The Mighty INDIA CALLING: ‘সর্দারজী’ র দেশে দ্বিমিকবাসী (পর্ব ৮)

আমার ঘুম ভাঙল ঘাড় ব্যাথায়। বাসের সিটে হেলান দিয়ে থাকায় প্রচন্ড ঘাড় ব্যাথা হতে লাগলো। চোখ মেলে দেখলাম আমরা পাঞ্জাব পৌঁছে গেছি। তখন মাত্র সকাল হয়েছে। কুয়াশা কেটে চকচকে সূর্যের আলো ফালি ফালি করে বের হচ্ছে। রাস্তাঘাটে মানুষজন নাই। চারপাশে ঝকঝকে রাস্তাঘাট, একটু পর পর পার্ক, সবুজ গাছপালা- সব মিলিয়ে অত্যন্ত রিফ্রেশিং পরিবেশ। আমার ইচ্ছা হলো বাইরে গিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেই। কিন্তু জমানো ঠান্ডার ভয়ে জানালাটাও খুলতে পারলাম না। আমাদের বাস এসে থামলো পাঞ্জাব আর হরিয়ানার বর্ডারের কাছাকাছি জায়গায়। আমাদের ছেলেপেলে হোটেল মিডটাউন নামের এক হোটেলে কথা বার্তা বলে সব ঠিক করলো। আমরা নেমে পড়লাম।

এবার আমরা চারজন একসাথে। বাস থেকে নেমেই মজুমদার ছুটলো রুম দখল করতে আর আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম লাগেজের অপেক্ষায়। সবার আগে আমার লাগেজ নামিয়ে দিলো বাসের পিছন থেকে। আমি ওদের রেখে লাগেজ নিয়ে রওয়ানা দিলাম। মজুমদার বললো ও তিন তলায় রুম ঠিক করেছে। অনেকেই রুম পায় নাই। ১০টা বাজলেই কয়েকটা রুম খালি হবে তখন সবাইকে রুম দেওয়া হবে। আপাতত মেয়েদের জন্য তিনটা রুম দেওয়া হয়েছে। তারই একটা রুম আমাদের। আমি আমার সুটকেস অমানুষিক কষ্ট করে সিড়ি দিয়ে টেনে টেনে তিনতলায় তুললাম। ততক্ষনে রুবাইদা আর মৌলি মজুমদারের লাগেজ টেনে টেনে নিয়ে আসলো। সবাই মিলে একে অন্যকে সাহায্য করে মাল পত্র সিড়ি দিয়ে তুলতে লাগলাম।

রুম দেখে আমাদের খুব পছন্দ হলো। অনেক বড় রুম, বিশাল খাট, এটাচড বারান্দা তবে এটা পাশের আরও দুইটা রুমের সাথে কানেক্টেড। বারান্দায় দাঁড়ালে নিচে সবুজ জমি দেখা যায় সেখানে একটা গরু নিবিষ্ট মনে ঘাস চিবাচ্ছে। আমি কিছুক্ষনের জন্য বারান্দায় কড়া রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ আরাম লাগলো। সবচেয়ে অদ্ভূত হল বাথরুমটা। এত বড় বাথরুম আমি আর কোনও হোটেলে দেখি নাই। মনে হলো যেন ওখানে খাট পেতে ঘুমানো যাবে। যথারীতি বদনা নাই। তবে রুবাইদা এবার ওর সাদা বদনাটা বের করে দিলো। গরম পানির ব্যবস্থা পেয়ে আমরা লাইন ধরে গোসলে ঢুকলাম। গোসল করতে গিয়ে টের পেলাম বালতি আছে কিন্তু কোন মগ নাই। রুম সার্ভিস তখন খুবই ব্যাস্ত আমাদের সবাইকে রুমের ব্যবস্থা করে দিতে, ওখানে জানালে মগ পেতে বেশ দেরি হবে। চট করে আমরা আমাদের রুমের পানির জগটাকেই মগ বানিয়ে গোসল করা শুরু করে দিলাম।

যারা রুম পায় নাই তারা আমাদের রুমে মালপত্র নিয়ে বসে থাকলো। তারপর এক জন একজন করে ওরা রুম পেয়ে পেয়ে বের হয়ে গেলো। আমি দেখতে পেলাম আমাদের বারান্দার সাথে এটাচড রুম দুটা আমাদের মেয়েরাই পেয়েছে। সেই রুমগুলাও খুবই সুন্দর। বারান্দার রোদে ভেজা গামছা মেলে দিয়ে আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। ভেজা চুল শুকানোর জন্য মৌলির হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমাকে বেশ সুন্দর আর লম্বা লাগছে। মন ভালো হয়ে গেলো। একটু পরেই টের পেলাম আয়নাটাতে সবাইকেই চিকন আর লম্বা লাগে। সবাই খুশি খুশি মনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নানাভাবে দেখতে লাগলো।

রুমের সামনে রিজভীর সাথে দেখা। ওকে ধন্যবাদ দিলাম এত সুন্দর একটা হোটেল ঠিক করে দেওয়ার জন্য। ও বললো বাইরে থেকে এখানকার বিল্ডিংগুলো দেখে আহামরি কিছু মনে হয় না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে হোটেলগুলো অনেক সুন্দর। রুমের বাইরে অনেক খোলামেলা স্পেস, লাইট ওয়েল দিয়ে সরাসরি রোদ এসে পড়ে – এসব দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।

সবার গোসল শেষে আমরা যখন নাস্তা করতে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন প্রথম জানলাম খবরটা- আমাদের এখনই এই হোটেল ছেড়ে দিতে হবে। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। ব্যাপার কি? কেন ছেড়ে দিতে হবে এই হোটেল? আসল ঘটনা জানা গেল ইশতিয়াকের কাছে। আমাদের কমিটিকে দামদর সব ঠিকঠাক করার করার পর হোটেল কর্তৃপক্ষ আইডি কার্ড জমা দিতে বলে। ওরা আমাদের পাসপোর্ট জমা দিলে লোকজন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ‘আপ্লোগ ইন্ডিয়ান নেহি হো? আমরা বাংলাদেশি জানার পর তারা খুব লজ্জিত হয়ে জানায় সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এই হোটেলের বিদেশি অতিথি রাখার অনুমতি নাই। ওরাই আমাদের আরেকটা হোটেল ঠিক করে দিবে কিন্তু আমরা এই হোটেলে থাকতে পারবো না। ওদের আর কি দোষ, কমিটির কমিউনিকেশন মেম্বাররা এত ভালো হিন্দিতে কথা বলেছিলো যে ওরা ধরতেই পারে নাই যে আমরা বিদেশি। ওরা নিজেদের ভুল স্বীকার করে খুব অনুরোধ করে আমাদের চলে যাওয়ার জন্য।

কি আর করা- আমরা যা যা মালপত্র বের করেছিলাম সব আবার ঢুকিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে সেই তিনতলার সিড়ি দিয়ে আবার টেনে টেনে ব্যাগ নামাতে লাগলাম। তারপর আবার সেই ব্যাগ বাসে তুলে আমরা বের হয়ে পড়লাম। সেটাই ছিলো ইন্ডিয়া ট্যুরে আমাদের সবচেয়ে ছোট্ট হোটেল স্টেয়িং।

আগের দিন রাতেও ডিনার বলতে যা বলা হয় সেইটা ঠিকমত হয় নাই। সকালেও কোন খাওয়া হল না। সেই অবস্থাতেই বাসে করে আমরা চন্ডীগড় ঢুকে গেলাম। চন্ডীগড় লে কর্বুসিয়েরের ডিজাইন করা অত্যন্ত বড়লোকদের শহর। রাস্তা গুলো চওড়া, চকচকে পরিষ্কার আর একদম সোজা ছক মেনে চলে। একটু পর পর একই রকম চৌ রাস্তার মোড় বা ওদের ভাষায় মার্গ এসে পড়ে যেগুলোতে সবুজ সাইনেজের মাধ্যমে ডিরেকশন দেখানো আছে।  এখন বেলা হয়ে যাওয়ায় রাস্তাঘাটে মানুষজন দেখা যাচ্ছে। দাড়িওয়ালা, পাগড়ি পরা শিখদের দেখতে খুব ভালো লাগছিলো। আর মহিলাগুলো সব সালোয়ার কামিজ পরে, বড় বড় বেনি করে এক কালারের সোয়েটার পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে- ঠিক যেমনটা সিনেমায় দেখে থাকি। চন্ডীগড়ের আরেকটা লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে বাইক, মোটরসাইকেল আর সাইকেল। কি ছেলেরা, কি মেয়েরা- সবার কাছেই যেন দুইচাকার বাহনগুলো জনপ্রিয়। বাইক আর মোটরসাইকেলের পাশাপাশি রাস্তাঘাটে প্রচুর মানুষ সাইকেল চালাচ্ছে। এদের মধ্যে হাফ প্যান্ট পরা মোটা স্কুল ইউনিফর্ম পরা বাচ্চা ছেলেটা যেমন আছে তেমনি সাদা চুলগুলো বেনিতে গুঁজে সালোয়ার কামিজ আর কেডস পরা দাদীমাও আছেন। আমি হাঁ করে সব দেখতে লাগলাম। আরেকটা জিনিস লক্ষ করলাম এখানকার গাড়ির নম্বর প্লেট শুরু হয় –CHO দিয়ে।

r
ছবির মতন সাজানো চন্ডিগড় শহরের  ঝকঝকে রাস্তা ( কৃতজ্ঞতায় আরমিন রহমান মৌলি)

আমরা সেক্টর ৪৫ এ এসে থামলাম। এখানেই ঠিক করে দেওয়া হয়েছে আমাদের হোটেল যার নাম গোল্ডেন প্যারাডাইস। হোটেলটা বাইরে থেকে দেখে আমরা দমে গেলাম। রাস্তা থেকেই দেখা যায়, টানা বারান্দা দিয়ে এক সারি রুম। আমাদের দেশে অনেকটা কমলাপুর রেলস্টেশনের আশেপাশে যেরকম হোটেল দেখা যায় সেরকম আর কি। ঢুকতে হয় একটা চিপা গেট দিয়ে। তারপর আড়াই থেকে তিনফুট চওড়া একটা চিপা খাড়া খাড়া স্টেপ ওয়ালা সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়। এবারও আমি আর মজুমদার দৌড়ঝাপ করে সেই তিন তলাতেই রুম ঠিক করলাম। আমাদের রুমটা একেবারে রাস্তার পাশে, বারান্দার শেষ প্রান্তে। ছোট্ট রুমে একটা খাট, দুইটা গদিওয়ালা চেয়ার আর একটা ছোট্ট টেবিল আছে। দেওয়ালে টিভি ঝুলানো, তার সাথে আবার দুইটা রিমোট। বাথরুমটা গিয়ে দেখলাম, অবস্থা মোটামুটি। বালতি, মগ সবই আছে, সাথে আবার ছোট্ট একটা মোড়া। ফ্লোরে সাদা কালো হিজিবিজি প্যাটার্নের পাথর। এতে একটা সুবিধা আছে ফ্লোর ময়লা হলেও টের পাওয়া যাবে না। আমরা আগের হোটেলে গোসল করে আসার কারনে বেশ খুশি ছিলাম। এখন এই বাথরুমে গোসল করতে হবে না ভেবেই আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলাম।

