছিলো যে এক সাথে খাগড়াছড়ি প্লাস রাঙ্গামাটি দুইটা জেলায় পা দিতে পারবো। একটু পর পর আর্মির চেক পোস্ট আসছিলো। আমাদের চান্দের গাড়ির হেল্পার বারবার নেমে চেক পোস্টে নানা রকম বিবরন দিয়ে আসছিলো।

এভাবে প্রায় দেড় ঘন্টা চলার পর আমরা থামলাম শুকনাছড়া বা হাজাছড়া ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। রাস্তা থেকে নেমে আমরা হাঁটতে লাগলাম। পথ কখনও পানির ধারার নিচে, কখনও উঁচু, কখনও নিচু। বেশ মজা করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। প্রায় দশ পনের মিনিট হাঁটতেই আমরা পৌঁছে গেলাম ঝর্ণার কাছে। ঠান্ডা পানিটাতে পা ডুবিয়ে রাখতে আমাদের যে কি ভালো লাগছিলো আর বলার মতন না। সবাই যার যার মত পানিতে নেমে পড়লো। তানভীর আর রাফাত বেয়ে বেয়ে পাহাড়ের গায়ে খাঁজ বরাবর উঠে ঝর্ণার পাশে বসে রইলো। ঝকঝকে রোদের মধ্যে টলটলে পানিটাকে পেয়ে সবাই খুব শান্তি পাচ্ছিলো। কয়েকজন তো চলেই গেলো ঝর্নার নিচে দাঁড়াতে! তবে এখানে পানির গভীরতা কম। তাই তেমন বিপদের কিছু মনে হলো না। ঝর্ণার পানিতে শরীর জুড়িয়ে আমরা আবার ফেরত গেলাম।

ঠান্ডা পানির হাজাছড়া ঝর্ণা (কৃতজ্ঞতায়- পৃথ্বী)
ঠান্ডা পানির হাজাছড়া ঝর্ণা (কৃতজ্ঞতায়- পৃথ্বী)

চান্দের গাড়িতে উঠার আগে দেখলাম পিস এক টাকা হিসেবে পাহাড়ী কলা বিক্রি হচ্ছে। তানভীর আমাদেরকে খাওয়ালো সেই কলা। কলা খেতে খেতে আমরা গাড়িতে উঠলাম। এবার অনেকেই শিশিরের সাথে গাড়ির ছাদে উঠে বসলো। আমরা আগের মতই ভিতরেই বসলাম। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। ঠান্ডা বাতাসে আমাদের ভেজা জামা কাপড় সব শুকিয়ে যেতে লাগলো। যতই সামনের দিকে যেতে লাগলাম, একটা অদ্ভূত দৃশ্য চোখে পড়লো। রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট উপজাতি বাচ্চারা সব আমাদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে হাত নাড়তে লাগলো। উপর থেকে জাফর লজেন্স ছুঁড়ে দিতে লাগলো বাচ্চাদের দিকে। বাচ্চারাও দৌড়ে দৌড়ে লজেন্স কুড়াতে লাগলো। এখানে নাকি এটাই সঠিক নিয়ম। বাচ্চারা অভিবাদন জানাবে আর পর্যটকরা তাদের দিকে চকলেট, লজেন্স ছুঁড়ে দিবে। ভাগ্যিস জাফর আগে থেকে জানতো!

আস্তে আস্তে পাহাড়গুলো কেমন যেন বদলে যেতে লাগলো। পরিষ্কার নীল আকাশ, কার্টুনের মত মেঘের চাঁই, বড় বড় সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড় দেখতে দেখতে আমাদের যাদের ক্যামেরা ছিলো, তারা সব ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। কারন নিজের চোখে দেখা এইসব দৃশ্য ক্যামেরাতে এক কানাও ধরে রাখা যাবে না। অন্তরা আর সুমাইয়া গলা ছেড়ে গান ধরলো। রাস্তা কখনও খাড়া নিচু, কখনও খাড়া উঁচু। যখন উঁচুতে উঠি তখন বুক ধুক ধুক করতে থাকে আর যখন নিচে নামি তখন গলা থেকে চিৎকার বের হয়ে আসে অটোমেটিক। ঐদিকে রুবাইদা সামনে বসে প্রায় ঘুমে ঢলে পড়েই যেতে থাকে। আমি বেশ কয়েকবার ওকে জাগিয়ে দেই।

সাজেকের পথে (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)
সাজেকের পথে (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

দীঘি নালা, বাঘাই ঘাট, মাসালং বাজার সব পার হয়ে প্রায় দুইটার দিকে আমরা গিয়ে পৌঁছাই সাজেক ভ্যালির রুইলুই পাড়ায়। চেক পোস্ট পার হয়ে সোজা গিয়ে পৌঁছাই আগে থেকে ঠিক করে রাখা আলো রিসোর্টে। চারটা রুম আমাদের জন্য বুক করে রাখা ছিলো। আমরা মেয়েরা টপাটপ তিনটা রুমের দখল নিয়ে নেই। সবার গোসল করার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু রিসোর্টের লোক এসে বলে গেলো এখানে পানি বেশ দামি কারণ পানি আনতে হয় নিচ থেকে গাড়ি করে। যেহেতু আমরা ২১ জন তাই আমাদের বুঝে শুনে পানি খরচ করতে হবে। তাই আমরা আর গোসল না করে হাতমুখ ধুয়েই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা ঠিক করে রাখা হয়ে ছিলো ঠিক পাশের খাবার হোটেলটাতে। দুপুরে খেলাম ভাত, আলু ভর্তা, মুরগি আর ডাল। সাথে শশা, লেবু আর কাঁচা মরিচ। আমি ঝালের চোটে তেমন কিছুই খেতে পারছিলাম না। যাই হোক খেয়েদেয়ে আমরা রুমে ফিরে আসলাম। মার্জিয়া আর অন্তরা বাদে আমরা বিছানায় শুয়ে লম্বা হয়ে রেস্ট নিলাম সবাই। আগের রাতে হতচ্ছাড়া বাসের ঝাঁকুনিতে কেউ এক দন্ডও চোখের পাতা এক করতে পারে নাই। এখন একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়।

ঠিকঠাক চারটার সময় আমরা সবাই বের হয়ে পড়লাম। আগের মত চান্দের গাড়িতে করে উঠে রওয়ানা দিলাম কংলাক পাড়ার দিকে। এবার অনেকেই উঠে বসলো গাড়ির ছাদে। একটু দূর গিয়ে গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিলো। বাকিটা পথ হেঁটে যেতে হবে। বাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে আমরা হাঁটতে লাগলাম। বিকালের লাল রঙয়ের রোদে পাহাড়্গুলোকে পুরো ছবির মতন লাগছিলো। আমার এক পাহাড়ের ছায়া অন্য পাহাড়ের গায়ে পড়াতে বেশ চমৎকার এক আলো ছায়ার খেলা দেখা যাচ্ছিলো। আমরা সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে হাঁটতে লাগছিলাম। হঠাৎ কতগুলো ছোট ছোট বাচ্চা ছোট ছোট বাঁশের লাঠি নিয়ে দৌঁড়ে আসলো। আমরা পাঁচ টাকা করে একেকটা লাঠি কিনে নিলাম। বেশ অভিযাত্রীর ভাব নিয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। একটু পর শুরু হলো পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠা। একে তো হাঁটতে হাঁটতে আমাদের অনেক পরিশ্রম হচ্ছিলো তার উপর খাঁড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে আমরা পুরাই ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এই কংলাক পাড়া হচ্ছে সাজেকের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। এত কষ্ট করেও কেন মানুষ এইখানে উঠে টের পেলাম উপরে উঠে। এক দৃষ্টিতে যখন তাকিয়ে ছিলাম বিকালের রোদের রঙে রঙ্গিন হয়ে যাওয়া পাহাড়গুলোর দিকে, অনেকক্ষন কোন কথা বলতে পারলাম না। নিশাতকে দেখলাম ক্যামেরা বন্ধ করে ফেলতে। কি লাভ? এই দৃশ্য কোনদিনও ক্যামেরায় ধরে রাখা সম্ভব না। আমাদের সাথে চান্দের গাড়ির দুজন হেল্পার সব সময় ছিলো। ওনারা বললো আরও একটু উপরে উঠেন, সূর্যাস্ত দেখবেন না? আমরা উনাদের ফলো করে লুসাই, টিপরা উপজাতিদের ঘরবাড়ি পার হয়ে আরও উঁচু এক জায়গায় এসে পৌঁছালাম। মনে হলো ক্যানভাসের উপর অস্তগামী সূর্যটা যেন কমলা রঙের বোতল উপুড় করে আকাশের গায়ে রঙ ঢেলে দিয়েছে। সেই রঙের প্রতিফলিত হয়ে ছিটকে পড়ছে ঐ দূরের অবাস্তব পাহাড়গুলোর গায়ে। দৃশ্যটা এতই মনোমুগ্ধকর যে সবাই চুপ হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, বুঝতে হবে এ তো আর যে সে শিল্পীর ক্যানভাস নয়, এ স্বয়ং আল্লাহর ক্যানভাস। মানুষের সাধ্য কি এই দৃশ্য নকল করার?