রুমে সেট হয়েই আমরা খেতে বের হলাম। হোটেলের নিচের রাস্তাটা কেমন জানি মরা মরা। নেটে সার্চ দিয়ে কাছেই ‘খুশি ধাবা’ নামের এক খাওয়ার দোকানে গেলাম। ছোট দোকানটাতে তেমন কিছুই খাওয়ার নাই। অনেক কষ্টে একটা থালি নিলাম ২৫ রুপি দিয়ে। এতে আছে ৬টা পোড়া রুটি, সয়া মাংসের ঝোল আর ডাল। সালাদ হিসেবে আছে মুলা কুচি। খাবারের কোন টেস্ট নাই। অনেক ঘন্টা কিছুই খাওয়া হয় নাই দেখে জোর করেই সবগুলা পোড়া রুটি খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষে আবার হোটেলে ফেরত আসলাম। আশেপাশের রুমে খোঁজ খবর নিয়ে দেখলাম সবাই শপিং করার জায়গায় যেতে চায়- সেক্টর ২২ আর সেক্টর ১৭। আমি আর রুবাইদাও চিন্তা ভাবনা করে বের হয়ে পড়লাম।

হোটেলের সামনের রাস্তাতেই অটো পার্ক করে বসে ছিলো। আমি রুবাইদা আরও কয়েক জনের সাথে অটো ভাড়া করে উঠে পড়লাম। সেক্টর ২২ যেতে পার হেড খরচ পড়লো ২০ রুপি। একই রকম সোজা রাস্তা আর সবুজ চৌরাস্তা পার হয়ে হয়ে আমরা যখন সেক্টর ২২ পৌঁছালাম ততক্ষনে আমার মনে হলো আমরা যে জায়গাটাতে থাকি সেটা বোধহয় তুলনামূলক লো ক্লাস এরিয়া। যাই হোক অটো থেকে নেমে আমরা যে জায়গাটায় আসলাম সেটাকে অনেকটা ঢাকা নিউমার্কেটের মতই মনে হলো। তবে আমাদের নিউ মার্কেট বাউন্ডারির ভেতর আর এটাতে ঠিক বাউন্ডারি নাই। কেমন যেন লম্বাটে টাইপ অনেক বড় জায়গা জুড়ে আলাদা আলাদা মার্কেট।

সামনেই হোটেল-রেস্টুরেন্ট। তারপর শুকনা খাবার যেমন বাদাম, খেজুর, বিস্কুট, চানাচুর, চিপস এইসবের দোকান। পাশাপাশি জামাকাপড়, ব্যাগ, জুতা সব কিছুরই দোকান ছিলো। একটু পর একটা চত্তর। সেখানে হকাররা অনেক টুকিটাকি জিনিস নিয়ে বসে আছে। তারপর শুরু হয় শীতের কাপড়ের দোকান। শীতকালে পাঞ্জাবী ছেলেরা কি মেয়েরা, সবাই এক ধরনের চকচকে পলিথিন পলিথিন টাইপের উজ্জ্বল রঙয়ের জ্যাকেট পরে। প্রায় সব দোকানেই দেখলাম ভেতরে বাইরে সবখানেই সারি সারি লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনী সব রঙের হাতা ওয়ালা বা হাতা ছাড়া জ্যাকেট ঝুলিয়ে রেখেছে। দাম যাচাই করে বুঝলাম ২০০ রুপিতে এগুলো কিনতে পাওয়া যাবে। ভেতরের দিকের দোকানে শীতের কাপড়, ঝকমকে জামাকাপড়, জুয়েলারি সবই আছে। দাম মোটামুটি কম। রুবাইদা সুন্দর হাতের কাজ করা ফুলখাড়ি ওড়না কিনলো ৭০০ রুপি দিয়ে।

আমাদের ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি ১১০ রুপি দিয়ে চানাচুরের প্যাকেট কিনলাম আর রুবাইদা খেজুরের প্যাকেট কিনলো। তারপর  রাস্তা পার হয়ে একটু দামী দোকানপাটওয়ালা জায়গায় যাই। আমরা মনের সুখে চওড়া ফুটপাথ দিয়ে ঘুরতে থাকি আর দুনিয়ার গল্প করতে থাকি। এর মধ্যে দেখলাম এক জুয়েলারির দোকান থেকে মৌলি সস্তায় আনেকগুলো কাজল কিনে ব্যাগ ফ্রি পেল। দেখতে দেখতে সেই জুয়েলারির দোকানে ঠাসাঠাসি ভিড় হয়ে গেল। আমরা হাঁটতে হাঁটতে দেখতে লাগলাম, পাঞ্জাবের পাঞ্জাবী, শেরওয়ানী, কনের পোশাক, পাগড়ি, কোটি, সিল্কের লুঙ্গি, স্টেশনারি দোকানসহ আরও অনেককিছু। রাস্তার পাশেই ঠেলাগাড়িতে করে কমলার জুস বিক্রি হচ্ছে। ইয়া বড় বড় কমলা, ব্লেন্ডারে করে জুস বানিয়ে দিচ্ছে। মায়িশা খেয়ে খুবই প্রশংসা করলো। ওদের সাথে দেখা হওয়ার পর জানলাম ওরা সেক্টর ১৭ যাবে। আমরা দুইজন মনে করেছিলাম এটাই সেক্টর ১৭। কিন্তু বুঝলাম এটা সেক্টর ২২ এর মধ্যেই।

তারপর আমরা ঐশি, নোভা, বাঁধনদের সাথে সাথে অটো ভাড়া করে সেক্টর ১৭তে যাই। পার হেড ভাড়া পরে ১৫ রুপি। সেক্টর ১৭ অনেক পশ। দামি দামি জিনিসের দোকানপাট সব, আবার সেগুলোতে সেল চলছে। আলাদা আলাদা অটোতে আসায় আমি আর রুবাইদা আলাদা হয়ে যাই। তারপর ব্র্যান্ডের দোকান ঘুরতে ঘুরতে আবার একত্র হই। আমাদের ঘুরতে খুবই ভালো লাগে। ঝলমলে সব দোকানপাট, সামনে অনেক চওড়া ফুটপাথ, তারপর এক লেন স্ট্রিট লাইটিং আর সিটিংয়ের জন্য, তারপরে রাস্তা। সবখানে ফর্সা ফর্সা মানুষজন, গল্প করছে, আড্ডা দিচ্ছে। ওদের ভাষাটা কেমন যেন আন্তরিক।

আস্তে আস্তে দোকান পাট বন্ধ হতে থাকে। মানুষজন কমতে থাকে রাস্তা থেকে। আমরা একটা ঝলমলে খাবার দোকানের সামনে দাঁড়াই। আমি আর রুবাইদা একটা ভেজ চাওমিন অর্ডার দেই ১০০ রুপি দিয়ে। খাবারের টেবিলগুলো দোকানের বাইরে, খোলা আকাশের নিচে। অনেক ভিড় থাকায় আমরা ঠিকমত দাড়াতে পারছিলাম না। আমাদেরকে পাশেই একটা সিনেমা হলের ফুড কোর্টে বসতে বলে। আমরা সেখানে গিয়ে দেখি আর কেউ নাই। শুধু আমরা আমরাই। আমরা হৈচৈ করে খেতে থাকি। ঐশির মোবাইলে সেলফিও তোলা হয়। খাবার বেশ মজা ছিলো আর পরিমানে এত বেশি ছিলো যে আমাকে আর রুবাইদাকে পুরোটা শেষ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়।

খেয়েদেয়ে আমরা আবার বের হয়ে অটো ঠিক করতে থাকি। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা ফাঁকা, কিন্তু ভয় লাগে না। শহরটাকে কেন যেন নিরাপদ মনে হয়। এইবার অটো ভাড়া পরে পার হেড ২০ রুপি করে। আমরা একই রকম রাস্তা দিয়ে ছুটতে থাকি। হঠাৎ একটা সার্কাসের প্যান্ডেল চোখে পড়ে। অনেক বড় সার্কাস। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকি।

হোটেলে ফিরে শুনি অনেকেই হোটেলের পাশে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে গেছে। আমার আর বের হওয়ার ইচ্ছা হলো না। কে জানি এসে খবর দিলো রাত ১২টার সময় শান্তর বার্থ ডে কেক কাটা হবে। আমরা সবাই গেলাম। ছোট্ট রুমের মধ্যে গাদাগাদি করে শান্তকে উইশ করা হলো। তারপর লিয়ার আনা কেকটাকে কেটে খাওয়া হলো। এর মধ্যে জাফর কেকের টুকরা জুবায়েরের গায়ে ফেলে দিলো। যাই হোক সবাই শেষমেষ রুমে ফিরে যাই।

কমিটির লোকজন রুমে এসে খবর দিয়ে যায় যে আগামী কাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত সবগুলো রুম ঠিক করা আছে। ১২টার পর ছেলেদের জন্য একটা আর মেয়েদের জন্য একটা রুম থাকবে। তাই মালপত্র সব গুছিয়ে ১২টার আগেই ঐ রুম দুইটায় রেখে তালা মেরে দিতে হবে। আবার আমরা আমাদের সব মালপত্র গুছিয়ে নিলাম যাতে সকালে সমস্যা না হয়। ঘুমানোর জন্য কম্বলের নিচে ঢোকার সময় মনে হলো আমার পা দুইটা বেশ ফুলে গেছে। কি আর করা, ফোলা পা নিয়েই সেকেন্ডের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।

The Mighty INDIA CALLING: বিশ্রী ঠান্ডার দিনে ‘গোয়েল’ এর সাথে পরিচয় (পর্ব ৭)

সকাল বেলা যখন হিমি আর লিয়ার ফোন বেজে ওঠে, তখনো আমি কানে কবুতরের আওয়াজ শুনছিলাম। আমরা কম্বলের তলা থেকে মাথা বের করে দেখলাম বাইরে অন্ধকার। ঘড়িতে দেখি ৯ টা বাজে। আমরা ধড়মড় করে উঠে বসি। ৯ টার সময়ই তো আমাদের বের হওয়ার কথা। তাড়াহুড়া করে আমরা রেডি হই। নাশতা করার সময় নাই, আবার গত রাতেও কিছু খাই নাই। কোন উপায় না দেখে দেশ থেকে নিয়ে আসা কেকগুলো খেয়ে ফেললাম। কি পরে বাইরে যাবো সেই চিন্তায় পড়লাম। কারণ এখানকার ওয়েদার খুবই কনফিউজিং। রোদ গায়ে লাগলে গরম, আবার একটু পরেই কনকনে ঠান্ডা। ভেবে চিনতে তিনটা সোয়েটার, কানটুপি, মাফলার, দুইজোড়া হাতমোজা সবই নিয়ে বের হলাম। যখন যেটা লাগবে সেটা পরা যাবে।

আমরা নিচে নেমে বসে রইলাম। এমন সময় এক লোক হাতুড়ি নিয়ে হাজির হলো তমার লাগেজের তালা ভাঙ্গার জন্য। সেই যে হাওড়া স্টেশনে ওর পার্স চুরি গেছে, তারপর থেকে ও আর ওর ব্যাগ খুলতে পারে নাই। হোটেল থেকে এখন একজনকে পাঠিয়েছে সেই তালা ভাঙ্গার জন্য। আমি আর তমা গেলাম একসাথে ওদের রুমে। লোকটা তালাটা ভাঙতেই আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম ‘আলহামদুলিল্লাহ’। উনি অবাক হয়ে হিন্দিতে বলে, ‘আপনি মুসলমান?’। আমার উত্তর শুনে উনি জানায় উনিও মুসলমান। জানতে চায় আমাদের দেশের সবাই মুসলমান কিনা, যারা এখানে এসেছি তারা সবাই মুসলমান কিনা। তমা শেষে উনাকে বখশিশ দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় করে।

১১টার দিকে আমরা হোটেল থেকে বের হয়েই টের পেলাম ওয়েদার মোটেও সুবিধা জনক নয়। আকাশ মেঘলা আর কনকনে ঠান্ডা। আমরা গলি দিয়ে বের হয়ে প্রথম বারের মতন আমাদের ভাড়া করা বাসটা দেখতে পেলাম। ক্যাটক্যাটে কমলা রঙের বাস, গায়ে লিখা ‘গোয়েল টুরিস্ট’। গোয়েলের সাথে সেই আমাদের প্রথম দেখা। আগামী ২১ দিনের জন্য বাসটা ভাড়া করা হয়েছে। এই ২১ দিনে আমাদের একটা বড় সময় এই বাসের ভিতর কাটবে। এইসব ভাবতে ভাবতে বাসের ভিতর উঠে বসলাম। দরজা দিয়ে ঢুকে ইঞ্জিন আর ড্রাইভারের সিটটা পার হবার পর আরেকটা দরজা, তারপর আমাদের বসার জায়গা। বাসটার ভেতরের ইন্টেরিওর কেমন জানি বিয়ে বাড়ির মতন। জানালায় লাল রঙের ঝালর লাগানো, সিটগুলো উজ্জ্বল লাল- বেশির ভাগেরই প্যাকেট খোলা হয় নাই, আর সামনে খুবই অদ্ভূত এক পেইন্টিং টানানো। আমরা সবাই কোন মতে বসে পড়লাম। কয়েকটা সিট খালি। দেখা গেল সুহাইলাসহ আরও কয়েকজন আসে নাই। ওদের আবার খবর দিয়ে আনা হলো। যাই হোক আমাদের যাত্রা শুরু হলো। প্রথম গন্তব্য কুতুব মিনার।

পথেই আমরা ইন্ডিয়া গেট দেখলাম। যখন কুতুব মিনারে পৌঁছাই তখন চারপাশে ঘন কুয়াশা। কুতুব মিনার আমরা ঠিকমত দেখতেই পারছিলাম না। ১০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে গেট দিয়ে ঢুকেই আমাদের সাথে ০৯ ব্যাচের আপু ভাইয়াদের সাথে দেখা হলো। ওনারা সিমলা মানালি ঘুরে আবার দিল্লী এসেছেন। ওনাদের সাথে হাই হ্যাল্লো করতে করতেই বৃষ্টি শুরু হলো। একে তো ঝাপসা কুয়াশা ছিলোই, তার সাথে বৃষ্টিটা শীতটাকে আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে দিলো। আমরা একটু আশ্রয়ের জন্য ছুটতে লাগলাম এদিক ওদিক। ক্যামেরা স্কার্ফ দিয়ে পেচিয়ে ব্যাগে ভরলাম। কুতুব মিনার তো ঠিকমত দেখা হলোই না বরং মেজাজ খারাপ করে বৃষ্টিটা থামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। এত মানুষের কাছ থেকে সাজেশন নেওয়া হয়েছে, কেউ কোনদিন ছাতা নেওয়ার কথা বলে নাই। পুরা ব্যাচের ৪৬ জনের মধ্যে কারও কাছে ছাতা নাই। আমার বেশ মন খারাপ হলো।একটা বিশাল স্থাপনার নিচে সবাই পোজ মেরে সেলফি তুলতে লাগলো। আমি মেজাজ খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।

দ
বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে কুতুব মিনারের সামনে কয়েকজন দ্বিমিকবাসী ও শূণ্যয় সদস্য (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

খনিক পর যখন মনে হলো বৃষ্টিটা কমে গিয়েছে, তখন আমরা ঝটপট বের হয়ে দৌড় দিলাম। কনকনে ঠান্ডা আমাদের হাড় ভেদ করে ঢুকতে লাগলো। কোন রকম বাসে উঠে আমরা বসলাম। হাত দুইটা বারবার অসাড় হয়ে যাচ্ছিলো, ঠান্ডাকে বকতে বকতে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। আমরা ৩ টার দিকে পৌঁছালাম লোটাস টেম্পলে। কাঁপতে কাঁপতে আমরা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। রাস্তার পাশে হঠাৎ ০৯ এর বাস দেখলাম। আমরা কয়েকজন সেখানে উঠে আপুদের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। আপুরা বললো ওনারা সিমলা, মানালিতেও এই রকম বিশ্রী ঠান্ডা পায় নাই। আমাদের তাড়াতাড়ি করে  দিল্লী থেকেই দুই সেট ইনার কিনে নিতে বললো। আমরা কিছুক্ষন কথা বলে ওনাদের বাস থেকে নেমে হাঁটা দিলাম।

ঝাপসা কুয়াশাময় পরিবেশে লোটাস টেম্পলটা বাইরে থেকে দেখতে বেশ ভালো লাগছিলো। কিন্তু কাছে গিয়ে যখন জানতে পারলাম ভিতরে জুতা খুলে ঢুকতে হবে, তখন আমার মেজাজটা গরম হয়ে গেলো। এই ঠান্ডার মধ্যে জুতা খুললে আমার নির্ঘাত নিউমোনিয়া হয়ে যাবে, তার উপর বৃষ্টি ভেজা রাস্তা- জুতা খোলার তো প্রশ্নই আসে না। আমি পিছু হটলাম। আমার সাথে মৌলিও যোগ দিলো। আমরা আবার হেঁটে হেঁটে বাসের দিকে যেতে লাগলাম। মাঝখানে রাস্তার পাশে পার্ক করা একটা বাসের ইঞ্জিন থেকে গরম ভাপ বের হচ্ছিলো। আমি আর মৌলি বাসের সাথে গা লাগিয়ে খানিক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ আরাম লাগছিলো আমাদের। আমরা হাত আর পিঠ সেক দিয়ে বেশ উষ্ণ করে নিলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে গোয়েলে এসে পৌঁছালাম। পুরো বাসে আমি, মৌলি আর চিং।

অনেক্ষন পরে সবাই যখন ফেরত আসলো তখন সবাই বলতে লাগলো আমরা নাকি মিস করেছি, ভেতরটা অনেক সুন্দর ছিলো, কষ্ট করে ঢুকলেই পারতাম। আমার কোন আফসোস রইলো না- আমি ভাই এত ঠান্ডা সহ্য করতে পারতাম কিনা সন্দেহ। যাই হোক অনেক বেলা হয়ে গেছে কিন্তু কোন খাওয়া হয় নাই। আমরা আবার রওয়ানা দিলাম। এবার যাচ্ছি জামে মসজিদ। বাসেই ডিসিশোন হলো, ঠান্ডা আর বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ইনার আর রেইনকোট কেনা দরকার। ধারে কাছে মার্কেট আছে, মেম বাজার আর পাল্লিকা বাজার। আজকে রাতেই যেকোন একটাতে গিয়ে কেনাকাটা করতে হবে।

জামে মসজিদের কাছাকাছি পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের ৬টা বেজে গেলো। বাস থেকে নেমে রাস্তা ক্রস করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। পাকা রাস্তা পার হয়ে কাঁচা রাস্তা আসলো। সেই রাস্তা নোংরা থেকে নোংরাতর হতে লাগলো। বৃষ্টিতে, কাদায় আর ময়লায় মাখামাখি হয়ে যাওয়া রাস্তায় আমরা অত্যন্ত সাবধানে হাঁটতে লাগলাম। দুইপাশে মুসলমান দোকানপাট দেখা গেলো। জামা কাপড়, তসবি টুপি, জায়নামাজ, রোরখা, আতর, ডেকচি, হাড়ি পাতিল, জুতা স্যান্ডেল – কি নেই সেখানে! এত ময়লা কাদা পার হয়ে জামে মসজিদে আর আমরা কেউ ঢুকলাম না। পাশ দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছি তখনই নাকে কাবাবের গন্ধ লাগলো। দেখলাম সারি সারি খাবারের দোকান। সেখানে বিরিয়ানি আর শিকের মধ্যে গাঁথা ঝলসানো মাংস থেকে ভুরভুর করে সুগন্ধ বের হচ্ছে। জিভে আমাদের পানি চলে আসলো। কত দিন মাংস খাই না!