কমলা সূর্যটা টুপ করেই ডুবে যাচ্ছিলো (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

ওদিকে আমরা গ্রুপ ফটোর জন্য রেডি হতে হতেই সূর্যটা টুপ করে হারিয়ে গেলো আকাশের মাঝে। সূর্য ডুবতেই আমাদের টনক নড়লো। এই পাহাড়ি পথে আমাদের এখন ফেরত যেতে হবে। আমরা তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। আলো থাকতে থাকতেই খাড়া পাহাড়টা বেয়ে নিচে নেমে পড়লাম। তারপরও কোন থামাথামি না করে ছুটতে লাগলাম। অনেক দূর হেঁটে যখন আমরা মোটামুটি ভালো রাস্তায় এসে পৌঁছালাম, তখন দেখলাম আকাশে এক বিশাল গোল চাঁদ। যদিও পরেরদিন পূর্নিমা তারপরও এত বিশাল চাঁদ কেবল ইংলিশ সিনেমাতেই দেখা যায়। আমরা হাঁ করে দেখতে লাগলাম চাঁদটাকে। পাহাড়ের ধারের জংলার ফাঁক দিয়ে দেখা সেই বিশাল চাঁদ তার ধবধবে জোসনা দিয়ে মূহুর্তেই সব আলোকিত করে দিলো। একপাশে বিশাল চাঁদ, অন্য পাশে আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকা কমলা রঙ দেখতে দেখতে আমার মনে হলো আমি বোধহয় এই মূহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। এত সুখ কেন জীবনে?

পাহাড়ী চাঁদ (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)
পাহাড়ী চাঁদ (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

চান্দের গাড়িতে যখন উঠলাম, একটু একটু ঠান্ডা লাগতে শুরু করলো। আমাদের আবার নামিয়ে দেওয়া হলো হেলি প্যাডে। বিশাল হেলি প্যাডে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার আকাশে বিশাল চাঁদটা দেখে আমাদের মনে হলো আমাদের বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আমি উপরে তাকিয়ে দেখলাম বিশাল আকাশ জুড়ে কোটি কোটি তারা। এত তারা জীবনে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। ঠান্ডা বাতাসে আমাদের সব ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে গেলো। আমরা পাগলের মত ছবি তোলার চেষ্টা করে যেতে লাগলাম সেই চাঁদের আলোয়। সৃষ্টি ধৈর্য ধরে আমাদের সকল পাগলামি ক্যামেরা বন্দি করার চেষ্টা করে যেতে লাগলো। আমরা তারপর সারি ধরে বসে গান গাইতে শুরু করলাম। যখন সৃষ্টি ধরলো, ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে/ বসন্তেরই মাতাল সমীরনে’ তখন মনে হলো আমি বুঝি কোন এক রূপকথার রাজ্যে এসে পড়েছি। এত সুন্দর একটা দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য দান করার কারণে আল্লাহকে মনেমনে ধন্যবাদ জানালাম।