আমরা কয়েক ভাগ হয়ে একেক দোকানে ঢুকে পড়লাম। অনেকে গেলো ‘করিমস’ হোটেলে। আমি, রুবাইদা, আদিবা আরও কয়েকজন ‘সুবহানাল্লাহ’ নামের এক দোকানে ঢুকে বিফ বিরিয়ানি অর্ডার দিলাম। ওরা বলেই দিলো যে ইন্ডিয়ার বিফ আসলে মহিষ, তারপরও ৫০ রুপিতে বাসমতি চালের বিরিয়ানি খেয়ে ভালোই লাগলো। ওখানে খেয়ে দেয়ে বের হয়েই দারুন এক মিষ্টির দোকান চোখে পড়লো। দোকানের নাম ‘কল্যান সুইটস’। এখানকার মিষ্টির দোকান আমাদের মিষ্টির দোকানের চাইতে আলাদা। দোকানের ভিতর বড় বড় থালার মধ্যে হালুয়া জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। কোনটা বাদামের হালুয়া, কোনটা শাহী হালুয়া। আর সামনের কাঁচের শোকেসে সারি সারি মাটির বড় বড় গ্লাসে লাচ্ছি, বাদাম দুধ সাজানো। অন্য পাশে হরেক রকমের মিষ্টি- লাল মোহন যেটাকে ওরা বলে গুলাব্জামুন, বাদামের বরফি, রঙ বেরঙ্গের মিষ্টি দেখে আমার জিভে পানি চলে আসলো। কিন্তু মাত্রই বিরিয়ানি খেয়ে পেট ভরে রেখেছি, আবার রাতে জার্নিও আছে। তাই খাওয়ার আগে আমরা একেকটা মিষ্টির নাম জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। দোকানের লোকটা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপ কাঁহাসে হো, হায়দ্রাবাদ?’ আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘ বাংলাদেশ’।

দোকানের লোকটা আমাদের ফ্রিতে হালুয়া আর শাহী টুকরা টেস্ট করতে দিলো। দুটোই মজা ছিলো। লিয়া লাচ্ছি খেলো আর তানভীর বাদাম দুধ খেলো। ওদের লাচ্ছি অনেক ঘন, চামচে করে খেতে হয়। দোকান থেকে বের হওয়ার পর তানভীর জানায় বাদাম দুধটা অসম্ভব মজা ছিলো। তানভীরের উপর রাগ লাগলো, আরেকটু আগে বললেই আমি এক গ্লাস খেতে পারতাম। রাত হয়ে গেছে, আমরা ফেরার পথ ধরলাম। সেই ময়লা, নোংরা রাস্তা হেঁটে আমরা আবার বাসে উঠে বসলাম। রাত হয়ে যাওয়ায় সব মার্কেট বন্ধ হয়ে গেছে ভেবে আমরা সরাসরি হোটেলে ফেরত যাই।

হোটেলে গিয়ে শুনতে পারি লিয়া গেছে মার্কেটে। আমি লিয়াকে ফোন দিয়ে বলে দেই আমার জন্য একটা ইনার কিনে আনতে। আমরা ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হতে থাকি। ওদিকে লিয়াও ফেরত আসে। ও ৫৫০ রুপি দিয়ে সুখান্দ কোম্পানির ইনার কিনে আনে। আমার ইনার আমি ট্রায়াল দিয়ে দেখি, বেশ গরম বলেই মনে হয়। এই জিনিস পরে যদি গরম লাগে তাহলে বাসে খুব অশান্তি লাগবে ভেবে আমি ইনারটা না পরেই রেডি হই।

হোটেলের এক্টামাত্র ছোট্ট লিফট দিয়ে মালপত্র নামিয়ে আমরা নিচে ওয়েট করি। রাত ১২টা- ১টার দিকে আমরা মালপত্র নিয়ে বাসে উঠে বসি। সারা বেশ ছটফট করতে লাগলো। ওর ইনার পরে খুব অশান্তি লাগছে। বেচারি খুলতেও পারছে না আবার স্বস্তিও পাচ্ছে না। আমি ব্যাগ থেকে কম্বল বের করে গায়ে দিলাম। কম্বলের নিচে ভাবতে থাকি দিল্লী শহরটা তাড়াতাড়ি ছাড়তে পারলেই বাঁচি। এখানকার মানুষজন ভালো না, আবহাওয়া খুবই অসহ্যকর, রাস্তাঘাট মরা মরা। এই পচাঁ শহরটা থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। এইসব ভাবতে ভাবতে আর বাসের দুলুনিতে ঘুম পেয়ে গেলো। কখনও ভাবি নাই যে বাসে আমি ঘুমাতে পারবো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার দুই চোখ কিছুক্ষনের মধ্যেই গভীর ঘুমে বুজে আসলো।

 

 

 

The Mighty INDIA CALLING: রাজধানী দিল্লীতে পদার্পণ (পর্ব ৬)

সকাল সাড়ে সাতটা কি পৌনে আটটার দিকে উর্মির ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গে। উর্মি বলতে থাকে আমরা নাকি প্রায় চলে এসেছি। আমি অবাক হয়ে যাই। আমাদের দুপুর বেলা দিল্লী পৌঁছানোর কথা আর এখন সকাল বেলাতেই চলে এসেছি –এটা আবার কেমন কথা। মনে হলো ট্রেন বুঝি রাতে উড়ে উড়ে এসেছে। যাই হোক ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে মালপত্র সব গুছিয়ে বসতে বসতে অনেকক্ষণ কেটে গেলো। এর পর দেখলাম নিলয়ের সাথে কানটুপি পরা এক লোক বেশ কথা বলছে ইংরেজীতে। উনি আমরা ৪৬ জন দেড় মাসের জন্য বেড়াতে এসেছি শুনে বেশ পুলকিত হয়েছেন। খানিকক্ষণ পর উর্মি আর চিংয়ের সাথেও নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। আমাদের কথা, বাংলাদেশের কথা, বুয়েটের কথা এইসব নিয়ে আলোচনা হতে লাগলো।

এক পর্যায়ে উনি জিজ্ঞেস করলেন এই দেশ কেমন লাগছে আমাদের কাছে। উর্মি জবাব দিলো ভালো লাগছে, কোলকাতা খুব চমৎকার লেগেছে। উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন আমাদের অভিজ্ঞতা কি ইন্ডিয়া নিয়ে? এই বার আমি দৃষ্টি আকর্ষন করে বললাম, ‘এই যে ব্যাগের সাথে লাগানো যে শিকলগুলো দেখতে পাচ্ছেন, আমি আমার দেশে অনেকভাবে ভ্রমণ করেছি কিন্তু কখনো এই জিনিস কখনো দেখি নাই। শিকল দিয়ে ব্যাগের সাথে তালা মেরে রাখার ব্যাপারটা আমাদের কাছে একেবারেই নতুন’। ভদ্রলোক বেশ লজ্জা পেয়ে গেলেন আমার কথা শুনে। উনি আরও অনেকক্ষণ কথা বললেন। আমার পাশের মহিলাও আমাদের সাথে যোগ দিলো। ঠিক স্টেশনে নামা নিয়ে আমরা টেনশনে ছিলাম। কিন্তু উনারা আমাদের আশস্ত করলেন যে আমাদের ঠিক স্টেশনেই নামিয়ে দিবেন।

কমলাপুরের আগে যেমন এয়ারপোর্ট স্টেশন, নিউ দিল্লীর আগে তেমন গাজিয়াবাদ স্টেশন। গাজিয়াবাদ আসার পরই দেখলাম যাত্রীরা সবাই মালপত্র নিয়ে একদম রেডি। আমরা প্রায় দশটার দিকে নিউ দিল্লী স্টেশনে নামলাম। সবাই একত্র হয়ে আমরা স্টেশনের ভিতরেই মালপত্র নিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগলাম, আর আমাদের কমিটির লোকজন গেলো হোটেল ঠিক করতে। স্টেশনের ভিতরেই ম্যাকডোনাল্ডস থেকে সকালের নাশতা ম্যাক আলু টিক্কি খেলাম ২৮ রুপি দিয়ে। খেয়ে পেট ভরে গেলো। অনেকে আবার চিকেন আর ভেজ র‍্যাপ খেয়েছে ৭০ রুপি দিয়ে।

্দচে
আমাদের নিউ দিল্লী স্টেশনে রেখে কমিটি গেছে হোটেল ঠিক করতে (কৃতজ্ঞতায় সারাহ তাবাসসুম)

অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পর হোটেলের সন্ধান পাওয়া গেলো। হোটেল থেকে আমাদের জন্য মাইক্রোবাস পাঠানো হয়। সেইগুলোতে মালপত্র তুলে আমরা গাদাগাদি করে চড়ে বসি। দিল্লী ব্যস্ত শহর। আশেপাশে অনেক ঘোড়ার গাড়ি। গাড়িতে আমার বেশ গরম লাগে। সব শীতের কাপড় খুলে আমি ব্যাগের উপর মাথে রেখে ঘুমিয়ে পড়ি। দুপুর পৌনে একটায় আমরা পাহাড়্গঞ্জের হোটেল ইউকে তে পৌঁছাই। হোটেল ম্যানেজারের চেহারা অত্যন্ত ধুরন্দর। উনি কুতকুতে চোখ আর পুরুষ্টু গোঁফ নিয়ে কমিটির লোকজনদের সাথে কথা বলতে লাগলেন। হোটেলে আমাদের চারজনের গ্রুপ ভাগ হয়ে যায়। আমি পড়ি লিয়া, হিমি আর সুহাইলার সাথে।

আমাদের রুমটা অনেক উপরে। রুমে  ঢুকেই আমার মনটা ভালো হয়ে যায়। আগেরটার চাইতে অনেক ভালো রুম। বাথরুমটাও বড় এবং সাদা ধবধবে। তবে বাথরুমের দরজা ঠিকমত আটকায় না, আর নো বদনা নো হোস পাইপ। তবে একটা বড়সড় মগ ছিলো। শুনলাম পার হেড নাকি ৬০ রুপি করে খরচ পড়েছে রুম ভাড়ায়। সবার আগে হিমি গোসলে ঢুকলো। বের হয়ে বললো গিজার কাজ করছে না। তারপর সুহাইলা ঢুকলো। ওর গোসল শেষ হলে আমি আর লিয়া রুম সার্ভিসে খবর দিলাম গরম পানির জন্য। একজন লোক এসে জানালো এটাতে বয়লার আছে যেটা রুম সার্ভিসে খবর পেয়ে উনারা অন করে দিয়েছেন। এখন আর গরম পানির কোন অসুবিধা হবে না। লিয়া গোসলে ঢুকে ‘উহ বাবা, পুড়ে গেলাম’ বলে চিৎকার করতে লাগলো। সবশেষে আমি গোসলে ঢুকি। গরম আর ঠান্ডা পানি মিশিয়ে সাবান শ্যাম্পু দিয়ে জম্পেশ একটা গোসল দেই। ভীষন আরাম লাগে আমার।

প্রায় বিকাল পাঁচটার দিকে আমরা লাঞ্চ খেতে যাই। রাস্তায় বের হওয়ার সাথে সাথেই সতর্কবার্তা শুনি দিল্লীতে ব্যাগট্যাগ খুব সাবধানে রাখতে হবে। আমি আমার হ্যান্ডব্যাগটা সামনে ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকি। হোটেলের কাছেই একটা দোকানে আমরা অনেকে একসাথে ঢুকে পড়ি। আমি আর রুবাইদা অর্ডার দেই সাউথ ইন্ডিয়ান থালি। ১১০ রুপির সেই থালিতে ছিলো আলুর ঝোল তরকারি, ছোলারতরকারি, সাম্বার ( টক পাতলা ডাল), ঘন ডাল, টক দই, ভাত, রুটি আর পাঁপড়। অনেকেই দম আলু, মটর পনির, চানা, মশলা দেওয়া ধোসা এই সব অর্ডার দিলো। প্রত্যেকটা খাবারেই প্রচুর মশলা ছিলো আর অনেক টেস্টি ছিলো।