ওদ
বিশাল একটা চাঁদের নিচে বসে তখন আমাদের মাথা খারাপ অবস্থা            (কৃতজ্ঞতায় নিশাত তাসনিম)

আমরা সেখান থেকে আলো রিসোর্টে পৌঁছে চা, চিপস, কেক খেতে খেতেই খবর পেলাম আমাদের রাতের খাবার রেডি। এখানকার লোকাল কেকগুলো খেতে খুবই মজা। দেখতে পিঠার মত, খেতে কেকের মত। জাফর এসে জানালো আমাদের প্ল্যান মত বার বি কিউ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। আগের মেনুই দিলো রাতের বেলা। খেয়ে দেয়ে সবাই কয়েক কদম হেঁটে আসলাম ফুটপাথ বিছানো চওড়া পাকা রাস্তাটা ধরে। চাঁদের আলোয় সব কেমন যেন অপার্থিব লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো বিশাল এক লাইট কেউ জ্বেলে দিয়েছে। দূরের মিজোরামের পাহাড়গুলোও রহস্যময় লাগতে লাগলো। কি সুন্দর পথ, শুধু আমরা ছাড়া আর কেউ নাই! মনে হচ্ছিলো হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই দূরে কোথাও। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয় তাই আমরা তাড়াতাড়ি ফেরত আসলাম। আমি তারপর রুমে ফিরে শুয়ে পড়ার বন্দোবস্ত করতে লাগলাম। অনেকক্ষন পর যখন সবাই রুমে ফেরত আসলো, লাইট নিভিয়ে আমরা ঘুমাতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ঘুমাতে আর পারছিলাম কই? পাশের রুমের বোর্ডাররা সারা রাত বিকট স্বরে নাক ডেকেই যেতে লাগলো। আমরাও ঘুমানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে অন্ধকারে চরম হাসাহাসি করতে লাগলাম।

মে
মেঘ যখন পায়ের নিচে (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী)

পরদিন ভোরে আমি, নিশাত আর পৃথ্বী বাদে বাকি সবাই সূর্যোদয় দেখতে গেলো। আমি পরে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম হোটেলের দরজা দিয়েই দেখা যাচ্ছে আমি যে লেভেলে দাঁড়িয়ে আছি, তার অনেক নিচে জমে আছে তুলা তুলা মেঘ। পাহাড়গুলো অর্ধেক যেন হারিয়ে গেছে তুলা তুলা মেঘের সারির পিছনে। আমি দেখে থ হয়ে গেলাম। যারা সূর্যোদয় দেখতে গিয়েছিল তাদের কাছ থেকে বর্ণনা শুনে বেশ আফসোস লাগলো। আমরা নাস্তা খেতে গেলাম। লুচি, ভাজি, অমলেট আর চা। পেট ভরে খেয়ে আমরা উঠে পড়লাম। আবার রওয়ানা দিলাম চান্দের গাড়িতে চড়ে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে।

এবার আর কোন থামাথামি নাই। টানা চলতে লাগলাম আমরা। ঠিক যেই পথ দিয়ে এসেছি, সেই পথ দিয়ে ফেরত গেলাম। তিন ঘন্টা পর আবার সেই খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে এসে নামলাম আমরা। আবার ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরপর একটু বিশ্রাম নিয়েই বের হলাম সিস্টেম রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। বাঁশ কাঠের ইন্টেরিয়র করা রেস্টুরেন্টটাতে আমরা সবাই মিলে অর্ডার দিলাম অনেক কিছুই। পোলাওর চালের নরম ভাতের সাথে বাঁশ কুড়ুল, লাউ চিংড়ি, মাশ্রুম, হাঁসের ভুনা, থাঙ্কুনি পাতার ভর্তা, শুটকি ভর্তা, ডাল সবই খেয়ে দেখলাম। বাঁশটা সবচেয়ে মজা ছিলো। আমার কাছে বেশ ভালোই লাগলো খেতে। খেয়েদেয়ে আমরা রওয়ানা হলাম আলুটিলা গুহার উদ্দেশ্যে।