খাওয়া দাওয়া শেষে আমি চট করে হোটেলে গিয়ে মোটা সোয়েটার নিয়ে আসি। সূর্য ডোবার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে ঠান্ডা বাড়তে লাগে। দেখি সবাই দুইটা দলে ভাগ হয়ে ঘুরতে বের হচ্ছে। আমরা রাজীব চক যাবো বলে ঠিক করি। রাস্তায় দাঁড়ানো ট্রাফিককে জিজ্ঞেস করতেই উনি দেখিয়ে দেন ডিরেক্ট বাস। আমরা বাস থামতেই বাসে উঠার জন্য হাঁটা ধরি। কিন্তু পিছন থেকে ডাক আসে। ট্রাফিক আমাদের বলে যে আমাদের জন্য অটোতে করে যাওয়া ভালো হবে। ততক্ষণে মিম, অন্তরা আর তমা বাসে উঠে গেছে। আর এদিকে আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অটো ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু আমাদের কথা শুনে উনারা বেশি বেশি দাম হাঁকায়। এগিয়ে আসেন এক বয়স্ক মহিলা। উনি নিজে এক্টার পর একটা অটো ঠিক করে দেন আমাদের জন্য। উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা দলে দলে রওয়ানা দেই।

ঐশি, মায়িশা, আমি আর নোভা এক অটোতে উঠি। আমাকে নোভা আর মায়িশা পালা করে কোলে নেয়। অটোওয়ালা আমাদের পরিচয় জেনে অনেক্ষণ কথা বলে। জানতে চায় এত ভালো হিন্দি আমরা কোথায় শিখলাম। নোভা সব কৃতিত্ব স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোকে দিয়ে দেয়। ৬০ রুপি ভাড়া দিয়ে খানিক পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম রাজিব চক। বিল্ডিং গুলো আমাদের বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের মতন। সবগুলো বিল্ডিং বৃত্তাকারে সাজানো আর বৃত্তের কেন্দ্রে আছে বিশাল এক ইন্ডিয়ার পতাকা। চারপাশে সব দামি আর অভিজাত দোকান। দোকানের বাইরে শহরের উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরা আড্ডা দিচ্ছে। আমি, নিশাত, রিন্তু, রুবাইদা একসাথে ঘুরলাম। নিশাত বাটা থেকে দুই জোড়া স্যান্ডেল কিনলো। ঝলমলে সব দোকানের চোখ ঝলসানো সব জিনিস দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে গেলাম। ফাস্ট ট্র্যাকের একটা নীল জিন্সের বেল্ট দেওয়া বড় ডায়ালের ঘড়ি আমার অনেক পছন্দ হলো। কিন্তু টাকা সাথে না থাকায় আমি কিনলাম না। পরে কোন এক সময় কিনে নিবো- এই চিন্তা করে ওখান থেকে বের হয়ে আসি। অনেকক্ষণ পর আমরা সবাই একসাথে জড়ো হলাম। এরপর গেলাম ‘ক্যাফে কফি ডে’ র উদ্দেশ্যে।

'ক্যাফে কফি ডে'তে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)
‘ক্যাফে কফি ডে’তে দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় রফিকুল ইসলাম তুষার)

‘ক্যাফে কফি ডে’ ইন্ডিয়ার নামকরা কফি চেইনশপ। আমি আর রুবাইদা সেখানে ছোট্ট কাপে করে বেলজিয়ান চকো শট আর ম্যাংগো মেলডি খেলাম। দাম ৩০ রুপি করে। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা অনেক চিন্তাভাবনা করে কাছের মেট্রো স্টেশনে গেলাম। ৮ রুপি দিয়ে টিকেট কেটে আগের মতই গাদাগাদি করে চড়ে বসলাম মেট্রোতে। কয়েক মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম আমাদের স্টেশনে। মেট্রো থেকে নেমে আমরা চল্লিশ জনের মতন মানুষ উচ্চস্বরে হাহা হিহি করতে করতে হাঁটতে থাকি। আমাদের হৈচৈয়ে বিশাল মেট্রো স্টেশনটা গম গম করে উঠে। আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমরা এভাবেই চেঁচামেচি করতে করতে বের হয়ে আসি স্টেশন থেকে।  এখান থেকেও পাহাড়গঞ্জ একটু দূরে। রাস্তার পাশে ইজি বাইক টাইপের কয়েকটা যান ঠিক করতে চাইলে তারা উলটাপালটা দাম চায়। সবশেষে আমরা হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। লাইন ধরে আমরা হাঁটতে থাকলাম।

রাত প্রায় দশটার সময় দিল্লীর রাস্তা ধরে এতগুলো ছেলেমেয়ের গল্প করতে করতে লাইন ধরে হেঁটে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। তাই অনেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখছিলো। রাতের দিল্লী অদ্ভূত রকমের। স্ট্রিট লাইটিং আর পাহাড়্গঞ্জের সাইনেজ দেখে কেমন জানি লাস ভেগাস শহরের মতন লাগে। এরই মধ্যে বৃষ্টি আর ইশতিয়াকের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। যাইহোক আমরা অবশেষে হোটেলে এসে পৌঁছলাম। অনেকেই রাতের খাবার খেতে গেলো। আমার পেট ভরা ছিলো। আমি আর কিছু খেলাম না। খাওয়ার পানি কিনে হোটেলে ফেরত চলে আসলাম। রুমে ঢুকতে পারলাম না কারণ রুমমেটরা কেউ আসে নাই।

গিয়ে বসলাম নিশাতদের রুমে। দেখি মজুমদার বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে আর রিন্তু নানা রকম নাচ গান করে ওর মন ঠিক করার চেষ্টা করছে। জানতে পারলাম রাত ১২টার সময় আমাদের মিটিং আছে প্রত্যেককে হাজির থাকতেই হবে। অনেকক্ষণ ওদের সাথে গল্প করলাম। তারপর রুমে ফিরে আসলাম। আবার রাত ১২টার সময় শান্তদের রুমে আমরা সবাই জড়ো হলাম।

একটা ডাবল বেডের রুমে আমরা ৪৬ জন মানুষ কেমন করে আঁটলাম সে এক ভারি রহস্য। কিন্তু তারপরেও আমরা ৪৬ জন মানুষ আর আমাদের ৪৬ জোড়া স্যান্ডেল নিয়ে দূর্দান্ত এক মিটিং করলাম। শুভ আর অবনী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কথা বললো। কল্কা মেইলে ঘটে যাওয়া ঝগড়াঝাটি, কেন আমরা একসাথে সিট পেলাম না, আর এই নিয়ে নানা গুজব – এই সব কিছু নিয়ে দৃঢ় বক্তব্য দিলো অবনী। একটা বাইরের দেশে এসে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত এই টাইপের কথা বার্তাও হলো। শুভ জানালো আজকে আমরা যখন ঘুরতে বের হয়েছি তখন কমিটির লোকজন আগামী ২১ দিনের জন্য একটা বাস ঠিক করতে যায়। ওরা ৪৫ সিটের একটা বাস পেয়েছে যেটার পিছনের ৫ জনের জায়গায় ৬ জন বসতে হবে। আগের বার রুবাইদা একা পুরা জার্নিতে কষ্ট করেছে। এইবার সবাইকে মিলে মিশে কষ্ট করতে হবে। ওর কথায় আমরা সবাই সমর্থন জানালাম। ও আরও ব্যাখ্যা দিলো, এতদিন আমরা সবাই আলাদা আলাদা ঘুরেছি, এখন থেকে আমরা বাসে করে ঘুরবো- আক্ষরিক অর্থে আসল ট্যুর শুরু হবে এখন থেকে। আমরা আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠি। তারপর জুবায়ের রাস্তাঘাটে সবার সাথে সহনশীল আচরন করার কথা বলে। কারণ থানা পুলিশ ঝামেলা হলে কমিটি কোন দায়িত্ব নিবে না জানিয়ে দেয়। আমরা তাতেও খুশিতে সমর্থন জানাই। কিছুক্ষণ পর আশেপাশে রুম থেকে কমপ্লেইন আসতে থাকে। আমরা দ্রুত আমাদের মিটিং শেষ করে যার যার রুমে চলে যাই।

রাতের বেলা সীমান্ত হিমিকে ফোন দিয়ে জানায় যাতে আমরা ভালো করে দরজা বন্ধ করে ঘুমাই। কারণ হোটেলে নাকি উলটা পালটা অদ্ভূত লোকজন আছে। আমরা সব রকম ব্যবস্থা এনশিওর করে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে যাই। রুমের জানালার পাশেই মনে হয় কবুতরের খোঁয়াড়, সেখান থেকে ফরফর করে কবুতরের শব্দ আসতে লাগলো।

The Mighty INDIA TOUR: কোলকাতা টু দিল্লী বাই ‘কলকা মেল’ (পর্ব ৫)

আমার পাশের চেয়ারে সম্ভবত লিয়া বসেছিলো। লিয়ার কম্বলটায় ভাগ বসিয়ে সারা রাত এপাশ ওপাশ করলাম। এক পর্যায়ে কে জানি বললো সামনে নিচে শুয়ে আছে এক মহিলা, তার আচরণ সন্দেহজনক। মহিলাকে নজরে রাখা দরকার। সবাই পালাক্রমে মহিলার উপর চোখ রাখতে লাগলো। অবনীকে দেখলাম চেয়ার ছেড়ে উঠে নিচে শাল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা অপরিচিত মহিলাদের মাঝে ঘুমিয়ে পড়তে। অবনীর এই স্বভাবটা ভালো, যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়তে পারে।

প্রচন্ড ঠান্ডায় আমরা জমে যাচ্ছিলাম। মোটা সোয়েটার, কানটুপি, কম্বল কিছুতেই শীত মানছিলো না। আমি লাগেজ খুলে ওভারকোট বের করে পড়ে নিলাম। সাড়ে পাঁচটা থেকেই সবাই আস্তে আস্তে উঠতে লাগলো। ফ্রেশ টেশ হয়ে আমরা সবকিছু গুছিয়ে রাখলাম। অবনীও ঘুম থেকে উঠলো। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম অবনী যাদের সাথে ঘুমিয়েছে তারা হিজড়া। তবে এখানকার হিজড়ারা মোটেও ভীতিকর কিছু নয়। তারাও ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে লাগলো।

৬টার দিকে আমরা আবার নিচে নেমে জন আহারে নাস্তা খেতে গেলাম। অর্ডার দিলাম ২৫ রুপির ভেজ কাটলেট আর বাটার পাউরুটি। ভেজ কাটলেটটা অদ্ভুত লাল রঙের, খেতে ভালো না। তাড়াতাড়ি করে খেয়ে আমরা উপরে উঠে লাগেজ নামাতে লাগলাম। একটা মাত্র লিফট। সবাই দৌড়াদৌড়ি করে নামতে লাগলো। সাড়ে ছয়টার সময় আমরা নেমে দৌড় দিলাম ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু কোন ট্রেন আসে নাই দেখে আমরা ইতস্তত দাঁড়িয়ে রইলাম।

এত মানুষের জটলা দেখে স্টেশনের কয়েকজন গার্ড টাইপের লোক এগিয়ে আসলো। শুভ তখন আমাদের টিকেট দেখালো। উনারা বললো ট্রেন অত্যন্ত কম সময়ের জন্য থামবে। বগি নম্বর দেখে এক্ষুনি আমাদের দৌড়ে প্ল্যাটফর্মের যার যার বগি নম্বর লিখা জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে থাকা দরকার। না হলে উঠার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিবে। শুনে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। জুবায়ের, শুভ চিৎকার করে আমাদের সিট নম্বর আর বগি নম্বর বলতে লাগলো। আমরা একেকজন একেক বগিতে পড়েছি। সবার চেহারা রক্তশূন্য হয়ে পড়লো। অনেকেই বগি নম্বর জেনে দৌড়াতে লাগলো। আমার বগি নম্বর এস থ্রি আর সিট নম্বর ৬৭। শুনে আমি পাগলের মত লাগেজ নিয়ে দৌড়াতে লাগলাম। এর মধ্যে ট্রেন চলে আসলো। পিঠে ব্যাকপ্যাক, কাঁধে হ্যান্ড ব্যাগ আর হাতে ট্রলি এই নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় দেখলাম বগি নম্বর এস ওয়ান, বগি নম্বর এস টু- কিন্তু তারপর বগি নম্বর এ ওয়ান! এরপর এগিয়ে দেখলাম বগি এ টু। মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো আমার। এখন আবার আমাকে এ বি সি ডি শুরু করে এস পর্যন্ত দৌড়াতে হবে? তার মানে আমি নিশ্চয়ই ট্রেন মিস করবো। আমার মাথায় কি ঘটে গেল আমি জানি না। আবার দৌড় শুরু করলাম। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ানোর এক পর্যায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আমার আশেপাশে পরিচিত কেউ নাই। কি করবো এখন? একে তো বগি খুঁজে পাচ্ছি না, তার উপর হাতে কোন টিকেট নাই। ট্রেনটাও যে কোন সময় ছেড়ে দিবে। কি হবে আমার?

হঠাৎ তানভীরকে দেখলাম ওর সুটকেসটা নিয়ে দৌড়াতে। পরিচিত একজনকে পেয়ে আমি আবার দৌড়াতে শুরু করলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় তানভীর ওর বগি পেয়ে গেলো। তারও কয়েকটা বগি পার হয়ে আমি আমার কাংখিত এস থ্রি লিখা বগি খুঁজে পেলাম। কোনমতে ট্রলিটা টেনে বগিতে উঠলাম। বেশি খুঁজতে হলো না, একটা খোপ পার হয়েই ৬৭ নম্বর সিট খুঁজে পেলাম। আমি তখনও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। এর মধ্যে নিলয়, উর্মি আর চিং হাপাতে হাপাতে লাগেজ টেনে টেনে আমার খোপের মধ্যে আসলো।

আমরা দ্রুত আমাদের লাগেজগুলা সিটের নিচে রেখে ভালো করে তালা মারতে লাগলাম। একটু পর আবিষ্কার করলাম আমরা চারজন ছাড়াও আরও চারজনের সিট আছে এই খোপের মধ্যে, তারা যেহেতু আমাদের কেউ না- অবশ্যই তারা ‘বিদেশি’ মানুষ। চারজন ‘বিদেশি’ মানুষের সাথে একই খোপে আগামী প্রায় দেড় দিন কাটাতে হবে ভাবতেই আমাদের মেজাজ বিগড়ে গেলো। উর্মি মারাত্মক টেনশনে পড়ে গেলো। ও এক্সট্রা প্রটেকশন স্বরূপ আরও শিকল তালা কিনে ওর লাগেজে জড়াতে লাগলো। আর আমাদের এক খোপ পাশেই ট্রেনের ক্লিনার টাইপের লোকদের বসার ব্যবস্থা। বাংলাদেশি শুনে ওনারা বারবার সাবধান করে দিতে লাগলো আর বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন চুরির কথা মনে করিয়ে দিতে লাগলো। ওনাদের সাবধানতা অমান্য করার ফলে কেমন করে যাত্রীদের মোবাইল আর লাগেজ চুরি গেছে সেই সব কাহিনী বারবার বলতে লাগলো। সেই সব শুনে উর্মির ভয় আরও চৌদ্দগুন বেড়ে গেলো।

ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে টের পাচ্ছি মায়িশাদের কামরাতে কোন একটা গন্ডোগোল লেগেছে। কমিটির কয়েকজন অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করছে। খানিক পরেই মায়িশা আর ঐশি ওদের লাগেজ টানতে টানতে রাগে গজগজ করতে করতে জাফরের সাথে আমাদের কামরা ক্রস করলো। ওদের কামরার সহযাত্রী কি সব জানি ঝামেলা করেছে তাই ওরা জাফর আর রাফাতের সাথে সিট বদল করছে। সব দেখে উর্মির প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। তখন চিং আর নিলয় একের পর এক সান্তনা দিতে লাগলো। কয়েক মিনিট পর আমরা চিন্তা করলাম যে এখনো যেহেতু কোন বাইরের লোক আসে নাই তাহলে দেখাই যাক না কি হয়। যখন কেউ আসবে তখন দেখা যাবে। তার আগ পর্যন্ত আমরা চারজন মিলে আটটা সিট ব্যাগ রেখে দখল করে রাখলাম। তারপর আমরা ঘুরতে বের হলাম।

আমাদের পাশের খোপেই রিজভী, আফরা আর ইশ্তিয়াক ছিলো। আমরা হেঁটে হেঁটে এক কামরা থেকে বাম দিকে অন্য কামরায় যাই। বেচারা হিমির জ্বর। ওকে দেখলাম ওর সহযাত্রী মহিলার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকতে। একই খোপে রুবাইদাও ছিলো। ওর সাথে খানিক্ষণ গল্প করলাম। তারপর আরও সামনে গেলাম। সবশেষে নিশাত, অদিতিসহ ওরা ছয়টা মেয়ে একসাথে বসে ছিলো। এরপর একটা দলের সাথেই শুধু দেখা হওয়া বাকি ছিলো। সেটা প্রায় ২২ টা বগি পরে জেরিন, ফাহাদের দল। আলসেমির জন্য সেটাতে আর গেলাম না। আমাদের কামরার ডান দিকে অন্য কামরায় জাফর, রাফাত, মৌলি আর মজুমদারকে বসে থাকতে দেখলাম। ছাড়া ছাড়া ভাবে সিট পড়ায় সব খানে সবার মন কমবেশি খারাপ দেখেছিলাম। কিন্তু এই বগিতে এক্সট্রিম থমথমে অবস্থা। কথা বলে জানলাম, সহযাত্রী আংকেলের সাথে মায়িশা আর ঐশির মনোমালিন্য হওয়ায় কেউই আর স্বাভাবিক হতে পারছে না।

সবার সাথে দেখা করে আমরা বুঝলাম যে আসলে আমরা সব থেকে ভালো অবস্থায় আছি। আমাদের এখনও পর্যন্ত কোন সহযাত্রী নাই। আমাদের কামরা বেশ আলো ঝলমলে এবং খোলামেলা। আর পাশেই ক্লিনাররা থাকায় একটু পর পর অনারা ঝাড়ু দিচ্ছিলো আর এয়ার ফ্রেশ্নার দিচ্ছিলো। আমাদের কাছাকাছি বাথরুমটাও পরিষ্কার- কোন গন্ধ নাই তবে বদনাও নাই। পানির কলটা আরও অদ্ভূত, টিপকল বলা চলে ঐটাকে। সব কিছু চিন্তা করে আমরা পজিটিভ মনোভাব নিয়ে বসি। যার যার মালপত্র সুন্দর করে গুছিয়ে খোশমেজাজে বসি।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদ উঠতে লাগলো। একটু পর পর বিভিন্ন ফেরিওয়ালা আমাদের পার হয়ে যেতে লাগলো। বাদাম, চিপস, ডালমুট, ছোলা ভুনা, সিংগারা, কালোজাম, ড্রিংকস, তালা চাবি, খেলনা, চা, নারিকেল কুচি আরও হাজারো রকমের জিনিস। আবার ট্রেনের নিজস্ব চা, চাওমিন, রাতের খাবার আর দুপুরের খাবার ছিলো। আমার বেশ ঘুম পাচ্ছিলো। আমি হ্যান্ড ব্যাগটা মাথার কাছে রেখে কম্বল জড়িয়ে ছোটখাটো একটা ঘুম দিলাম।

ঘুম থেকে উঠে আমি আর সুমাইয়া শেয়ারে লাঞ্চ খেলাম ভাত, সবজি আর ডিম। দাম পড়লো ১১০ রুপি। খাওয়া শেষে একটা লুডু কিনে আমরা চারজন খেলা শুরু করলাম। এর মধ্যে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি আর মায়িশা একটা বোতল কেটে ‘বদনা’ বানালাম। অনেকেই ঘুরতে আসলো আমাদের খোপের মধ্যে। আমাদের ‘ফার্স্ট ক্লাস’ আরাম দেখে সবাই ‘হিংসা’ করতে লাগলো। মুখে মুখে ছড়িয়ে গেলো আমাদের পরিষ্কার বাথরুম আর ‘বদনা’র কথা। দূর দূরান্ত বগি থেকে লোকজন আমাদের খোপে আসতে লাগলো ‘বদনা’ নিয়ে পরিষ্কার বাথরুমে যাওয়ার জন্য। চারটা খালি সিট থাকায় অনেকেই বসে গল্পগুজব করে। এক পর্যায়ে আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখলে বাংলাদেশের মতই দেখা যায়। ফসলের মাঠ আর মাঠ, কিন্তু কোন ঘর বাড়ি নাই। তবে বাংলাদেশ অনেক বেশি কালারফুল, দেখতে বিরক্ত লাগে না। ট্রেন একেকটা স্টেশনে থামে আর তিন থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে দেয়। সবাই এর মধ্যেই ঝাঁপাঝাঁপি করে ওঠা নামা করে।

আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামতে থাকে, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে শীত। আমরা অনেক গল্প করতে থাকি। এক সময় আবার অন্যদের সাথে দেখা করার জন্য ঘুরতে বের হই। অবাক হয়ে আবিষ্কার করি রুবাইদার পাশে বসে আছেন একজন সাধু বাবা। জীবনে কোনদিন সামনা সামনি সাধু দেখেছি বলে মনে হয় না। সাধু বাবার পরনে গেরুয়া বসন, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে লাল সাদা ডোরাকাটা দেওয়া। বিস্তর চুল দাড়ির মধ্যে উনার হাসি হাসি মুখটা দেখা যাচ্ছে। ফাহাদ রুবাইদার উপরের সিটে বসে মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে ‘ রুবাইদার পাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ কথাটা লিখে রেখেছে। আর যেই সামনে দিয়ে যাচ্ছে তাকেই দেখাচ্ছে স্ক্রিনটা। সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে লিখাটা দেখে। আর আমাদের হাসি দেখে সাধু বাবাও বেশ মজা পাচ্ছেন। উনি হিন্দিতে একবার বলেই ফেললেন এই কথা। ঘুরতে ঘুরতে বুঝলাম সবার মন মেজাজ বেশ ভালো আর আমাদের ‘বদনা’ সুপার হিট। এর মধ্যে জুবায়েরের সাথে খানিক্ষণ কথা বললাম ট্যুর শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। আমি সব খুলে বললাম কি কি ভুল আমাদের হয়েছে, কি কি বিষয় আমাদের ক্লিয়ার করতে হবে, আর সবাইকে নিয়ে ট্যুরের উপর ওভারঅল একটা ব্রিফিংয়ের কথা বললাম। তারপর যখন নিজের কামরায় ফেরত যেতে থাকি তখন দেখি সাধু বাবা চলে গেছেন। রুবাইদা একাই বসে আছে। আসার সময় সামনে এক মহিলাকে দেখলাম দু হাতে দুই ভারি ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে। হিন্দিতে উনি বললেন উনার সিট এস ফোর এ। আমিও বললাম আমিও সেইদিকেই যাচ্ছি। উনি অনুরোধ করলেন উনার ব্যাগটা টেনে দেওয়ার জন্য। আমি টেনে দিলাম। এক পর্যায়ে উনাকে এস ফোরে নামিয়ে দিয়ে আমি গেলাম মজুমদারদের কাছে। জাফর এক বুদবুদ বানানোর খেলনা পিস্তল কিনে বাতাসে খালি বুদবুদ ওড়াচ্ছে। মৌলি একটা কাপে করে কি যেন খাচ্ছে, জিজ্ঞেস করতেই বললো ‘কাপল ড্যান্স”। জিনিসটা আসলে কাপ নুডুলস কিন্তু লোকগুলোর উচ্চারণ শুনে ওরা মনে করে কাপল ড্যান্স। কৌতুহলী হয়ে এক কাপ কিনতেই বোঝা যায় আসল রহস্য।

াফেদ
প্রচন্ড শীতের সাথে লড়াইরত দুই দ্বিমিকবাসী (কৃতজ্ঞতায় সারাহ তাবাসসুম)

আমি যখন আবার ফিরে আসি তখন দেখি আমাদের খোপের সব চেয়ে উপরের দুইটা সিটে দুইজন লোক শুয়ে আছে আর নিচে একটু আগে পরিচয় হওয়া মহিলাটাকে টিটি টিকেট ইস্যু করে দিচ্ছেন আমাদের এখানে থাকার জন্য। মহিলার টিকেট নিয়ে কি যেন ঝামেলা হয়েছে। যাই হোক মহিলাকে আমরা নিচের একটা সিট ছেড়ে দেই। উনি ব্যাগ খুলে একটা ভর্তা হয়ে যাওয়া সুন্দর কেক বের করে আফসোস করতে থাকেন যে কেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের অবশ্য খাওয়ার জন্য সাধেন একবার। বলেন যে, ওনাদের কেকের দোকান আছে। স্বামী দিল্লী চাকরি করেন – তার জন্যই কেক নিয়ে যাচ্ছেন।

ডিনার করি আমি আর তমা শেয়ারে ১০০ রুপি দিয়ে। আইটেম ছিলো রুটি, চিজের টুকরা দেওয়া সবজি আর ডাল। সবাই ডিনার খেয়েদেয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করি। আমি নিচে, উর্মি আর চিং মাঝের দুই সিটে দুইজন। আর আমাদের সাথে ৯০ ডিগ্রী আঙ্গেলে নিচে নিলয়, ওর উপরের সিটটা একবার ফাঁকা থাকে একবার কেউ এসে বসে। নিলয় আমাদের সব গুলো ব্যাগ প্যাক নিয়ে ওর সিটে গুটিশুটি মেরে বসে থাকলো। আমরা অনেক বললাম ব্যাগগুলো নামিয়ে দিতে কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হলো না। বারবার বলতে লাগলো, তোরা ঘুমা, টেনশন করিস না, আমি জেগে আছি- বলে শাল মুড়ি দিয়ে বসে থাকলো।

আর আমি জানালার ফাঁক দিয়ে ঢোকা হিহি ঠান্ডা বাতাস বন্ধ করার জন্য মাস্কিং টেপ লাগালাম। আমার পাশের মহিলা বড়বড় চোখ করে সেটা দেখলো। তারপর শোয়ার সাথে সাথেই ঘুম।

 

The Mighty INDIA CALLING: সারাদিন ঘোরাঘুরি আর দিন শেষে হাওড়াময় রাত (পর্ব ৪)

ঘুম থেকে ঊঠলাম সকাল ৭ টার দিকে। রুবাইদা, মজুমদার আর মৌলি ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে নিচে ছেলেদের রুমে জমা দিয়ে বের হয়ে পড়লো। আমি একা একা ব্যাগ গুছালাম। সারা রুম তন্নতন্ন করে চেক করলাম, যে কিছু ফেলে যাচ্ছি কিনা আমরা। এক পর্যায়ে লাগেজ নিচের রুমে জমা দিয়ে রুমে এসে বসে থাকলাম। এর মধ্যে নিশাতরা ভুল করে আমাকে ফেলেই বের হয়ে পড়ে। আবার ফোন করে যোগাযোগ করে নিউ মার্কেটের সামনে ওদের সাথে যোগ দেই।

তারপর নিশাত আলাদা হয়ে যায়। আমরা অলিগলি দিয়ে বেশ ভিতরে ঢুকে পড়ি। আবার নিশাতকে খোঁজার জন্য আমি আর রিন্তু এগিয়ে যাই। এরপর দেখা যায় নিশাত সবাইকে খুঁজে পেয়েছে কিন্তু আমি আর রিন্তুই হারিয়ে গেছি। আবার খোঁজাখুঁজি করে সবাই একত্র হলাম। এরপর রওয়ানা দেই মার্কুইস স্ট্রিটে। মানি এক্সচেঞ্জে টাকা ভাঙ্গিয়ে রুপি করে নিলাম। আবার গেলাম আরাফাত হোটেলে। এবার অর্ডার দিলাম ৫ রুপির পুরি আর ৩৫ রুপির ডাল-খাসি। আমার খরচ পড়লো ২২ রুপি। পেট ভরে খেয়েদেয়ে আমরা বের হলাম- এবারের গন্তব্য সায়েন্স সিটি।

রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞেস করে বেশ কিছু দূর হেঁটে তিনটা মোড় পার হয়ে আমরা ২৪/এ বাসের জন্য দাঁড়ালাম। পথে আমি ২০ রুপি দিয়ে দুইটা ডাস ডাসা পেয়ারা কিনে নিলাম। পরে কাঠের মিনিবাস টাইপের বাসে না উঠে একটা বড় বাসে উঠে পড়ি। বেশ ফাঁকা বাস। আমরা হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসি। দূরত্ব ঘন্টাখানেকের হলেও ভাড়া ৯ রুপি। আমি জানালা দিয়ে দুপাশের কলকাতা শহর দেখতে থাকি। ভারি অদ্ভুত এই শহর, ভারি অদ্ভুত।

আমাদের সাইন্স সিটির গেটের উলটা পাশে নামিয়ে দেয়। আমরা আন্ডারপাস দিয়ে রাস্তা ক্রস করে আসি। আন্ডারপাসটায় আমরা ছাড়া আর কেউ ছিলো না। আমরা হাউকাউ করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলি। সায়েন্স সিটির গেটের সামনে বিশাল এক ডাইনোসোরের মুর্তি। আর একটু পাশে বিক্রি হচ্ছিলো স্ট্রিট ফুড। তমা চা খেলো। কাপের সাইজ এত ছোট মনে হলো যেন ওষুধ খাওয়ার কাপ। একটু পরেই রুবাইদা, মজুমদার ওদের সাথে দেখা হলো। ওরা বের হয়ে যাচ্ছে আর আমরা ঢুকছি। রুবাইদার পরামর্শ মত আমরা ৪০ রুপি দিয়ে এন্ট্রি টিকেট কাটলাম। আর নিশাত কাটলো ৭০ রুপি দিয়ে কেবল কারের টিকেট। এটা তেমন কিছুই না। খালি গেটটা পার করে দেয় কেবল কার দিয়ে।

ভেতরটা বেশ বড়। অনেকগুলো আলাদা বিল্ডিং। মেইন গ্যালারীটা পুরাই র‍্যাম্প করে স্পাইরাল হয়ে উপরে উঠে গেছে। আমরা দুই ভাগ হয়ে গ্যালারি দেখলাম। ছোট্ট কালে পড়া বিজ্ঞান বইয়ের সব উদাহরণ চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ভালোই লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে টায়ার্ড হয়ে আমি, অবনী আর তমা গ্যালারি ছেড়ে বের হলাম প্রায় পৌনে চারটার দিকে। আমাদের চারটার মধ্যে হোটেল থেকে হাওড়া স্টেশনে রওয়ানা হওয়ার কথা। দেরি হয়ে গেছে দেখে আমরা তাড়াতাড়ি একটা বাস ধরলাম নিউমার্কেট পর্যন্ত। ভাড়া একই নিলো কিন্তু উঠার সময় ট্রাফিক পুলিশ বলে দিয়ে ছিলো পকেটমার থেকে সাবধান থাকতে। আমরা কোনমতে বাস থেকে নেমে টানা রিক্সায় চড়ে সাড়ে চারটার দিকে হোটেলে পৌঁছলাম। নিচে দেখি একটা একটা করে ট্যাক্সি ক্যাবে করে মানুষজন উঠে রওয়ানা দিচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি করে নিচের রুম থেকে নিজের লাগেজ বের করে শান্ত, লিয়া, সৃষ্টির সাথে এক ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। ট্যাক্সি ভাড়া মোট ১৫০ রুপি।