আলুটিলার গেটে পৌঁছে আমরা ৫ টাকার টিকেট আর ১০ টাকার মশাল কিনলাম। মশালটা আসলে কিছুই না, বাঁশের আগায় কেরসিন মাখানো পাটের দড়ি। তারপর সোজা হাঁটা ধরলাম। মোটামুটি ২৬৬ টা সিঁড়ি ভেঙ্গে পৌঁছালাম গুহা মুখে। গুহা মুখে পৌঁছে আমরা জাফরের দেয়াশলাই থেকে মশাল ধরিয়ে নিলাম। খুবই হাস্যকর মশাল। ঝিরঝির পানির উপর দিয়ে যখন গুহা পথে ঢুকলাম মুখ দিয়ে বিস্ময়ের এক আর্ত চিৎকার অটোমেটিক বের হয়ে আসলো। এ তো যেন কোন হলিউডি সিনেমার গুহার ভিতর ঢুকে পড়েছি। কিংবা তিন গোয়েন্দার আটকে পড়া গুহাগুলো তো এইরকমই ছিলো। আমি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আগাতে শুরু করি। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মধ্যে আমার মশালটা টুপ করে নিভে গেলো। অন্ধকারে পানির ধারা আর বড় বড় পাথরের চাঁই পার হতে হতে একরকমের গা ছমছমে অনুভূতি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমরা বেশ হৈচৈ মজা করে একে অন্যকে সাহায্য করে আগাতে লাগলাম। গুহার ভেতর কোথাও কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোথাও কোমর পানি, কোথাও কোথাও সরু পথ, কোথাও এত নিচু ছাদ যে কুঁজো হয়ে হাঁটতে হয়। খাগড়াছড়ি টুরের বেস্ট পার্ট মনে হলো আমার এই গুহা দর্শন। প্রায় পনের বিশ মিনিট পর আমরা সূর্যের আলো দেখতে পেলাম। লতা পাতা আর শ্যাওলা জাতীয় গাছে ঢাকা গুহা মুখটা অত্যন্ত সুন্দর ছিলো। বের হয়ে ভাবলাম বাংলাদেশে এত সুন্দর একটা গুহা আছে কল্পনাই করতে পারি নাই। ভেজা আর কাদা মাখা জামা কাপড় নিয়ে আমরা একটু পানি খেয়েই ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার পথে দেখতে পেলাম পাহাড়ের উপর থেকে অত্যন্ত সুন্দর খাগড়াছড়ি শহর। মনে হলো যেন সিমলা শহরের ছোট ভার্সন দেখছি।

দ্ব
দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের আলুটিলা গুহার শেষ মাথায় দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় পৃথ্বী