আগে থেকেই কমিটি বলে দিয়েছিলো পুরানো স্টেশনে নামতে। আমরা তাই নামলাম। ট্যাক্সি থামতেই কুলির দল এসে হাজির হলো। তারা বললো দিল্লীর ট্রেন কল্কা মেইল তো নতুন স্টেশনে। আমরা তাদেরকে পাত্তা না দিয়ে নিজেরাই লাগেজ টেনে পুরানো স্টেশনে ঢুকলাম। ঢুকে জানতে পারলাম আমাদের ট্রেন আসলেই নতুন স্টেশনে আসবে। অগত্যা বিশাল রাস্তা আমাদের পাড়ি দিতে হলো এই সব ব্যাগপত্র নিয়ে। অবশেষে হাতের আঙ্গুলে লাল দাগ ফেলে আমরা নতুন স্টেশনে পৌঁছলাম। বি-শা-ল স্টেশন। অ-নে-ক মানুষ। অবশেষে খোঁজাখুঁজি করে জাফরকে পেলাম। তখনই জানলাম ঘটনাটা।

সন্ধ্যা ৭টার কল্কা মেইল ডিলে করেছে। কত সময়ের জন্য তা কেউ বলতে পারলো না। তবে মিনিমাম ১০-১১ ঘন্টা তো হবেই। বাজ পড়লো সবার মাথায়। এর মানে এই খোলা প্ল্যাটফর্মে বসে রাত পার করতে হবে? এই শীতের মধ্যে? Oh no!

তবে আমাদের মানুষেরা থাকলে কষ্ট করে হলেও কোন মতে থাকা যাবে, প্ল্যাটফর্ম দেখতে দেখতে আমি মনে মনে ভাবলাম। এর মধ্যে জাফর এসে জানালো উপরে মেয়েদের ওয়েটিং রুম আছে। আমরা সেখানেই থাকবো। প্ল্যাটফর্মে থাকতে হবে না আমি তাতেই খুশি। ব্যাগ টানতে টানতে লিফটে উঠলাম। লিফটের ভেতর মায়িশা আর নোভাকে রাগে ফেটে পড়তে দেখলাম। কমিটির কর্মকান্ড নিয়ে নাখোশ ওরা। ওদের দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম আমি। মনে হচ্ছিলো একটা না একটা গন্ডোগোল লাগবেই। ওয়েটিং রুমে ঢুকে দেখি রুবাইদা সবচেয়ে পিছনের রোতে মালপত্র গুছিয়ে, শিকল তালা মেরে ঘুমানোর পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে বসে আছে। আমাকে দেখে বল্লো, ‘নুযহাত, তোমার জন্য জায়গা রেখেছি। পিছনে দেওয়ালের সাথে মাথা ঠেস দিয়ে ঘুমানো যাবে। আর নিচে ব্যাগের উপর পা রাখলে আরাম হবে। আমরা চুপচাপ এখানে বসে থাকি। পরিস্থিতি ভালো না’। বুঝলাম আমার মত রুবাইদাও উত্তপ্ত পরিস্থিতির আঁচ পেয়েছে।

আস্তে আস্তে আমাদের মানুষজন সবাই এক এক করে আসতে লাগলো। সবাইরই মন কম বেশি খারাপ। এই রকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলো না কেউই। আমি সবার সাথে কথা বলে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করলাম। এদিক সেদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম আগামী ১২ ঘন্টা আমাকে কোথায় কাটাতে হবে। মোটমাট দুইটা ওয়েটিং রুম। ছেলেদেরটা বাইরে আর মেয়েদেরটা ভিতরে। মেয়েদেরটাতে চমৎকার টয়লেট আছে। ২ রুপি, ৩ রুপি, ৫ রুপি দিয়ে ঢুকতে হয়। ভেতরে গোসলখানাও আছে। আশেপাশের মানুষদের দেখলাম। সবাই মনে হলো ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত যে ট্রেন লেট হবে, আর এক দুই রাত ওয়েটিং রুমে থাকতে হবে। এক মহিলাকে তো গোসল করে শাড়ি বদলে চুল মুছতে দেখলাম। এক ফ্যামিলিকে দেখলাম সুন্দরমত ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে করে পরোটা, তরকারি খেতে। দেখে মনে হল যেন পিকনিক করতে এসেছে। আর বারবার মাইকে একটা অ্যানাউন্সমেন্ট বাজতে লাগলো। কি যে বলে আমরা কিছুই বুঝি না। বিরক্তিকর এই অ্যানাউন্সমেন্ট বাজতেই লাগলো। চারপাশের সবাইকে দেখে মনে হল আমরা ছাড়া কারও কোন টেনশন নেই। ১০-১২ ঘন্টা ট্রেন লেট যেন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

এক সময় আমাদের সবাই চলে আসলো। ছেলেরা ওদের মালপত্র সব মেয়েদের ওয়েটিং রুমের একটা শেলফের মধ্যে স্তুপ করে রেখে শিকল দিয়ে ভালোমত জড়িয়ে তালা মেরে দিলো। বেচারা কমিটি মেম্বারদের জন্য আমার খারাপ লাগলো। তবে বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে বলে কেউ কারও উপর চড়াও হলো না। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যুদ্ধ যুদ্ধভাবটা অনেকটাই কমে গেছে।

র‍্যাকের মধ্যে লাগেজ স্তুপ করে লাগেজ বাঁধাছাদা চলছে

সবে মোটে সন্ধ্যা পার হয়েছে। রুবাইদাকে দেখলাম চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে দেওয়ালে মাথা ঠেস দিয়ে ঘুম দিতে। আমারও ক্লান্ত লাগছিলো। খানিক্ষন চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিলাম। দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নাই। কিছু খেয়ে নেওয়া উচিৎ- মনে মনে ভাবলাম।

রাতে খাওয়ার জন্য নিচে নামলাম। ইতোমধ্যে অনেকে খেয়ে এসে রিপোর্ট দিয়ে গেছে। ওদের পরামর্শ মত খেতে ঢুকলাম ‘জন আহার’ নামক রেস্টুরেন্টে। আমি নিলাম ৩৫ রুপির ভেজ থালি। এই থালিতে ছিলো ভাত, পাতলা ডাল, আলুর ঝোল তরকারি, ফ্রি আচার আর লাল রঙের কি একটা সবজি জাতীয় জিনিস যেটা খেতে খুবই বাজে। খাওয়াটা অসম্ভব ঝাল ছিলো। আমার বেশ কষ্ট হলো। অনেকেই নিলো ৩৬ রুপির ছোলা ভাটুরা, ৩৫ রুপির ভেজ চাওমিন। চাওমিনটাই সবচেয়ে মজা ছিলো। অবাক হয়ে গেলাম ডেজার্টের দাম দেখে। মাত্র ১৪ রুপিতে পেস্ট্রি পাওয়া যায় এখানে। আমরা একসাথে বসে গল্পগুজব করে খেতে থাকি। খাওয়া শেষে আমি পেয়ারা ধুয়ে খাই। তারপর অন্য সবার সাথে স্টেশন ঘুরতে বের হই।

আমি এত বড় রেল স্টেশন আগে দেখি নাই। অনেক অনেক প্ল্যাটফর্ম। অনেক মানুষ চারপাশে। একপাশে সারি বেঁধে দোকান। রসগোল্লা, বাদাম, ডাল, চানাচুর, চিপস কি নাই সেখানে! আমাদের অনেকেই বাতাস দিয়ে ফুলানো বালিশ কিনলো। আমরা এটা সেটা দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। তারপর আবার ফেরত আসলাম ওয়েটিং রুমে।

কিছুক্ষন পর আবিষ্কার হলো, তমার পার্স চুরি হয়ে গিয়েছে। আমরা যখন দোকানপাট দেখছিলাম তখনই কেউ ওর ব্যাগ খুলে মেরে দিয়েছে পার্সটা। পার্সে এক হাজারের মত রুপি ছিলো, দেশের সিম কার্ডটা ছিলো, লাগেজের চাবি ছিলো আর ছিলো শিকলের চাবি। শিকলের চাবিটা হারিয়েছে দেখে তমা চিন্তিত হয়ে পড়লো। ওর লাগেজ তো শিকল দিয়ে বাঁধা আছে তাও আবার অন্যদের লাগেজের সাথে। শিকল খুলতে না পারলে কেমন করে হবে?

আমি খেয়েদেয়ে দাঁত মাজতে গেলাম। মেয়েদের বাথরুমে ঢুকতে গেলেই পয়সা দিতে হয়। দাঁত মাজার জন্য পয়সা দিতে ইচ্ছা হলো না। আমি গেলাম একটা খোলা বারান্দা টাইপ জায়গায়। সেখানে বেসিন আছে। আমি হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে দাঁত মাজতে লাগলাম। কনকনে শীত, উপরে খোলা আকাশ, নিচে ঝলমলে হাওড়া স্টেশন আর কাছেই রঙ্গিন হাওড়া ব্রিজ- এরকম জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি দাঁত মাজবো, জীবনে কোনদিন কল্পনাও করি নাই। দাঁত মাজতে মাজতেই দেখতে লাগলাম রাতের কোলকাতা শহর আর হাওড়া ব্রিজের রংচঙ্গে লাইট। প্রচন্ড ঠান্ডা পানি দিয়ে কুলি করে হাত মুখ সব অবশ করে আমি ফেরত আসলাম।

বেসিন ওয়ালা বারান্দা থেকে রাতের হাওড়া
বেসিন ওয়ালা বারান্দা থেকে রাতের হাওড়া

সত্যি বলতে কি আমার বেশ ভালোই লাগছিলো। এই রকম একটা অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনও হয় নাই। ওয়েটিং রুমটাকে বাসাবাড়ি বানিয়ে বসে থাকাটা চমৎকার লাগছিলো। আমরা গল্পগুজব করতে লাগলাম আর হাহা হিহি করে ফেটে পড়তে লাগলাম। অন্যরা এর মধ্যে শাল কম্বল মুড়ি দিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করলো। এক পর্যায়ে আমাদেরও কথাবার্তা কমতে লাগলো। সবাই নেক পিলোতে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করতে শুরু করলো। আমিও চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম আসলো না। মাঝে মাঝে খুট খাট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম- তমার ব্যর্থ প্রচেষ্টা শিকল আর তালা ভাঙ্গার। আর কানের কাছে জোরে জোরে বাজতেই লাগলো সেই অসহ্যকর অ্যানাউন্সমেন্ট………