আমরা দৌড়ে দৌড়ে চান্দের গাড়িতে উঠলাম। অবস্থা এমন হলো যে আমার গাড়িতে শুধু আমিই একমাত্র ভিতরে বসে আছি, বাকি সবাই উপরে। যাই হোক পনের মিনিটের মধ্যে গিয়ে পৌঁছালাম রিসাং ঝর্ণার কাছে। অনেক ঢাল বেয়ে গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিলো। আমরা হেঁটে হেঁটে বেশ খাড়া ঢালু পথ দিয়ে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে নামতে লাগলাম। আসলে দৌড় দিচ্ছিলাম না। পথটা এতই খাড়া ছিলো যে হাঁটাটা অটোমেটিক দৌঁড় হয়ে যাচ্ছিলো। মারজিয়া দৌড় কন্ট্রোল করতে না পেরে হিমির সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়েই গেলো। যাই হোক আমরা লাইন ধরে নামতে লাগলাম। একটা বাঁক পার হওয়ার পর পরই তানভীর আমাদের দেখালো রিসাং ঝর্না। আমরা উপর থেকে দেখলাম অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটা ঝর্না। অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে ঝর্নাটা গিয়ে পড়েছে পুরাই ঢালু হয়ে যাওয়া পাথরের দেওয়ালের উপর। দেখতে অনেক সুন্দর লাগছিলো ঝর্নাটা। কিন্তু সেই ঝর্ণাটা কাছ থেকে দেখা আমাদের আর কপালে ছিলো না। সেই মূহুর্তেই খবর পেলাম আমাদের একটা চান্দের গাড়ি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়েছে। ভয়ানক এই কথা শুনে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি যেই পথে নেমেছি সেই পথে উঠতে শুরু করলাম। পরিশ্রমের ঠ্যালায় জিহ্বা বের হয়ে গেল। তারপরও যথাসাধ্য পা চালিয়ে উপরে উঠে এলাম। এসে দেখলাম খবর সত্যি। একটা গাড়ির হেল্পার মাতবরি করে গাড়ি পার্ক করতে গিয়েছিলো। কিন্তু পাহাড়ের ঢালে সে কন্ট্রোল রাখতে পারে নাই। গাড়ি ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে আর উনি লাফ দিয়ে বের হয়ে গেছেন। দেখলাম লোকটা শুয়ে আছে। হাতে, গলায় আর কোমরে মারাত্মক চোট। ব্যাথার চোটে মুখটা লাল হয়ে গেছে। আশেপাশের লোকজন উৎসাহী হয়ে দেখতে আসছে গাড়িটা। উপজাতি কয়েকজনকে দেখলাম তরতর করে পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নেমে যেতে। শেষমেশ আমরা আর কোন অপশন না পেয়ে এক গাড়িতেই সবাই চাপাচাপি করে ফেরার পথ ধরি।

সার্কিট হাউজে ফিরে এসে দেখি কারেন্ট নাই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা বসে ছিলাম। বারান্দায় বের হয়ে দেখি আকাশে ফানুস ওড়ানো হচ্ছে। আজ প্রবারনা পূর্ণিমা। কাছেই একটা মন্দির থেকে ওড়ানো হচ্ছে রঙ্গিন ফানুস। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে লাগলাম বিশাল চাঁদ, হাজারও ঝিকিমিকি তারার সাথে ফানুসের ওড়াওড়ি। সাড়ে সাতটার দিকে খেতে গেলাম সার্কিট হাউজের পাশেই বিসমিল্লাহ হোটেলে। অর্ডার দিলাম নান আর সবজি। শেষমেশ চা খেয়ে বের হলাম সেই দোকান থেকে। আমি, লিয়া, মারজিয়া, সৃষ্টি, সুমাইয়া, সুহাইলা মিলে অটো ভাড়া করে রওয়ানা দিলাম বাজারে। উদ্দেশ্য কিছু ফলমূল কেনা। হাতে সময় খুব অল্প। এরই মধ্যে তাড়াহুড়া করে আমরা সবাই মিলে তেঁতুল, কমলা, ডাব, কলা, পেপে, জাম্বুরা কিনলাম। সবই দরাদরি করে কিনতে হলো। সময় থাকলে ঠান্ডা মাথায় কেনা যেত। কিন্তু নয়টায় বাস ছাড়বে, কি আর করা!

তাড়াহুড়া করে সার্কিট হাউসে পৌঁছে লোডশেডিঙের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে ব্যাগটা নিয়েই আবার নেমে পড়ি। আবার অটোতে উঠে শাপলা চত্বরের কাছে বাস কাউন্টারে নেমে পড়ি। ঠিকঠাক সময় মতই বাস ছেড়ে দেয়। এই বাসটা আগের বাসের মতন লক্কর ঝক্কর না। জার্নিটা ভালোই হবে এই আশায় ভালো করে শাল জড়িয়ে ঘুম দেওয়ার প্রিপারেশন নেই। মনে মনে বলি ‘বিদায় খাগড়াছড়ি’।